বিদেশে চীনা শিক্ষার্থীদের বসন্ত উত্সব
2021-02-22 10:40:16

চীনের বসন্ত উত্সবের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি আমরা। খুব শিগগিরি পুনরায় শুরু হবে চীনাদের ব্যস্ত জীবন। ইতোমধ্যে অনেকে কাজ শুরুও করেছেন। যা হোক, কোটি কোটি চীনার জন্য এ উত্সব বিশেষ সাংস্কৃতিক তাত্পর্য বহন করে। যারা বিদেশে বসবাস করেন বা পড়াশোনা করেন—এমন চীনা প্রবাসীরাও এর ব্যতিক্রম নন। তাদের জন্য এ উত্সব উদযাপন করা যেন পরিবারে বা জন্মস্থানে ফিরে আসার মতো। আজকের আসরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসন্ত উত্সব কাটানো কয়েকজন চীনা শিক্ষার্থীর গল্প তুলে ধরবো।

বিদেশে চীনা শিক্ষার্থীদের বসন্ত উত্সব_fororder_st1

যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাডিসন শাখা ক্যাম্পাসের চীনা ছাত্র লি ইয়ু চ্য ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য এসেছেন। তিনি কখনও ভাবেননি যে, মহামারীর কারণে একসময় স্বদেশে ফিরে যেতে সক্ষম হবেন না। কিন্তু তাই ঘটেছে।

গত বছরের বসন্ত উত্সবে লি ইয়ু চ্য দেশে ফিরতে পারেননি অন্য কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থীদের সাথে বসন্ত উত্সব কাটিয়েছেন। তারা একসাথে চীনা ক্যালিগ্রাফি এঁকে দরজায় ঝুলিয়েছেন, একসাথে বসন্ত উত্সবের গালা উপভোগ করেছেন এবং ডাম্পলিং তৈরি করে খেয়েছেন। বিদেশে হলেও, তাদের তখন একা লাগেনি। চীনের বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের সাথে বসন্ত উত্সব উদ্‌যাপন করতে গিয়ে লি বিভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন রীতির সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন। এটা তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল।

তবে, এবারের তথা ২০২১ সালের বসন্ত উত্সব লি’র জন্য অনন্য অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে। মহামারীর প্রেক্ষাপটে চীনা শিক্ষার্থীদের জীবনযাপনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। যেমন, তারা নিয়মিত অনলাইনে ক্লাসে অংশ নেন, প্রতি সপ্তাহে শুধু খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য একবার সুপারমার্কেট যান, উইচ্যাটসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চীনে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করেন, ইত্যাদি। চলতি বছরের বসন্ত উত্সবের গালাও অনলাইনে দেখেছেন তিনি।

বিদেশে চীনা শিক্ষার্থীদের বসন্ত উত্সব_fororder_st2

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে, স্বদেশের বন্ধুদের সাথে সহজে যোগাযোগ করতে সক্ষম লি। এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের মাধ্যমে তার পরিচিত লোকদের সাথে যোগাযোগ করেন লি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আকাশপথে ১৪ ঘন্টার দূরত্ব। তবে ভিডিও-ফোনের মাধ্যমে বাবা-মায়ের সাথে নিজের রান্না করা খাবার পর্যন্ত শেয়ার করতে পারেন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিবাহের স্বাক্ষী হতে পারেন লি। কিন্তু অনলাইনে যোগাযোগের সুবিধা থাকলেও, নিজে স্বশরীরে জন্মস্থানে ফিরে আসা এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে উত্সব কাটানোর অনুভূতি অবশ্যই আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক বছর বাড়িতে প্রায় বন্দি ছিলেন তিনি, মহামারীর কারণে। এসময় তার মনে অতীতের আরামদায়ক ও সাধারণ জীবনের চিত্র ফুটে ওঠে। বাস থেকে  আশেপাশের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা, গ্রন্থাগারে বইয়ের সুগন্ধ নেওয়া, শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাসে পড়াশোনা করা, এবং শীতকালে বরফের হ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করা—এমন  অভিজ্ঞতাকে তার কাছে অমূল্য মনে হয়।

