ইউন নান প্রদেশের চাও থুংন: চীনে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র লোকসংখ্যার অঞ্চলের দারিদ্র্যমুক্তির গল্প
2020-10-21 09:49:53

ইউন নান প্রদেশের চাও থুংন: চীনে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র লোকসংখ্যার অঞ্চলের দারিদ্র্যমুক্তির গল্প

ইউন নান প্রদেশের চাও থুং শহর। উ মেং পাহাড়ের ভিতরে অবস্থিত। শহরের ৯৬.৩ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চল এবং ওখানে রকি মরুকরণ পরিস্থিতি খুব গুরুতর। সারা শহরের ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে ২০১৪ সালের শেষ দিকে ১৮.৫ লাখ মানুষ দরিদ্র ছিল। শহরের অধীনে ১১টি জেলার মধ্যে ১০টি জাতীয় পর্যায়ের দরিদ্র জেলা ছিল। এমন একটি জায়গা কীভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারে? আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চাও থুংয়ের গল্প বলব।

৬৭ বছর বয়সী গ্রামবাসী সাও কুয়াং ৩০ মিনিটের মোটর সাইকেল জার্নিশেষে এসেছেন জেলায়। তিনি বললেন, আগে গ্রামে রাস্তা ছিল না। জেলায় আসতে ৪ ঘন্টা লাগত। এখন ৩০ মিনিটের মধ্যে আসা যায়। তিনি স্বচোখে দেখেন গ্রামের পাশে নির্মিত হয়েছে রেলপথ, জাতীয় সড়কপথ ও হাইওয়ে। তিনি ট্রেনে বা বাসে বাইরে গিয়ে কাজ করেন।

ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে চাও থুংয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে মোট ১৪০ বিলিয়ান ইউয়ান বিনিয়োগ করা হয় এবং নতুন নির্মিত হয় ১২টি হাইওয়ে। চাও থুংয়ের সব জেলায় অন্তত একটি হাইওয়ে নির্মিত হয়। ২০১৯ সালের শেষ দিকে ছেংতু-কুই ইয়াং হাইস্পিড ট্রেন চালু হয় এবং ছুং ছিং-খুন মিং হাইস্পিড রেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। চাও থুং থেকে বেইজিং ও শাংহাইসহ বড় শহরে যাবার ৯টি সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়। ইউন নান প্রদেশের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বন্দরও চাও থুংয়ে আছে। যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন এ শহর এখন বাইরের বিশ্বের সাথে সব ধরনের মাধ্যমেই সংযুক্ত। স্থানীয় পরিবহন বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানান, সাধারণ জায়গায় এক কিলোমিটার হাইওয়ে নির্মণে ৫ হাজার ইউয়ান লাগে। তবে চাও থুং এ পাহাড়ি অঞ্চল বিধায় এখানে এক কিলোমিটার হাইওয়ের নির্মাণ-খরচ ৭০০০ ইউয়ান। কিন্তু রাস্তা নির্মাণ তো করতে হবে! চাও থুংয়ের গ্রামাঞ্চলে ৩০ লাখের বেশি মানুষের শ্রমশক্তি আছে এবং রেল ও সড়কপথ নির্মিত হবার পর স্থানীয় মানুষ সহজে বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন। ২৪ লাখ মানুষ এখন বাইরে কাজ করেন এবং তারাও দারিদ্র্যবিমোচনে অবদান রাখেন।

কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর চাও থুংয়ে ৩১ জানুয়ারি থেকে চালু হয় সার্বিক কোভিড-১৯ পরীক্ষা। এখানে, সবার আগে, ২২ ফেব্রয়ারি চালু হয় কর্মট্রেন। সরকারের উদ্যোগে মানুষদেরকে বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে কর্মস্থলে পাঠানো হয় এই কর্মট্রেনে করে। পরিবহনের উন্নয়ন একদিকে স্থানীয় মানুষের জন্য বাইরে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ২০১৬ সালে, চাও থুং শহরের ই না গ্রামে চালু হয় হাইওয়ে এবং গ্রামবাসী লি সুন চাই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ পর্যটন ব্যবসা শুরু করেন। এখন তার মাসিক আয় ১০ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়েছে এবং তার উদ্যোগে গ্রামের ৮ জন বাসিন্দা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন। ৬০ বছর বয়সী কুং হ্য গ্রামের বাসিন্দা চো পাও চি আপেল চাষ করেন এবং সুবিধাজনক পরিবহনের সাহায্যে তার আপেল চীনের নানান জায়গায় বিক্রি হয়।

আগে চাও ইয়াং এলাকা থেকে চেন সিং জেলায় যেতে ৬ ঘন্টা লাগত। চলতি বছরের শেষ দিকে নতুন হাইওয়ে চালু হবার পর এ যাত্রায় মাত্র ২ ঘন্টা লাগবে। এখন চেন সিং জেলার সড়কপথের দৈর্ঘ্য ১২৮০০ কিলোমিটার এবং জেলার প্রধান জানান, ভবিষ্যতে জেলাকে ইউন নান, কুই চৌ ও সিছুয়ান প্রদেশের পরিবহনের সংযোগস্থলে পরিণত করা হবে।

