সম্প্রতি চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২০ সালের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, গত বছর চীনা অর্থনীতির আকর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মহামারী ছড়িয়ে পড়া অবস্থায় চীন কীভাবে এমন সাফল্য অর্জন করেছে? এ সম্পর্কে আজ আমি আপনাদের জানাতে চেষ্টা করবো, কেমন?
গত বছর চীনের জিডিপি প্রথম বারের মতো ১০০ট্রিলিয়ান ইউয়ান ছাড়িয়েছে
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০২০ সালে চীনের জিডিপি ১০১.৫৯৮৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছিল। তা ২০১৯ সালের চেয়ে ২.৩ শতাংশ বেশি। ২০ বছর পর চীনের জিডিপি ২০০০ সালের ১০ট্রিলিয়ান ইউয়ান থেকে ১০০ট্রিলিয়ন ইউয়ানেরও বেশি হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এতে প্রতিফলিত হচ্ছে যে, চীনের অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এবং সার্বিক রাষ্ট্রীয় শক্তি নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। চীন ২০২০ সালে বিশ্বের একমাত্র বৃহত্ অর্থনীতি যার প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
বিশ্বজুড়ে মহামারি এখনো তাণ্ডব অব্যাহত রেখেছে। এমন প্রেক্ষাপটে যদিও চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা নিম্নগামি ছিল, তবে এটি কখনও ধীর গতির ছিল না।
২০২০ সালে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যিক আমদানি-রপ্তানি পূর্ব প্রত্যাশ্যার চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। বিদেশী বাণিজ্যের মাত্রা ইতিহাসের নতুন রেকর্ড সৃষ্ট হয়। সারা বছর চীনের মালামাল আমদানী-রপ্তানীর মোট পরিমাণ ছিল ৩২.১৫৫৭ট্রিলিয়ান ইউয়ান। তা ২০১৯ সালের চেয়ে ১.৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে রপ্তানির বৃদ্ধি ৪শতাংশ, আমদানি ০.৭ শতাংশ কমেছে।
২০২০ সালের জুন মাস থেকে চীনের রপ্তানি বৈদেশিক চাহিদা বাড়ানো, অব্যাহত মহামারী প্রতিরোধ সামগ্রী ও সরঞ্জাম এবং মহামারী সৃষ্ট সরবরাহ স্থলাভিষিক্ত কার্যকরের প্রভাবের কারণে বিরাট বৃদ্ধি পায়।
২০২০ সালে চীনের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেছে। নাগরিকদের বার্ষিক আয় অর্থনীতির মতো প্রবৃদ্ধি পায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালে চীনের শহুরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে ১.১৮৬ কোটিজনে। তা ৯০ লাখের প্রত্যাশিত লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেছে।
২০২০ সালে শহুরে বেকারত্বের হার ও শহুরে নিবন্ধিত বেকারত্বের হার প্রত্যাশিত লক্ষের চেয়ে কম। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত নীতি ভূমিকা পালন করেছে।
২০২০ সালে চীনা নাগরিকদের গড় নিষ্পত্তিযোগ্য আয় ছিল ৩২হাজার ১৮৯ ইউয়ান, তা ২০১৯ সালের চেয়ে ৪.৭ শতাংশ বেশি। মূল্যের কারণ ছাড়া আসল প্রবৃদ্ধি ২.১ শতাংশ। গোটা চীনের নাগরিকদের মাথাপিছু ব্যয়যোগ্য আয় ছিল ২৭.৫৪ হাজার ইউয়ান। তা ২০১৯ সালের চেয়ে ৩.৮ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি শহরবাসীদের মাথাপিছু আয়ের হার অব্যাহতভাবে কমছে।
তাহলে চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য কেন অনুমানের চেয়ে বেশি হয়েছে?
২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের অর্থনীতির দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুতর পতন হয়েছে। প্রথম কোয়ার্টারে চীনের জিডিপি ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়ে ৬.৮ শতাংশ কম ছিল। এ পরিস্থিতিতে চীন কী করে ২০২০ সালের সাফল্য অর্জন করেছে?