২০২১ সালে বসন্ত উত্সবের পর আরও ইতিবাচক মন নিয়ে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রেরণা পান লি। তিনি আশা করেন, সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসার পর তিনি আবার স্বদেশে ফিরতে পারবেন এবং স্বজনদের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটাতে পারবেন।

ছাত্রী সিয়া শি ই বর্তমানে ব্রিটেনে বাস করছেন। ২০১৯ সালের শেষ দিকে তিনি চীনের হুপেই প্রদেশে ফিরে যান। তখন কোভিড-১৯ মহামারী উহানে শুরু হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আবাসিক কমিউনিটিতে কিছু সহায়তামূলক কাজ করেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাবার পাঠিয়ে দেওয়া এবং প্রবাসী চীনাদের সাথে যোগাযোগ করে বিদেশ থেকে চীনে আসা চিকিত্সাসামগ্রী গ্রহণ করা ছিল তার অন্যতম দুটি কাজ। এমন অভিজ্ঞতা মেয়ে সিয়া’র জন্য অসাধারণ। কারণ, মহামারী ঠেকাতে গোটা চীনা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিনিও জাতির একজন। উহানের লকডাউন এবং মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসার পর লকডাউন তুলে দেওয়ার সাক্ষীও তিনি। অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মেয়ে সিয়া আবার ব্রিটেনে ফিরে যান। তখন এ সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য অতি কঠিন ছিল। মহামারীর কারণে সিয়া’র ডক্টরেট ডিগ্রির পড়াশোনার সময়সূচি অনেক পিছিয়ে গেছে। ব্রিটেনে মহামারী পরিস্থিতিও মারাত্মক। তাই ব্রিটেন ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি স্বজনদের আপত্তির মুখে পড়েন।

এ সম্পর্কে সিয়া বলেন, “মহামারী মানুষের মনে ভয়ঙ্কর অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। তবে আমি লেখাপড়ার খাতিরে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্রিটেনে যাওয়ার পথে বিমানে আরও অনেক চীনা যুবক-যুবতী ছিল আমার মতো। স্বপ্নের বাস্তবায়নে সাহসের সাথে যাত্রা শুরু করেছে তারা। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর দেখি আগের সেই সরগরম রাস্তা আর নেই; শুধু কয়েকটি গাড়ি দেখা যায়। লন্ডন কখনও এমন শান্ত ও নীরব ছিল না। ব্রিটেনের মহামারী পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। আমার জীবন মানেও তখন শুধু শিক্ষাঙ্গন ও বাসা। সূর্যালোকের দিনে আমি নদীর তীরে হাঁটাহাটি করে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করতাম আর লেখাপড়ার সময়সূচি অনুসরণ করতাম।”

২০২১ সালের বসন্ত উত্সব কয়েক জন চীনা শিক্ষার্থীর সাথে উদ্‌যাপন করেছে সিয়া। এমন উত্সবের সময় বিদেশে একা থাকা কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব স্বদেশে ফিরে আসা তাঁর ইচ্ছা। নতুন বছরে সুদূর ব্রিটেন থেকে সবার সুখী জীবন কামনা করেন সিয়া।

ফ্রান্সে চীনা ছাত্রী সুন ইউয়ে গত কয়েক বছর ধরে বাস করছেন। তাঁর জন্য বিদেশে বসন্ত উত্সব বিশেষ আনন্দদায়ক অনুভূতি নিয়ে আসে না। কারণ, আশেপাশের স্থানীয় নাগরিকরা এ উত্সব পালন করেন না। ছুটিতে চীনা আবাসিক এলাকায় গিয়ে বসন্ত উত্সবের আমেজ অনুভব করাই তার জন্য সার। প্রবাসী চীনারা লাল লন্ঠন ঝুলান এবং সিংহ ও ড্রাগন নৃত্য প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। বিদেশিদের জন্য এ অতি আশ্চর্যজনক ও মজার ব্যাপার। শুধু চীনাদের চোখে এর গুরুত্ব অন্যরকম।

