চীনের শ্রেষ্ঠ প্রজাতির তরমুজ গবেষক ডক্টর উ মিং জু’র গল্প
2021-08-27 16:58:45

সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন বয়স্ক নারী অতি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। তিনি ৯১ বছর বয়সী চীনা শিক্ষাবিদ। বিগত কয়েক দশক ধরে শ্রেষ্ঠ প্রজাতির তরমুজ উত্পাদনে জন্য তিনি গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এখন চীনারা সুস্বাদু ও সস্তা দামের তরমুজ খেতে পারেন। ২০১০ সালে আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি গবেষণার কাজ থেকে অবসর নেন। তবে, তাঁর অবদান চীনারা কখনও ভুলবে না। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ম্যাডাম উ মিং জু’র গল্প তুলে ধরবো।

চীনের শ্রেষ্ঠ প্রজাতির তরমুজ গবেষক ডক্টর উ মিং জু’র গল্প_fororder_wmz1

১৯৩০ সালে উ মিং জু চীনের হুপেই প্রদেশের একটি শিক্ষক-পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চীনে জাপানি বাহিনীর আগ্রাসনের সময় তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে ছোংছিং চলে যান এবং সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি নর্থওয়েস্ট কৃষি একাডেমির উদ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক হন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে রয়েছেন চীনের হাইব্রিড ধানের পিতা ডক্টর ইউয়ান লুং পিং।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত তিনি কখনও মাটিসংশ্লিষ্ট কোনো কাজ করেননি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর কৃষিকাজের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় তার।

চীনের শ্রেষ্ঠ প্রজাতির তরমুজ গবেষক ডক্টর উ মিং জু’র গল্প_fororder_wmz2

আগে কখনও তিনি নিড়ানি ব্যবহার করেননি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কৃষিকাজ শেখেন। প্রথম ক্লাসে তিনি ২০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার প্রস্থের একটি গর্ত খনন করেন এবং সেখানে ঘোড়ার বিষ্টা প্রয়োগ করে টমেটো চাষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় তিনি নিয়মিত শিক্ষকদের সাথে গ্রামে যেতেন। সেখানে তিনি নয়াচীন প্রতিষ্ঠার জন্য বীরদের ত্যাগের গল্প শোনেন ও দেশের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

২১ বছর বয়সে উ মিং জু তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘মানুষের জীবনের সবচেয়ে সেরা ও সুন্দর কাজ জনগণের সেবা করা।’ এমন মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি সিনচিয়াংয়ে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও স্নাতক হওয়ার পর সর্বপ্রথমে সাউথওয়েস্ট কৃষি ও বনায়ন ব্যুরোতে যোগ দেন তিনি এবং পরে উহান শহর থেকে রাজধানী বেইজিংয়ে চাকরি করার সুযোগ পান, তবে সিনচিয়াংয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা কখনও পরিবর্তন হয়নি তার।

চীনের শ্রেষ্ঠ প্রজাতির তরমুজ গবেষক ডক্টর উ মিং জু’র গল্প_fororder_wmz4

১৯৫৫ সালে সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তিনি সুযোগ বুঝে সিনচিয়াংয়ে চাকরির আবেদন করেন এবং সরকারের অনুমোদনও পেয়ে যান। সেই বছরের শীতকালে তিনি ট্রাকে প্রায় ১৫ দিনের যাত্রাশেষে উরুমুচিতে পৌঁছান।

 

তখন উরুমুচিতে কোনো তরমুজের ক্ষেত দেখা যেত না। স্থানীয় শহরবাসীদের সুপারিশে ১৯৫৬ সালের অগাস্ট মাসে তিনি উরুমুচির থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্তিত শানশান জেলায় তরমুজ চাষের কাজ শুরু করেন।

সিনচিয়াংয়ের তরমুজ অতি মিষ্টি ও সুস্বাদু। প্রাচীনকাল থেকে ব্যাপক জনপ্রিয় এখানকার তরমুজ। গবেষণার পর ম্যাডাম উ খেয়াল করেন যে, স্থানীয় গ্রামবাসীরা ঐতিহ্যিক পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করেন। অথচ আধুনিক পদ্ধতিতে তরমুজ উত্পাদন করলে উত্পাদন যেমন বাড়তে পারে, তেমনি স্বাদও হতে পারে আরও ভালো।

সিনচিয়াংয়ের গ্রীষ্মকালের আবহাওয়া অতি গরম। তখন মাটিতে যে তাপ উত্পন্ন হয় তাতে ডিম ভাজা যায়। স্থানীয় গ্রামবাসীরা মজা করে বলেন, এমন আবহাওয়াতে গাঁধাও হাঁটতে চায় না। কিন্তু এতে দমে যাননি উ মিং জু। বিভিন্ন ধরনের তরমুজের নমুনা সংগ্রহে উ মিং জু ও তাঁর সহকর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করেন। ৩ বছরে বিভিন্ন তরমুজ ক্ষেত থেকে বিঁচি সংগ্রহ করেন তারা। অবশেষে ৪৪ প্রজাতির তরমুজ খুঁজে পান তারা এবং গবেষণা শুরু করেন।

