মহামারি প্রতিরোধ করেছেন সাধারণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ সব বীর
2020-11-20 15:53:53

মহামারি প্রতিরোধ করেছেন সাধারণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ সব বীর

 

চলতি বছর চীনে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হলে তা চীনা জনগণের জীবনের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। এই মহামারি প্রতিরোধের লড়াইয়ে অনেক সাধারণ মানুষ মহান বীরের মতো ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়েছেন; জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে এমন দু’জন চিকিত্সকের ঘটনা জানাবো।

 

১৭ বছর আগে তিনি চীনে সার্স রোগ প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করেন। চলতি বছর তিনি আবারও করোনাভাইরাসের মহামারির প্রতিরোধের কাজে যোগ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধে আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। চীনা জনগণের জীবন ও স্বাস্থ্যকে শীর্ষস্থানে রাখা হয়েছিল’। তিনি হলেন চীনের প্রজাতন্ত্র পদকপ্রাপ্ত, চীনের প্রকৌশল একাডেমির একাডেমিশিয়ান, চীনের শ্বসনতন্ত্র রোগ গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালক অধ্যাপক চুং নান শান।

 

চলতি বছর আকস্মিক করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হলে ৮৪ বছর বয়সী চুং নান শান বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবভিত্তিক আচরণ করেছিলেন। যেমন ‘জনগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাদের প্রাণ রক্ষার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া’। তাঁর উত্থাপিত ভাইরাস প্রতিরোধ কৌশল ও চিকিত্সার পদ্ধতি অসংখ্য প্রাণ রক্ষা করেছে।

 

১৮ জানুয়ারি, অধ্যাপক চুং নান শান কুয়াংচৌ থেকে উ হান-গামী দ্রুত গতির ট্রেনে ওঠেন। বিপদের সময় তিনি দেশের স্বাস্থ্য কমিশনের উচ্চপদস্থ বিশেষজ্ঞ দলের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কারণ ছিল, উ হানে খুঁজে পাওয়া এক ধরনের অজ্ঞাত নিউমোনিয়া রোগের ভাইরাসের অনুসন্ধান করা। এর আগের কয়েক দিনে অধ্যাপক চুং সারা দেশের জনগণকে আহ্বান জানান যে, সাধারণ মানুষের প্রয়োজন না হলে উ হানে না-যাওয়া ভালো।

 

উ হান শহর পরিদর্শনের পর দেশের স্বাস্থ্য কমিশনের উচ্চপদস্থ বিশেষজ্ঞ দল চিহ্নিত করে যে, এই ‘নতুন ধরনের নিউমোনিয়া’ এখন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রামিত হচ্ছে। ২০ জানুয়ারি, অধ্যাপক চুং বেইজিংয়ে গণ-মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এসব তথ্য দেন এবং তিনি সারা দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের বিষয়ে সতর্কতাও ঘোষণা করেন।

 এরপর তিনি বহুবার সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, ভাইরাস প্রতিরোধে আস্থা যুগিয়েছেন।

 

২৮ জানুয়ারি, যখন উ হানে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজ সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পৌঁছায়, তখন জনাব চুং সিনহুয়া বার্তা সংস্থায় এক সাক্ষাত্কারে বলেন, সারা দেশ উ হানকে সাহায্য করছে, উ হান নিশ্চয়ই এই কঠিন অবস্থা পরাজিত করতে পারবে। উ হান আসলেই একটি বীরের শহর।

অধ্যাপক চুং এই প্রথম এমন  কথা বলেন নি। ২০০৩ সালে চীনে সার্স রোগ ছড়িয়ে পড়লে তিনি প্রমাণ করেন যে, সার্স রোগের কারণ ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস।

২০২০ সালের অগাস্ট মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রেসিডেন্ট নির্দেশে, অধ্যাপক চুংকে ‘প্রজাতন্ত্র পদক’ প্রদান করা হয়। যাতে করোনাভাইরাসের মহামারির প্রতিরোধের কাজে তাঁর অসাধারণ অবদানের কিছুটা স্বীকৃতি দেওয়া যায়।

 