বিদেশে চীনা শিক্ষার্থীদের বসন্ত উত্সব_fororder_st3

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর নেতিবাচক প্রভাবে সারা বিশ্বে প্রবাসী চীনারা একটি অপূর্ব বসন্ত উত্সব কাটাতে বাধ্য হন। ফ্রান্সে সকল উদযাপনী অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। ফলে ছাত্রী সুন শুধু কয়েক জন বন্ধুর সাথে এ উত্সব পালন করেন। ছোটবেলায় তাঁর জন্মস্থানে বসন্ত উত্সব কাটানোর কথা স্মরণ করেন তিনি। তখন উত্সব ছিল অনেক আনন্দদায়ক। চান্দ্রপঞ্জিকার শেষ মাসের শেষ দিক থেকে মা ঘরবাড়ি পরিষ্কারের কাজ শুরু করতেন। পরিষ্কার বাড়িঘরে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো চীনাদের রীতিনীতি। তারা বিশ্বাস করেন যে, এতে পরিবারের সকল সদস্য সুখী ও স্বাস্থ্যকর জীবন লাভ করবে। বছরের শেষ দিনে পরিবারের সকল সদস্য একসাথে সুস্বাদু খাবার খাওয়া তাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তার নানা-নানী বাড়ির সামনে সবার ফেরার অপেক্ষা করতেন। রান্নাঘরে মাছ, মাংস, মিষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হতো। এ খাবার বাচ্চাদের জন্য বিশেষভাবে আনন্দদায়ক।  আতশবাজি পোড়ানোও অতি মজার ব্যাপার ছিল। বসন্ত উত্সবের শেষ দিনে লন্ঠন উত্সব কাটাতে বিভিন্ন আকারের কাগজের লণ্ঠন তৈরি করা হতো। তখন নানী ময়দা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করতেন, যা মেয়ে সুনের জন্য অতি চমত্কার স্মৃতি। ছোটবেলার স্মৃতি স্মরণ করে নতুন বছরের সুখী জীবন কামনা করেন তিনি। নতুন বছরে মহামারীর অবসান কামনা করেন। তিনি আশা করেন, দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক হবে।

জার্মানির হালার উইটেনবার্গে মার্টিন লুথার বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ছাত্র থাং বিন তাঁর বসন্ত উত্সব কাটানোর অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেছেন। ২০২১ সালের প্রথম দিকেও জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মহামারী পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফলে স্বদেশে ফিরে যাওয়া থাংয়ের জন্য কঠিন ব্যাপার। জার্মানিতে অনেক চীনা ছাত্রছাত্রী মহামারী প্রতিরোধক ব্যবস্থার জন্য চীনে ফিরে আসেননি বা আসতে পারেননি। তাদের মধ্যে অনেকে শুধু ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা সহপাঠীর সাথে হটপট খাওয়ার মাধ্যমে বসন্ত উত্সব পালন করেছেন। জার্মানিতে চীনা দূতাবাস ছাত্রছাত্রীদের বসন্ত উত্সবের বিশেষ উপহার দিয়েছে। উপহারের মধ্যে চীনা ভেষজ ওষুধ ও মাস্কসহ বিভিন্ন চিকিত্সাসামগ্রী অন্তর্ভুক্ত ছিল। দূতাবাসের পক্ষ থেকে চীনা শিক্ষার্থীদের দরজায় ঝুলানোর স্ক্রলও দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে ছাত্র থাং বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় আশা, নতুন বছরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে পারব এবং একসঙ্গে খাবার খাবো। সেটা হবে নতুন বছরের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।”

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)