যৌথ প্রত্নতত্ত্ব চীনা ও বিদেশি সভ্যতার মধ্যে পারস্পরিক শিক্ষা গভীর করে
2021-08-31 18:24:15

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চীন ৪০টির ও বেশি ‘চীন-বিদেশি সহযোগী প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্প’ সম্পন্ন করেছে। প্রকল্পগুলি আন্তর্জাতিক একাডেমিক ফ্রন্টলাইন গবেষণা এবং আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে। এতে মানুষের উত্পত্তি, বিশ্ব সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানে চীনের অবদান তুলে ধরেছে। একই সময়ে এটি চীনা ও বিদেশি সভ্যতার বিনিময় এবং পারস্পরিক শিক্ষার একটি চমত্কার সুযোগ দিয়েছে।

 

পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া মানবজাতির অন্যতম স্থান। ২০১৯ সালে চীন ও কেনিয়ার বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও যাদুঘর নিয়ে তৈরি একটি যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক দল কেনিয়ার লেক বোগোরিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করে। প্রাথমিক প্রত্নতাত্ত্বিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, পূর্ব আফ্রিকা রিফট ভ্যালি-তে বোগোরিয়া নদীর আশেপাশে খুব সমৃদ্ধ মধ্য-প্রাচীন প্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে; যা আধুনিক মানুষের উত্পত্তি অন্বেষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন-কেনিয়া বোগোরিয়া নদী স্থানের যৌথ খনন প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী চাও ছিং ফো বলেন, “মানবজাতির উত্পত্তি আফ্রিকায় এবং কেনিয়া মানবজাতির অন্যতম জন্মস্থান। এই ভূখণ্ডে ২.৫ মিলিয়ন বছরেরও বেশি প্রাচীন মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রয়েছে ৩.২ মিলিয়ন বছরের পুরানো স্টোন আর্টিফ্যাক্ট (stone artifact) আছে, তা হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম।  প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে, প্রাচীন প্রস্তর যুগ মানব ইতিহাসের ৯৯ শতাংশেরও বেশি অংশজুড়ে রয়েছে এবং এটি মানুষের উত্পত্তি ও বিস্তারের সবচেয়ে গুরুত্পূর্ণ পর্যায়। মানবজাতির উত্পত্তি এবং আধুনিক মানুষের উত্পত্তি প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেনিয়ার জাতীয় যাদুঘরের সঙ্গে প্রাচীন প্রস্তর যুগ বিশ্লেষণ এবং খনন প্রকল্প কেবল ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের জন্য নয়, বরং কেনিয়ায় আধুনিক মানুষের উত্পত্তি সম্পর্কিত আরও প্রমাণ দিয়েছে।”

 

চীন-কেনিয়া যৌথ খনন প্রকল্পের মতো অনেক যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্প রয়েছে। চীনা সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমির প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের গবেষক লি সিন ওয়েই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মধ্য আমেরিকার কোপান সাইটে গিয়েছেন। তিনি এই বিখ্যাত শহরের খনন ও প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। এই বিখ্যাত শহর মায়ান সভ্যতার গৌরবময় সাফল্য প্রত্যক্ষ করেছে। লি সিন উয়েই বলেন, “আমরা যে কোপান ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছি, তা হলো মায়ান শহরের রাজধানী, যা কোপান শহরের রাজধানীও বটে। এই রাজধানী শহর প্রাসাদ এলাকা, আভিজাত্য নিবাস এলাকা এবং সাধারণ নাগরিকদের বসবাসের এলাকায় বিভক্ত। আমরা যে অংশ খনন করেছি তা অভিজাত সমাজের বসবাসের এলাকা। ২০১৫ সালে খননকাজ শুরু হয় এবং তা ২০১৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।”

 

এই প্রকল্প ২০১৫ সালে চায়না একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সসের প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট এবং হন্ডুরাসের নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাস ইনস্টিটিউটের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রাসঙ্গিক চুক্তির একটি বিষয়। চুক্তি অনুযায়ী, দুই পক্ষ পাঁচ বছর ধরে কোপান সাইট খনন ও গবেষণা সহযোগিতা বাস্তবায়ন করবে। এই প্রকল্পও বিশ্বের অন্যান্য প্রধান সভ্যতার কোর এলাকায় চীনা প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্প।

 

প্রাচীন কোপান শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময়, লি সিন উয়েইয়ের নেতৃত্বে চীনা প্রত্নতাত্ত্বিক দল বড় আকারের অভিজাত সমাধিস্থল, দুর্দান্ত জেড, সমৃদ্ধ খোদাই সম্পর্কিত জিনিস আবিষ্কার করেছে। প্রাসঙ্গিক গবেষণার ফলাফল সমগ্র কোপান রাজ্যের উন্নয়ন ও বিবর্তন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। লি বলেন, “প্রথমে সমগ্র অভিজাত প্রাঙ্গণের বিবর্তন এবং উন্নয়নকে স্পষ্টভাবে বুঝেছি। এটি ছিল প্রায় ৫৫০ সাল। তারপর প্রায় ৩০০ বছর পার হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে চারবার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমাধি আবিষ্কার করা হয়েছে, এই সমাধিগুলিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক নিদর্শন রয়েছে, যেমন জেড ও রঙিন মাটির বাসন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যও আবিষ্কার করা হয়েছে। যার মধ্যে কিছু ছিল কোপানের প্রথম রাজা এই রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, কোপানের রাজপরিবারের সঙ্গে অভিজাত পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে অভিজাত পরিবারের মর্যাদা বোঝার জন্য এই অনুসন্ধানগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র কোপান শহরের উন্নতি বোঝার জন্য এটি আমাদের নতুন তথ্য দিয়েছে।”

