একটি ‘ভালোবাসার পাইন গাছ’, চিরকালের দেশপ্রেমের চেতনা
চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে ইনারমঙ্গোলিয়ার আ আর শানে একটি সীমান্ত স্টেশন আছে। এর নাম সান চিয়াও শান স্টেশন।
স্টেশনটি চীন ও ইনারমঙ্গোলিয়ার সীমান্ত পাহারা দেয়। ঠিক এই স্টেশনের একটি দুঃখজনক তবে সাহসী ঘটনা আছে।
গল্পটি ১৯৮১ সাল থেকে শুরু হয়।
১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে, স্টেশনের ২৬ বছর বয়সী প্রধান লি সিয়াং এবং ২৫ বছর বয়সী মেয়ে কুও ফেং রুং-এর বিয়ে হয়। তাদের আনন্দময় জীবন চলছিল।
সবাই জানে, সীমান্ত রক্ষাকারী সেনারা দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য খুব কমই বাসায় থাকতে পারে এবং ভালোভাবে পরিবারের যত্ন নিতে পারেন না। এ অবস্থায় তরুণ স্ত্রী কুও কখনই এজন্য অভিযোগ করেন নি, বরং সারা জীবন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তুমি দেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা করো, আমি তোমার পরিবারের যত্ন নিবো।
তবে জীবন কিন্তু ইচ্ছামতো চলে না। বিয়ের তিন বছর পর, স্বামী আর বাসায় ফিরতে পারেন নি। তরুণী স্ত্রী মনের দুঃখে সীমান্ত রক্ষাকারী স্টেশনের পাশে একটি পাইন গাছ লাগান।
স্টেশন রক্ষাকারী সেনা দফায় দফায় পরিবর্তন হয়। কেউ আসে, আবার কেউ চলে। তবে সেই ‘ভালোবাসার পাইন গাছ’ দিন রাত ধরে সেখানে বড় হতে থাকে।
২০১০ সালে স্ত্রী কুওর মৃত্যুর আগে বিশেষ করে নিজের ছেলে লি সিনকে বলেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ সীমান্তের হারাহা নদীতে ফেলে দিতে। যাতে তিনি অব্যাহতভাবে স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারেন।
এটি ভালোবাসার পাইন গাছ, চিরদিন ধরে দেশ ও পরিবারের ভালোবাসার প্রতিফলন।
এই পাইন গাছ চীনা সেনাদের সীমান্ত রক্ষায় দেশপ্রেমের চেতনা তুলে ধরে। যা সেনা সদস্যদের আত্মীয়দের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রমাণ।
হারাহা নদী একটি সিল্কের বেল্টের মতো চীন ও মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে বয়ে চলেছে।
বন্ধুরা, এবার শুনুন বিস্তারিত ঘটনা।
২০২১ সালের ৩০ মে, ৬০ বছর বয়সী মঙ্গোলীয় জাতির পুরুষ ইয়াং বাই ই লা কয়েকশ’ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে আবারও এই সীমান্তের নদীতে যান। তাঁর সঙ্গে এসেছেন ৭১ বছর বয়সী ইয়াং চিন লুং এবং ৬০ বছর বয়সী ওয়াং ছাং ইয়ু।
এই তিনজন অবসরে আছেন। এত দূর থেকে এখানে আসার কারণ, এদিনটি তাঁদের জন্য বিশেষ তাত্পর্যময়।
১৯৮৪ সালের ৩০ মে, ইনারমঙ্গোলিয়ার একটি সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর প্রধান লি সিয়াং এন মঙ্গোলীয় জাতির সেনা ইয়াং বাই ই লাকে নিয়ে সীমান্তে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁরা হারাহা নদীর তীরে আসেন।
হারাহা নদী একটি ঋতুনির্ভর নদী। সাধারণত অগভীর নদী। তবে বসন্তকালে নদীর পানি অনেক বেড়ে যায়।
ইয়াং বাই ই লা এই প্রথমবারের মতো সীমান্ত টহল দিচ্ছেন। তিনি তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, শুধু এই নদী পার হলে টহলের কাজ শেষ হবে। আমাদের বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত সীমান্ত লাইন লম্বা, বন বেশি, অবস্থাও বেশ জটিল। টহলের সময় তাঁর খুব উদ্বেগ লাগছিল।