চীনের শ্রেষ্ঠ প্রজাতির তরমুজ গবেষক ডক্টর উ মিং জু’র গল্প_fororder_wmz3

তখন গবেষকদলকে দিনের বেলায় তরমুজ ক্ষেতে যেতে হতো  এবং রাতের বেলা সংগৃহীত তথ্যগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হতো। গরম আবহাওয়ার কারণে মোমবাতিও দ্রুত গলে যেতো। তাই ডক্টর উ ঠাণ্ডা পানিতে মোমবাতি ভিজিয়ে গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখতেন।

ম্যাডাম উ’র গবেষণাকাজ স্থানীয় গ্রামবাসীদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। তিনি গ্রামবাসীদের সাথেই থাকতেন ও খাওয়া-দাওয়া করতেন। তিনি তাদের সঙ্গে পরিশ্রম করতেন, একসাথে গম ও তুলার চাষ করতেন, গাঁধার গাড়ি চালাতেন। যে-কোনো কৃষিক্ষেতে পরীক্ষামূলক চাষের কাজ করার ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের সমর্থন পেতেন তিনি। এ সম্পর্কে ম্যাডাম উ বলেন, ‘আমাদের গবেষণার বাজেট ছিল কম। তাই, গ্রামবাসীদের কাছ থেকে বীজ, কৃষিক্ষেত ও সার নিয়ে আমাদেরকে পরীক্ষা করতে হয়েছে।’

ধীরে ধীরে গ্রামবাসীরা খেয়াল করেন যে, ম্যাডাম উ’র সাহায্যে তাদের তরমুজের উত্পাদন অনেক বেড়েছে এবং স্বাদও বেড়েছে। হাইব্রিডসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন প্রজাতির তরমুজ নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। নতুন ধরনের তরমুজের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতাও ভালো। এগুলো পরিবহনের সময় সহজে নষ্ট হয় না। ফলে তরমুজ চাষীদের আয় অনেক বেড়ে যায়।

কৃষিবিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি সেরা প্রজাতির ফলের জন্য গবেষণা করতে হয় ৮ থেকে ১০ বছর। কেউ কেউ সারা জীবনে মাত্র একটি সাফল্য পেয়েছেন, এমন উদাহরণও আছে। ম্যাডাম উ’র নেতৃত্বে সেরা প্রজাতির ফল উদ্ভাবিত হয়েছে মোট ২৯টি। এর মধ্যে তরমুজ ১০ ধরনের এবং মিষ্টি তরমুজ ১৯ ধরনের।

বলা যায়, ম্যাডাম উ ও তাঁর গবেষকদলের প্রচেষ্টায় গত শতাব্দীর ৮০ দশক থেকে সারা দেশের মানুষ সেরা মানের তরমুজ খেতে পারছে। ম্যাডাম উ’র প্রচেষ্টায় সিনচিয়াংয়ের বিশেষ ফল হামি তরমুজও সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। ‘সাদা চামড়া ৯৮১৮’ নামের হামি তরমুজ এখন যুক্তরাষ্ট্রেও উত্পাদিত হয়ে থাকে।

ম্যাডাম উ মিং জু সিনচিয়াংয়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। ম্যাডাম উ’র স্বামী ইয়াং চি ইয়ো তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। দু’জন ভিন্ন বিভাগের ভিন্ন শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন। যখন উ মিং জু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন, তখন ইয়াং বেইজিংয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শিক্ষার্থী হিসেবে পড়াশোনা করিছিলেন। দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় এবং তারা একসময় বিয়ে করেন।

চীনের সিনচিয়াংয়ের তরমুজ ক্ষেতে কাজ করার সময় সেখানকার কর্মপরিবেশ সম্পর্কে চিঠির মাধ্যমে ইয়াংকে অবহিত করতেন ম্যাডাম উ। উ’র সমর্থনে ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইয়াং ছি ইয়ো সিনচিয়াংয়ে চাকরির জন্য আবেদন করেন। ১৯৫৮ সালে দু’জন বিয়ে করেন এবং পরস্পরের সাথে ৩০ বছরের মতো জীবন কাটান।

নিয়মিতভাবে গ্রামে গবেষণাকাজ করার জন্য ম্যাডাম উ পরিবারের সাথে থাকতে পারতেন না এবং নিজের বাচ্চাদের যত্নও নিতে পারতেন না। তাই তাঁদের ছেলে-মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই নানা-নানীর যত্নে বড় হয়েছে। স্বামী ইয়াং গবেষণার কাজে সহায়তা দিতেন। কোনো পেশাদার ম্যাগাজিনে সংশ্লিষ্ট তথ্য দেখলে তিনি প্রতিলিপি করে বা অনুবাদ করে দিতেন। ম্যাডাম উ তাঁর প্রবন্ধে অতীতকালের কথা স্মরণ করেছেন।