 

জাতীয় পুরাকীর্তি ব্যুরোর প্রকাশিত উপাত্তে দেখা যায় যে, ত্রয়োদশ পাঁচশালা পরিকল্পনার শেষে পর্যন্ত চীনের ৩০টি সংস্কৃতি ও যাদুঘর প্রতিষ্ঠান আছে যা ২৪টি দেশে ৪০টিও বেশি যৌথ প্রত্নতত্ত্ব প্রকল্প চালিয়েছে এবং বহুমাত্রিক আন্তসরকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষা সহযোগিতার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।

 

জাতীয় পুরাকীর্তি ব্যুরোর উপ-পরিচালক সুং সিনছাও বলেন, চীন-বিদেশি যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্পের বিষয়বস্তু মানবজাতির উত্পত্তি ও আধুনিক মানুষের উত্পত্তি, মিশরীয় সভ্যতা এবং মায়ান সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বসহ বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। তা ছাড়া রেশমপথ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর সাইটগুলির প্রত্নতত্ত্ব, প্রাচীন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রত্নতত্ত্ব ও গবেষণা, গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন শহরগুলির প্রত্নতত্ত্ব এবং বৌদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাসহ অনেক আন্তর্জাতিক একাডেমিক ফ্রন্টলাইন ক্ষেত্র ও হট বিষয়। সুং বলেন, “বিদেশে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের মধ্যে একাডেমিক বিনিময় এবং পারস্পরিক শিক্ষা আরও উন্নত করেছে এবং মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সংযোগ উন্নয়ন করে। এই প্রক্রিয়ায়, চীনা প্রত্নতত্ত্বের অনেক পদ্ধতি, যার মধ্যে রয়েছে আমাদের বিশেষ কৌশল, যেমন অন্বেষণ ইত্যাদি, যা অন্যান্য অঞ্চলের জন্য চীনা সংস্কৃতির এক ধরনের ‘বাইরে যাওয়ার’ তথ্য তুলে ধরে।”

 

চীন-বিদেশি যৌথ প্রত্নতত্ত্বের প্রধান আবিষ্কারগুলি চীনের একাডেমিক প্রভাবকেও প্রসারিত করেছে। যেমন মঙ্গোলিয়ায় প্রাচীন যাযাবর জাতির সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্পের আবিষ্কার উইঘুর প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে উন্নত করেছে এবং আন্তর্জাতিক একাডেমিক সমাজে উচ্চ পর্যায়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। চীন-বাংলাদেশ একটি যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্পের কাজও চলছে। প্রাথমিকভাবে সাইটের ধ্বংসাবশেষের ঐতিহাসিক বিবর্তন অনুসন্ধান করা হয় যা গোটা বাংলাদেশে ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

 

লি মনে করেন, বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে অংশগ্রহণ শুধুমাত্র স্থানীয় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার দিগন্ত সম্প্রসারণের জন্যই সহায়ক নয় বরং বিশ্ব সভ্যতা এবং নিজের সভ্যতার বোঝাপড়া আরও গভীর করতে সহায়ক। লি বলেন, “যেমন মধ্য আমেরিকার গবেষণায় পশ্চিমা পণ্ডিতদের একটি ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গি আছে। চীনা পণ্ডিত হিসেবে আমাদের চীনা সভ্যতার একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং আমরা সংশ্লিষ্ট গবেষণা উন্নয়নে নতুন অবদানও রাখি। অন্যদিকে, আপনি যদি বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতাগুলি বুঝতে পারেন, আপনার নিজের সভ্যতা সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা তৈরি হবে।”

 

সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের জন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য উপকারী। ইউনেস্কোর কর্মকর্তা মিসেস মারিয়েলজা অলিভেইরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও উত্তরাধিকার, মানবসভ্যতার মধ্যে বিনিময় ও পারস্পরিক শিক্ষা উন্নয়ন এবং বিশ্ব শান্তির উন্নয়নে চীনের ইতিবাচক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “চীন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে; যাতে তারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরও ভালভাবে রক্ষা ও উন্নত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়ার অ্যাংকর বিশ্ব ঐতিহ্য সাইট এবং নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকা প্রকল্প। চীন আফ্রিকার অনেক দেশকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তাও দিয়েছে। তাদের কিছু প্রকল্প স্থাপনে সহায়তা করেছে। এই প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি, শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের মাধ্যমে চীন আবারও তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে। যা সভ্যতার সংলাপ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচার করবে।”