চীনে প্রতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিন সারা দেশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি টিভি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, এর নাম ‘নতুন সেমিস্টারের প্রথম ক্লাস’। এই অনুষ্ঠানে অধ্যাপক চুং অংশ নেন এবং বলেন, ‘বৃহত্তম মানবাধিকার কোনটি? আমরা এত মানুষের জীবন রক্ষা করেছি, এটাই হল আমাদের বৃহত্তম মানবাধিকার রক্ষা।

 

২৭ অগাস্ট, অধ্যাপক চুং নান শান কুয়াংচৌ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগে ঘোষণা করেন যে, একজন করোনাভাইরাসের রোগী ১১১ দিনে ইসিএমও সাপোর্টের মাধ্যমে প্রাণে বেঁচেছেন, যা চিকিত্সা জগতের একটি মিরাকল

ইসিএমও হলো হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের গুরুতর রোগের চিকিত্সায় ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক পদ্ধতি। এটি গুরুতর রোগীদের ‘জীবনের শেষ আশা’ বলা যেতে পারে। জনাব চুং বলেন, চিকিত্সার প্রক্রিয়ায় এক শতাংশ আশা থাকলেও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবো।

 

২০০৩ সালে চীনে সার্স রোগ ছড়িয়ে পড়ার সময় অধ্যাপক চুং নান শান বলেছিলেন যে, ‘সবচেয়ে গুরুতর রোগীকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।’ করোনাভাইরাসের মহামারির সঙ্গে লড়াইয়ে, তিনি আবারও ‘একজন রোগীকেও ছেড়ে যাবো না’ এমন গুরুগম্ভীর প্রতিশ্রুতি দেন।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে, চুং অনেকবার ভিডিও’র মাধ্যমে হু পেই প্রদেশের অন্যান্য জায়গার রোগীর চিকিত্সা করেন। স্থানীয় চিকিত্সক ও রোগীদের অনেক শক্তি দেন।

 

চুং বলেন, উ হানে রোগীর সংখ্যা বেশি, কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত দেশের ৪২ হাজারেরও বেশি চিকিত্সককে উ হানে সহায়তা দিতে পাঠান। আর অল্প সময়ের মধ্যে আমরা হুও শেন শান ও লেই শেন শান দুই বিশেষ হাসপাতাল তৈরি করি। যেসব চিকিত্সক এ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন, তারা সবাই এতে গর্ব বোধ করেন। আমরা মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যকে শীর্ষ স্থানে রাখি, আমরা আমাদের কথা  বাস্তবায়ন করেছি।

 

অধ্যাপক চুং বলেন, আমি সাধারণ একজন চিকিত্সক। আমি ‘প্রজাতন্ত্র পদক’ পেয়েছি, এজন্য আমি খুব উত্তেজনা বোধ করি। তবে আমি ‘দায়িত্ব’ শব্দটিকে বেশি গুরুত্ব দেই। আমাদের আরো চেষ্টা করতে হবে, শ্বাসরোগ ও আকস্মিক গণস্বাস্থ্য ঘটনা মোকাবিলা ও প্রতিরোধের ক্ষেত্র স্থাপন করতে হবে। করোনাভাইরাসের মহামারি পরাজিত করতে হবে এবং নতুন আকস্মিক গণস্বাস্থ্য ঘটনা মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

 

অধ্যাপক চুং বলেন, ‘সংক্রামক রোগের কোনো দেশীয় সীমানা নেই। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দরকার’। তথ্য বিনিময় হলে অন্যান্য দেশ কম ভুল করবে। কারণ, আমরা কঠোর পথ অতিক্রম করেছি, তাই আমাদের পরস্পরকে সমর্থন দিতে হবে।

 

 

মহামারি প্রতিরোধ করেছেন সাধারণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ সব বীর

চাং তিং ইয়ু: ভাইরাসের মহমারি মোকাবিলায় অচল শরীর দিয়ে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেন

 