প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্মূল সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা। চীনা শীর্ষ নেতারা মহামারী প্রতিরোধ এবং অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়নে অংশ নেন। চীনা উন্নয়নের বিরাট সুপ্তশক্তি ও চালিকাশক্তি পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়। তারপর বেশ কিছু নীতি দ্রুততার সাথে কার্যকর করলে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়।
মহামারী প্রতিরোধের পাশাপাশি আর্থিক ঘাটতি ১ট্রিলিয়ন ইউয়ান বৃদ্ধি, মহামারী প্রতিরোধের জন্য ১ট্রিলিয়ন ইউয়ানের বিশেষ জাতীয় ঋণ প্রকাশিত, আর্থিক ব্যবস্থা বস্তুনিষ্ঠ অর্থনীতির কাছে ১.৫ট্রিলিয়ন ইউয়ান লাভ আত্মসমর্পণ করে এবং নতুন করে ২.৫ট্রিলিয়ন ইউয়ান কর ও ফি হ্রাস হয়েছে। সমস্ত চীনা মানুষের যৌথ প্রচেষ্টায় চীন সবচেয়ে আগে মহামারী নিয়ন্ত্রণ এবং কাজ-কর্ম ও উত্পাদন পুনরুদ্ধার করেছে। সবচেয়ে আগে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। গত মার্চ মাসের শেষ দিকে স্থানীয় মহামারীর বিস্তার মূলত অবরুদ্ধ হয়েছে। গত এপ্রিল মাসের মাঝা-মাঝিতে নির্ধারিত আকারের উপরে প্রতিষ্ঠানের উত্পাদন পুনরুদ্ধারের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি।
সর্বশেষ চীনা অর্থনীতির গভীর ঐতিহ্য ও সহনশীলতা আছে। চীনের মিনশেং ব্যাংকের প্রধান গবেষক ওয়েন বিন বলেন, চীনের পূর্ণাঙ্গ শিল্প ব্যবস্থা রয়েছে। চীন হলো জাতিসংঘের শিল্প শ্রেণিবদ্ধে সমস্ত শিল্প বিভাগযুক্ত একমাত্র দেশ। পাশাপাশি চীনের ১.৪বিলিয়ান মানুষের সুপার বাজার আছে। সেজন্য চীনের নিজস্ব সমন্বয়ের সামর্থ্য শক্তিশালী। কার্যকরভাবে মহামারীর ক্ষতি মোকাবিলা করতে পারে। গত কয়েক বছরের সরবরাহ পার্শ্ব সংস্কারের মাধ্যমে শিল্প আপডেটের সাফল্য সুস্পষ্ট।
এছাড়া, মহামারীতে অনেক নতুন অর্থনৈতিক পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের উচ্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ই-কমার্স দ্রুতভাবে উন্নত হয়। মহামারীর অবস্থায় অধিকতরভাবে চালিকাশক্তি ও সৃজনশীলশক্তি তোলে ধরা হয়েছে। মহামারীতে নতুন ব্যবসা পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়। ৫জি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অফ থিংসসহ বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংক্ষিপ্ত ভিডিও, লাইভ কমার্সসহ অনলাইন বিনোদন, বেচাকেনা, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ বিভিন্ন নতুন পদ্ধতি উন্নত হচ্ছে।
তাহলে ২০২১ সালে চীনা অর্থনীতি কেমন হবে?
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা অব্যাহতভাবে চীনের অর্থনীতি সম্পর্কে ভরসা রাখছে। বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ রিপোর্ট ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছে যে, ২০২১ সালে চীনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৯ শতাংশ। কারণ চীন কার্যকর মহামারী প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছে।
কিন্তু সুন্দর বার্ষিক রিপোর্টের পর স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হয়, চীন এখনো বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ। মাথাপিছু জিডিপি এখনো বিশ্বের গড়পড়তা মানের চেয়ে কম। প্রধান উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে এখনও আরও ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। তাই চীনা অর্থনীতির কিছু সমস্যা সমাধান করতে হবে। আগামি পর্যায়ে দ্রুততার সাথে পণ্যভোগ ত্বরান্বিত করা এখনো অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির চাবিকাঠি। পরিষেবা শিল্পের ভোগ পুনরুদ্ধারের সুযোগ বেশি। নিম্ন ও মধ্য আয় গ্রুপের কর্মসংস্থান ও আয়ের পরিস্তিতি পণ্যভোগের দিকের উপর প্রভাব ফেলবে। কর্মসংস্থানের মান উন্নত, অধিবাসীদের আয় সুনিশ্চিত করা এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেমা/এনাম