স্থানান্তরও দারিদ্র্যবিমোচনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। গত বছরের অগাস্ট মাসে ৭১ বছর বয়সী লিউ সি চেন ও তার পরিবার পাহাড় থেকে আসেন চেন সিং জেলায়। পুরাতন বাড়ির সামনে তোলা তার একটি ছবি এবং নতুন বাড়ির সামনে তোলা তার আরেকটি ছবি এখন গ্রামের ইতিহাস যাদুঘরে স্থান পেয়েছে। ২০১৮ সালে নির্মিত হয় ২৩টি স্থানান্তর এলাকা এবং এর মধ্যে ৯টি এলাকায় স্থানারিত মানুষের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এখন শহরের ৩.৬ লাখ দরিদ্র মানুষ নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তবে কেবল স্থানান্তর দারিদ্র্যসমস্যা সমাধান করতে পারে না। মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। চিং আন এলাকা বড় একটি স্থানান্তর এলাকা এবং ৩৫ বছর বয়সী ওয়াং সি খুন স্থানান্তরিত মানুষ। নতুন এলাকায় আসার পর তিনি প্রথম বারের মতো ব্যবসা শুরু করেন। তিনি দুধ চা বিক্রি করেন এবং প্রতিদিন তিনি সর্বোচ্চ ৭০০ ইউয়ান আয় করতে পারেন। তিনি বলেন, এখানে বাস করে হাজার হাজার মানুষ এবং তার ব্যবসার জন্য এটা স্থিতিশীল একটি বাজার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, চাও থুং স্থানান্তর এলাকায় নির্মিত হয় ৫৩১৮টি সবজি গ্রীনহাউস, ৩৭৯১টি মাশরুশ গ্রীনহাউস, ৬ লাখ বর্গমিটার দারিদ্র্যমিবোচন কারখানা এবং ৪.৫ লাখ বর্গমিটার ব্যবসা অবকাঠামো। মোট ৪৯.৮ হাজারটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এখানে। নতুন বাড়ি, নতুন চাকরি পেয়েছে স্থানান্তরিত মানুষ এবং তারা এখন শহরে আধুনিক ও নতুন জীবন শুরু করেছেন।

১৮ অগাস্ট বিশেষ একটি ভিডিও-সম্মেলন চাও থুং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব আলু কমিটির চেয়ারম্যান কানাডা থেকে ঘোষণা করেন, চাও থুংকে বিশ্ব মালভূমি আলু নগরের খেতাব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চাও থুং শহরে ২৬ লাখ মু জমিতে আলু চাষ করা হয় এবং ২২০০ মিটার উঁচু পাহাড়েও আলু চাষ করা যায়। ৫০ বছর বয়সী লুও সি ফু একজন আলু চাষী এবং তার নেতৃত্বে গ্রাম বাসিন্দারা ২২০০ মু জমিতে আলু চাষ করেন। তারা ইউন নান কৃষি বৈজ্ঞানিক একেডেমির সরবরাহকৃত উন্নত প্রযুক্তি ও বীজ ব্যবহার করেন। তাদের আলু টানা ৪ বছর ধরে সিছুয়ান, ছং ছিং, কুয়াংতুং, এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছে।

চাও থুংয়ে রোদ প্রচুর, যা আপেল চাষের জন্য ভাল। এখন চাও থুংয়ের ৮ লাখ মু জমিতে আপেল চাষ হয়। তা ছাড়া, চাও থুংয়ে দেখা যায় নতুন একটি শিল্প। বাঁশের চাষ। এ শিল্পের মাধ্যমে একদিকে গ্রামবাসিন্দাদের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষিত হচ্ছে।

আলু, আপেল, বাঁশ, গ্যাস্ট্রোডিয়া এবং মরিচসহ নানা কৃষিপণ্যের চাষ এখন ১০ বিলিয়ান ইউয়ানের পর্যায়ের শিল্প। ২০১৯ সালের শেষ দিকে, চাও থুং শহরের দরিদ্র লোকংসখ্যা ২০১৪ সালের ১৮ লাখ ৫০ হাজার ৭০০ জন থেকে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯০০ জনে কমে এসেছে। দারিদ্র্যের হার ৩৪.৮ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৪ শতাংশে। চলতি বছরের প্রথামার্ধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যারা এখনও দারিদ্র্যমুক্ত হয়নি, তাদের মৌলিক জীবনমান নিশ্চিত করা হয়েছে।

চাও থুংয়ের পুরাতন নাম ছিল উ মেং। চীনা ভাষায় উ ও মেং মানে অন্ধকার। তাই জায়গার নামটা চাও থুংয়ে পরিবর্তন করা হয়। চাও মানে উজ্জ্বল এবং থুং মানে আবদ্ধ। চাও থুংও তার নামের মতো উজ্জ্বল ও অবাধ ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছে। (শিশির/আলিম/রুবি)