তবে ১৯৮৬ সালে ৫৭ বছর বয়সে ইয়াং ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু ম্যাডাম উ’কে ভীষণ কষ্ট দেয়। স্বামীকে হারিয়ে তিনি আরও মনোযোগ দিয়ে গবেষণাকাজ করতে শুরু করেন। প্রতিবছর সিনচিয়াং আর হাইনানে বিভিন্ন ধরনের গবেষণাকাজ করতেন তিনি। এ সম্পর্কে উ বলেন, ‘আমার স্বামী অন্য দুনিয়ায় গেছেন, আর ফিরে আসবেন না। আমাকে একাই দু’জনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।’

উ’র মেয়ে ইয়াং সিয়া বাবা-মায়ের গবেষণাকাজ সম্পর্কে বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারিনি। তখন অনেক দুঃখ পেতাম। তবে, বড় হওয়ার পর তাদের অবদান বুঝতে পেরেছি। তাঁরা দেশের উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। নিজেদের সারা জীবন দেশের উন্নয়নে উত্সর্গ করেছেন। কোটি কোটি বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায় আমাদের দেশের উন্নয়ন বাস্তবায়িত হয়েছে।’

২০১০ সালে আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ৮০ বছর বয়সের ম্যাডাম উ মিং জু তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা-কাজ ত্যাগ করেন এবং ছোংছিংতে ফিরে যান।

উরুমুচিতে অবস্থিত সিনচিয়াং কৃষি বিজ্ঞান একাডেমির হামি তরমুজ গবেষণাকেন্দ্র ম্যাডাম উ’র উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন চীনের বৃহত্তম হামি তরমুজ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে সেটি। ম্যাডাম উ’র ছাত্র ই হুং পিং বর্তমানে এ গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক, যিনি সিনচিয়াংয়ের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ম্যাডাম উ’র গল্প শোনেন। স্নাতক হওয়ার আগে তিনি ম্যাডাম উ’র পরীক্ষাগারে ইন্টারশিপের সুযোগ পান। সেটি ছিল অনেকের জন্য শ্রেষ্ঠ সুযোগ। তবে, অনেকে ডক্টর উ’র সঙ্গে গবেষণাকাজের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। কারণ তরমুজ ক্ষেতে মশা অনেক বেশি। রাতের সময় ভালো ঘুম হয় না, খাওয়া-থাকার ব্যবস্থাও তেমন ভালো নয়। সেই পরিস্থিতিতে ৫০ বছর বয়সেরও ম্যাডাম উ নিজে তরমুজ ক্ষেতে পরিশ্রম করতেন, যা জনাব ই’র মনে গভীর দাগ কাটে।

ম্যাডাম উ’র সহকর্মী ফেং চিয়োং সিন তাদের হাইনান প্রদেশে তরমুজ গবেষণার কথা স্মরণ করে বলেন যে, ম্যাডাম উ ১৯৭৩ সাল থেকে হাইনান প্রদেশে তরমুজ চাষ নিয়ে গবেষণাকাজ শুরু করেন। কারণ, হাইনানের আবহাওয়ায় বছরে চার ধরনের তরমুজ চাষ করা সম্ভব। তিনি হাইনানে পৌঁছার পর প্রতিদিন তরমুজ ক্ষেতে যেতেন, বীজ বেছে নিয়ে তা চাষ করতেন। মোদ্দাকথা, সংশ্লিষ্ট সকল কাজ নিজে করতেন। মাঠে গবেষণার সাথে সাথে কম্পিউটার, ইংরেজি ভাষা এবং উন্নত প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহারসহ বিভিন্ন খাতে দক্ষতা অর্জনেরও চেষ্টা করেন তিনি।

ম্যাডাম উ একবার বলেছিলেন, ‘যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনের উদ্দেশ্য থাকতো, তাহলে তরমুজ নিয়ে গবেষণা করে আমি একজন ধনী মানুষ হতে পারতাম। কিন্তু, ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনের তেমন কোনো বিশেষ তাত্পর্য নেই। কেবল দেশ ও জনগণের স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করা বেশি তাত্পর্যপূর্ণ।’

আলঝেইমারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে এখন অনেককেই চিনতে পারেন না তিনি। তবে যখন তাঁর ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের সাথে দেখা হয়, ম্যাডাম উ অবশ্যই তরমুজ ক্ষেতের কথা জানতে চান এবং উরুমুচিতে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা বার বার প্রকাশ করেন।

উ’র ছাত্রী চাং হুং বলেন, ‘ম্যাডাম উ’র কাছ থেকে অনেককিছু  শেখার আছে। তাঁর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থেকে যুবকরা যেমন শিখতে পারে, তেমনি দেশের উন্নয়নে নিজেদের অবদান রাখতে উত্সাহিতও হয়। এটা সবার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।’

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)