চীন যেভাবে সব জেলাকে দারিদ্রমুক্ত করতে সফল হলো-সিআরআই সম্পাদকয়ী
2020-11-25 14:40:34

নভেম্বর ২৫: চীনের গুইচৌ প্রদেশের ইয়ানহো জেলার সিছু থানাধীন বিয়ানজিয়াং গ্রামের ভৌগলিক অবস্থান উলিং পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত। ফলে বেশ কয়েক বছর আগেও দেশটির অন্যান্য এলাকার মতো এই গ্রামে ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে পারে নি। ২০১৪ সালের এক পরিসংখ্যান মতে বিয়ানজিয়াং এর ১৩৪টি পরিবারের ৬৯৯জন সদস্যই দরিদ্র ছিলেন। তখন গ্রামটিতে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০.৮২ শতাংশ।

পাহাড়ের গভীরে গ্রামটির অবস্থান হওয়ার কারণে এর পরিবহন ব্যবস্থাও ছিল খুবই অনুন্নত। গ্রামটির দারিদ্রতার পিছনে এর পরিবহন ব্যবস্থাকেও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।   

ওই গ্রামের বাসিন্দা ছেন মাও ফু, ৬২, বলেন, “আগে আমাদের গ্রামে কোন সড়ক ছিল না। আমরা বাজারে যেতাম ৪ ঘন্টারও বেশি সময় ব্যয় করে। শিশুদের স্কুলে যাওয়ার পথও অনেক খারাপ ছিল”।

তবে, বর্তমানে দারিদ্র্যবিমোচন পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার ফলে এখানে অনেক সড়ক নির্মিত হয়েছে। গ্রামটিতে পর্যায়ক্রমে শীতল পানিতে মাছ চাষ, প্রাকৃতিক মুরগি পালন ও ক্রিসেনথিমামের চাষাবাদ শুরু হয়েছে, তিনি যোগ করেন।

“আমার দুটি সন্তান চেচিয়াং প্রদেশে কাজ করে। আমার পরিবারের মোট পাঁচজন সদস্য বাইরে কাজ করে। ফলে শিল্প লভ্যাংশ ও জনকল্যাণমূলক কাজের উন্নয়নের মাধ্যমে বর্তমানে আমার পরিবারের গড় বার্ষিক আয় এক হাজার ইউয়ানেরও বেশি দাড়িয়েছে”, ছেন মাও ফু আরও যোগ করেন।

 

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর চীনের ৮২৩টি দরিদ্র জেলার নামের তালিকা প্রকাশিত হয়। এতে ২২টি প্রদেশ, অঞ্চল ও শহর অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন চীনের দরিদ্র জেলার আয়তন প্রায় গোটা চীনের অর্ধেক ছিল। প্রায় প্রতি তিনটি জেলার মধ্যে একটি ছিল দরিদ্র।

পরবর্তীতে ২০১৬ সালে গুইচৌ প্রদেশকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।  তখন প্রদেশটিতে ৭৮.৪ লাখ দরিদ্র মানুষের বসবাস ছিল। এ সংখ্যাটি ছিল চীনের যে কোন প্রদেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। আর এসব দরিদ্র মানুষের ৯০ শতাংশেরও বেশি পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাস করতেন। সেজন্য গুইচৌ প্রদেশ দারিদ্র্যবিমোচন ও স্থানীয় অভিবাসনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। পরিকল্পনার আওতায় গুইচৌ প্রদেশ তার ১৮.৮ লাখ দরিদ্র বাসিন্দাকে দুর্গম এলাকা থেকে স্থানান্তরিত করার লক্ষ্যে গোটা প্রদেশে মোট ৫.৪৩৯ লাখ এপার্টমেন্ট সমন্বিত মোট ৯৪৬টি স্থানান্তরিক বাসবাস এলাকা নির্মাণ করে। পাশাপাশি গুইচৌ প্রদেশ সংশ্লিষ্ট শিল্প, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্নত করার মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদেরকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে।