চীনে এমন একজন চিকিত্সক আছেন, করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধে তিনি প্রায় অচল শরীর দিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধে লড়াই করেছেন, মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন, সময়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। হাসপাতালের সব কর্মীদের নেতৃত্ব দিয়ে ২.৮ হাজারেরও বেশি রোগীর চিকিত্সা করেছেন তিনি। তিনি নিজের আচরণের মাধ্যমে ‘মানুষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ এই কথা প্রমাণ করেছেন।

তিনি হলেন, হুপেই প্রদেশের স্বাস্থ্য কমিশনের উপ মহাপরিচালক, উ হান শহরের চিন ইন থান হাসপাতালের প্রধান চাং তিং ইয়ু। তাঁকে ‘জনগণের বীর’ নামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

 

চীনে করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধের যুদ্ধে, উ হান শহরের চিন ইন থান হাসপাতালকে ‘সবচেয়ে কাছের যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে বলা হয়।

২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর, প্রথম দফা অজ্ঞাত পরিচয়ের নিউমোনিয়া রোগী চিন ইন থান হাসপাতালে ভর্তি হয়। এই হাসপাতাল একটি সংক্রামক রোগের বিশেষ হাসপাতাল। ঠিক এই হাসপাতাল থেকে চীনে করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের যুদ্ধ শুরু হয়। হাসপাতালটি অনেক গুরুতর রোগীর চিকিত্সা করেছে।

 

চাং তিং ইয়ু এই হাসপাতালের প্রধান। তিনি নিজেও একজন রোগী। তিনি অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরসিস (amyotrophic lateral sclerosis) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর অর্থ, তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশের স্নায়ু ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যায়, এর ফলে পুরো শরীর যেন জমাটবদ্ধ বা অচল হয়ে পড়ে।

 

প্রথম এক মাসে, চাং তিং ইয়ু ভোর ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন এবং পরদিন মধ্যরাত ১টায় শুতে যান। অনেকবার তিনি রাত দুইটায় শুয়ে পড়লেও আবার ৪টার দিকে কাজের জন্য হাসপাতালে ছুটে যান।

তিনি বলেন, এই ভাইরাস আগের যে কোনো ভাইরাসের চেয়ে আলাদা। এটি হল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সিপিসির সদস্য, হাসপাতালের প্রধান এবং চিকিত্সক- এই হল চাং তিং ইয়ু’র তিনটি পরিচয়। তিনি বলেন, যে পরিচয় হোক না কেন, বিশেষ এই মুহূর্তে, দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। ফ্রন্ট লাইনেই লড়তে হবে।

 

হাসপাতালের ভবনে, ওয়ার্ডে সবসময় চাং-এর কথা শোনা যায়। তিনি যে কথাটি সবচেয়ে বেশি বলেন, তা হল: আরো দ্রুত, আরো দ্রুত কাজ করো। তবে তাঁর শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।

চাং সবসময় মনে করেন, ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সময় যথেষ্ট নয়। তাঁর স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিন পর চাং দশ কিলোমিটার দূরে অন্য একটি হাসপাতালে গিয়ে স্ত্রীকে একবার দেখার সুযোগ পান।

 

স্ত্রী ছেং লিন বলেন, আমি দেখেছিলাম চাং খুব ক্লান্তি, আমি তাকে দ্রুত বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার তাগিদ দেই। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত, চাং মাত্র একবার হাসপাতালে গিয়ে স্ত্রীকে দেখেছিলেন।

চাং বলেন, আসলে স্ত্রীর আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে তিনি অবাক হয়েছেন ও অনেক ভয় পেয়েছেন। তবে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, নিজের কাজ সঠিকভাবে করে যাবেন।

 

যখন রোগী ও নিজের বিষয় বাছাই করতে হয়, তখন তিনি নিজেকে বাদ দিয়ে রোগীকে বাছাই করেন। তিনি নিজের শারীরিক অচলাবস্থার রোগ উপেক্ষা করে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করেছেন।

তিনি বলেন, আমি বীর হওয়ার কথা কখনো চিন্তা করিনি। আসলে আমরা সব চীনারা একসাথে অনেক কষ্ট করেছি এবং অবদান রেখেছি। আমি পৃথিবীর অন্য দশজনের মতোই সাধারণ একজন মানুষ।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)