দু’জন যখন নদীর মাঝখানে ছিলেন, তখন হঠাত্ নদীর পানি অনেক বেড়ে যায়। একটি বড় ঢেউ আসলে ইয়াং বাই ই লার ঘোড়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এজন্য ইয়াং বাই ই লা ছিটকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নদীতে পড়ে যান।
এই বিপদজনক মুহূর্তে লি সিয়াং এন ঘোড়া থেকে বরফের মতো ঠান্ডা নদীতে নেমে যান এবং ইয়াং বাই ই লার দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করেন।
ইয়াং বাই ই লা স্মরণ করে বলেন: নদীর পানিতে ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্তে লি সিয়াং এন তাঁকে ধরে ফেলেন। লি তার সব শক্তি দিয়ে তাঁকে নদীর তীরে নিয়ে যান, আস্তে আস্তে ইয়াং বাই ই লা বুঝতে পারেন যে, লি’র শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। হঠাত্ লি তাঁকে সব শক্তি দিয়ে আঘাত করে তীরের দিকে ঠেলে দেন।
এমন সময় আবারও একটি বড় ঢেউ আঘাত হানে। লি সিয়াং এন আবারও গভীর জলে তলিয়ে যান। যখন ইয়াং বাই ই লা লি’র হাত ধরতে যান, ততক্ষণে লি ঘূর্ণিজলে নিখোঁজ হয়ে যান।
ইয়াং বাই ই লা যেখানে আছেন, সে জায়গাটি হলো নদীর মাঝখানে ছোট একটি দ্বীপ। তিনি সেখানে আটকে পড়েছেন।
রাত হয়েছে। লি ও ইয়াং বাই ই লা স্টেশনে ফিরেন নি। স্টেশনের ইন্সট্রাকটর ইয়াং চিন লুং বুঝতে পারেন যে- কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।
এমন সময় লি-এর ঘোড়া ভেজা অবস্থায় ফিরে আসে এবং স্টেশন ঘিরে দৌড়-ঝাঁপ ও চিত্কার করতে থাকে।
ইয়াং বলেন: আমাদের প্রধানের কিছু ঘটেছে! তিনি তাড়াতাড়ি কয়েকজন সেনাকে নিয়ে সীমান্ত লাইনে যান।
ইয়াং বলেন, যখন তাঁরা ইয়াং বাই ই লাকে খুঁজে পান, তখন গভীর রাত। তাঁরা আবার নদীর স্রোত-বরাবর লিকে খুঁজতে থাকেন।
“লি, তুমি কোথায়?” গভীর রাতে তাঁদের ডাকা নদী ও পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। তবে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
২৯ বছর বয়সী সীমান্ত রক্ষী সেনা লি সিয়াং এন এভাবেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যান। তিনি আর ফিরে আসতে পারেন নি। তাঁর পরিবার এবং সহযোদ্ধাকে কিছু বলেও যেতে পারেন নি।
যেদিন লি সিয়াং এন মারা যান, সেদিন তাঁর ছেলে লি সিনের মাত্র দু’বছর বয়স হয়।
লি সিনের বয়স এখন ৩৯ বছর। তিনি বলেন, সেদিন তাঁর মা তাঁকে কোলে নিয়ে হাজার মাইল দূর থেকে সেনাবাহিনীতে যান, নদীর তীরে ৩ দিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।
স্ত্রী কুও বার বার স্বামীর নাম ধরে ডাকেন, সবাইকে তাঁকে স্টেশনে ফিরে আসার কথা বলে। কিন্তু তিনি রাজি হন না, অবশেষে তিনি নদীর তীরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।
স্টেশনের চিকিত্সা কক্ষে জ্ঞান ফিরে পেয়েই স্ত্রী কুও জানতে চান, আমার স্বামী কি বেঁচে আছে? আমি তাঁকে খুঁজে নিয়ে আসবো।
এক দিন, দুই দিন, এভাবে অনেক দিন পার হয়ে যায়, কুও স্টেশনে স্বামীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করেন।
পুরো বাহিনী দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে উদ্ধারকাজ করলেও লি’র কোনো খবর পাওয়া যায় নি। ছেলে লি সিন বলেন, ২০ বছর ধরে তাঁর মা সবসময় বিশ্বাস করছেন যে, তাঁর বাবা এখনও বেঁচে আছেন। হয়তো কোনো এক দিন তাঁদের সামনে আসবেন। সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাত্কারে লি সিন বার বার কাঁদেন, তাঁর বাবার মৃতদেহ কখনও পাওয়া যায় নি।