এছাড়াও গুইচৌ প্রদেশ গ্রামীণ শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে সুপ্ত সম্পদের অনুসন্ধান করে। ২০১৮ সালে গুইচৌ গ্রামীন শিল্প কাঠামোর সমন্বয় করে। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরিবর্তে আধুনিক শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। ২০১৯ সালে গ্রামীণ শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে গোটা গুইচৌ প্রদেশের মোট ১১.১ লাখ দরিদ্র বাসিন্দার আয় বৃদ্ধি করা হয়।

গুইচৌ প্রদেশের মত চীনের অন্যান্য অঞ্চলও জাতীয় উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা অনুযায়ী দারিদ্র্যবিমোচনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে চীনের দরিদ্র জেলাগুলোর তালিতা ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকে। ফলে  গত  সাত বছর ধরে চীন প্রতি বছর ১ কোটির ও বেশি মানুষকে দারিদ্র্যেমুক্ত করে আসছে। ২০১২ সালে দেশটিতে  দরিদ্র জনসংখ্যা ছিল মোট ৯.৮৯৯ কোটি। আর ২০১৯ সালে এসে এ সংখ্যা দাড়িয়েছে মোট ৫.৫১ লাখে। এক কথায় চীনে এ সময়ে দারিদ্র্যের হার ১০.২ থেকে কমে ০.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

দারিদ্র্যবিমোচন বিশ্বজুড়ে একটি কঠিন সমস্যা। এ সমস্যা নিয়ে প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশকেই হিমশিম খেতে দেখা যায়। কিন্তু চীন বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্বেও দারিদ্র্যবিমোচনে যে বিরাট সফলতা অর্জন করেছে, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর এ সফলতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো একটি ফলপ্রসূ জাতীয় দারিদ্র্যবিমোনচন পরিকল্পনা কার্যকর করা।

চীন সরকার দারিদ্র্যবিমোচনকে জাতীয় সাধারণ উন্নয়নের কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। সরকার, সমাজ ও বাজারে একসঙ্গে দারিদ্র্যবিমোচনের কাঠামো গড়ে তুলা হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দারিদ্র্যবিমোচনের মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে জনগণের উন্নয়ন সামর্থ্যকে উন্নীত করে তা কাজে লাগানো হয়েছে।  

চলতি বছরে হঠাৎ কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। এটি দারিদ্র্যবিমোচনের কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে, চীন সরকার তার পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য পরিবর্তন করে নি। রাষ্ট্রীয় পরিষদের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যলয়ের পরিচালক লিউ ইয়ং ফু গত মে মাসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দারিদ্র্যবিমোচনের মানদন্ড ও নির্ধারিত সময় পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ ৪০টিরও বেশি অতিরিক্ত  ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মহামারিকালীন কঠিন সমস্যা সমাধান করতে। ফলে চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের পদ্ধতি গোটা বিশ্বের জন্য এক বিরল শিক্ষনীয়  অভিজ্ঞতা হয়ে দাড়িয়েছে।

সম্প্রতি শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মহাসচিব ভ্লাদিমির নরোভ বলেন, চীন ‘ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করে উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। চীন বিশ্বের দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখে চলছে। তাই এ খেত্রে চীনের অভিজ্ঞতা খুবই মূল্যাবান।

আগেকার দরিদ্র জেলাগুলো বর্তমানে সম্পূরর্ণরূপে দারিদ্রমুক্ত হয়েছে। ফলে দারিদ্রতা হলো চীনের  অতীত ইতিহাস। তাহলে দেশটির পরবর্তী দায়িত্ব কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে চীনা রাষ্ট্রীয় পরিষদের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যলয়ের উপপরিচালক সিয়া গেং শেন বলেন, যদিও সব দরিদ্র জেলা দারিদ্র্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে, তবুও চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের দায়িত্ব শেষ হয় নি। দারিদ্র্যবিমোচনের কাজকে  ‘সমৃদ্ধ গ্রাম’ পরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করতে হবে।

ছাই/এনাম/ওয়াং হাইমান