স্বামীর মৃত্যুর দ্বিতীয় বছরের বসন্তকালে স্ত্রী কুও আবারও সীমান্ত স্টেশনে যান। তিনি স্টেশনের সর্বোচ্চ স্থানে উঠে একটি পাইন গাছ লাগান। তিনি বলেন: সিয়াং এন, তুমি এই গাছ দেখে বুঝে নিও যে আমি আছি, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমি চিরদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। আগামী জীবনেও আমি তোমার স্ত্রী হয়ে থাকবো।
এরপর প্রতি বছর স্ত্রী কুও স্টেশনে যান, একদিকে সীমান্ত রক্ষী সেনাদের খোঁজ খবর নেন, অন্যদিকে তাঁর ভালোবাসার পাইন গাছ দেখেন। প্রতিবার তিনি হারাহা নদীর তীরে গিয়ে স্বামীর টহল করা পথে হাঁটেন এবং মনের গোপন কথাগুলো বলেন।
সময় ও বিশ্ব যত পরিবর্তনই হোক না কেন, এই পাইন গাছ যেন স্ত্রী কুও-এর মতো, পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে স্বামীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে।
পরে সেনারা এই পাইন গাছকে ‘ভালোবাসার গাছ’ নাম দেয়।
ছেলে লি সিন বলেন, তাঁর বাবা মা বিয়ে করার পর, একজন দেশের সীমান্ত রক্ষা করেছেন, আরেকজন পরিবারের যত্ন নিয়েছেন। দু’জন খুব কম সময়ই একসাথে থেকেছিলেন। তাই সবসময় তারা চিঠি দিয়ে ভালোবাসার কথা বিনিময় করেছেন। কুও সব চিঠিকে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে মনে করেন।
লি’র মৃত্যুর সময় কুও-এর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। একদিকে কাজ করা, অন্যদিকে অল্প বয়সী ছেলে ও বয়স্ক শাশুড়ির যত্ন নেওয়ার মতো কঠিন কাজ। অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন, একা এত কাজ করা দরকার নেই; ভালো কাউকে বিয়ে করে নাও। কুও তাতে রাজি হন নি। তিনি বলেন, আমার হৃদয়ে, সিয়াং এন এখনো জীবিত আছেন, আমার হৃদয় তাঁকে দিয়েছি, এখানে অন্যের জন্য কোনো জায়গা নেই।
দীর্ঘদিনের ব্যস্ততা এবং স্বামীর কথা ভাবতে ভাবতে কুও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১৯৯৮ সালে তাঁর যকৃত্ ক্যান্সার হয়।
এই দুর্ভাগ্য কুওকে পরাজিত করতে পারে নি। কুও-এর প্রাণ ছিল অনেক শক্তিশালী, চিকিত্সকের অনুমানের চেয়েও বেশি।
২০১০ সালের মে মাসে, কুও-এর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। ছেলে লি সিনের প্রস্তাবে তিনি রাজধানী বেইজিংয়ে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অস্ত্রপচার করেন।
লি সিন বলেন, আমার মা জানতেন যে, তাঁর সময় বেশি নেই। তিনি আমাকে বলেছিলেন, বাহিনীর নেতাকে একটি ফোন করো, তাঁর দেহাবশেষ যেন হারাহা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি চিরদিন আমার বাবার সঙ্গে থাকতে চান।
এটাই ছিল স্বামী লি’র মৃত্যুর পর ২৬ বছরে বাহিনীর কাছে চাওয়া স্ত্রী কুও’র একমাত্র অনুরোধ। এ ছাড়া তিনি কোনোদিন সাহায্য চান নি ও অনুরোধ করেন নি।
লি সিয়াং এনের চেতনা সবসময় সীমান্তরক্ষী সেনাদের উত্সাহিত করেছে।
ওয়াং ইয়ু বো হলেন বর্তমানে সান চিয়াও শান সীমান্ত রক্ষা স্টেশনের প্রধান। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর বিয়ে হয়; ঠিক সেই ‘ভালোবাসার পাইন’ গাছের নিচে। তিনি ও তাঁর স্ত্রীও একসাথে থাকতে পারেন না। তাঁরা দু’জন প্রবীণ নেতা লি সিয়াং এন দম্পতির মতো চিঠির মাধ্যমে মনের কথা বিনিময় করেন।
সবাই বলে, প্রবীণ প্রধান লি চলে যান নি, তিনি সবসময় তাঁদের কাছেই আছেন।
(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)