পাহাড়ি এলাকার 'টাইম মেশিন'
  2020-10-30 14:54:51  cri

চীনের ইয়ুননান প্রদেশের ওয়েন শান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকায় আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ অনুসরণ করে অসীম চন্দ্রমল্লিকা ফুল ক্ষেত পার হয়ে লাউ উ জি গ্রামে পৌঁছে যায়। গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ মিটার উঁচুতে ওয়েন শান শহরের বো জু থানায় অবস্থিত।

পাহাড়-পর্বত ও মেঘের সমুদ্র দিয়ে সাজানো ছোট প্রাঙ্গণটি খুব আকর্ষণীয়। প্রাঙ্গণে পঞ্চতারকা খচিত লাল পতাকা বাতাসে উড়ছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের প্রতি মনের গভীরের ভালোবাসা দিয়ে ৬৮ বছর বয়সী চীনের ই জাতির বৃদ্ধ কাও সিয়াও পা নিজের বাড়িকে একটি প্রদর্শনী কক্ষে পরিণত করেছেন। বহু বছর ধরে তাঁর সংগ্রহ করা বিপুল পরিমাণের ছবি ও ফাইল দিয়ে গভীর পাহাড়ে তিনি যুগের পরিবর্তনগুলো ধারণ করে চীনের উন্নয়নের স্মরণীয় মুহূর্ত রেকর্ড করেছেন।

গরুপালক থেকে শিক্ষিত মানুষ

এসব বাড়িঘর আসলে অনেক বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল। আশেপাশের প্রতিবেশীদের নতুন বাড়িঘরের তুলনায় তা দেখতে কিছুটা জরাজীর্ণ। কেন এটাকে প্রদর্শনী কক্ষ হিসেবে ডাকে? কারণ তা সত্যি অনেক ছোট। মাটি ও কাঠ দিয়ে নির্মিত দুই তলার ছোট বাড়িঘর। প্রথম তলায় সহজভাবে সোফা ও টেবিল রাখা আছে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দু'তলায় এসে দেখা যায় ২০ থেকে ৩০ বর্গমিটারের ঘরে সবই ছবি, হস্তলিপিশিল্প এবং কিছু পুরানো জিনিস, যা যুগের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে পা রাখার জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল।

এটি হল লাউ উ জি গ্রামে সবচেয়ে জনবহুল ও সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা। ২০১১ সালে লাউ ইং শান কয়লা খনির কাজ থেকে অবসর নেন; তারপর বৃদ্ধ কাও এই পারিবারিক প্রদর্শনী কক্ষ স্থাপন করেন। তিনি বলেন, কেউ আমার বাসায় আসলে আমি তাঁকে এই ঘরে নিয়ে যাই, এত বছরে আমার বাড়ি ও গ্রামের পরিবর্তন দেখাই।

লাউ উ জি গ্রামে, কাও হলেন গ্রামবাসীদের দৃষ্টিতে শিক্ষিত একজন মানুষ। অনেক কিছু জানেন ও ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে পারেন। তিনি এলাকার একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি। তবে অনেকেই জানতেন না, তিনি আগে গরুর খামারে কাজ করতেন। ছোটবেলায় কাও-এর বাবা মা মারা যান, পরিবার হঠাত্ চরম দরিদ্রতায় পড়ে। প্রাথমিক স্কুলের প্রথম বর্ষের ক্লাস শেষ না হওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে বাসায় ফিরে যান এবং কৃষিকাজ করা শুরু করেন।

১৯ বছর বয়সে কাও স্থানীয় কয়লা খনিতে একটি চাকরি নেন। তখন নতুন কারখানা নির্মাণের জন্য অনেক মাটির টালি প্রয়োজন হতো। কাও খুব ছোট বলে তাঁকে গরুপালন ও মাটি দিয়ে ছাঁচ তৈরির কাজে নিয়োগ করা হয়। এরপর তিন বছরে কাও দিন-রাত গরুর সঙ্গে থাকতেন। ঠিক এমন সময় তিনি অন্যের পুরোনো প্রাথমিক স্কুলের বইপত্র থেকে গরু লালনপালনের ফাঁকে নিজেই লেখাপড়া শুরু করেন। কলম নেই, কাও ডাল দিয়ে মাটিতে লিখতেন, মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি অনেক কিছু শিখতে পারেন। তা না হলে হয়তো তিনি নিজের নামটিও লিখতে পারতেন না।

১৯৭৫ সালে কাজে ভালো আচরণ করার জন্য কাওকে ওয়েন শান শহরের হাসপাতালে কাজের পাশাপাশি চিকিত্সাপদ্ধতি শেখানো হয়। দুই বছর লেখাপড়া শেষ করে তিনি স্থানীয় লাউ ইং শান কয়লা খনিতে ফিরে অবসর জীবন পর্যন্ত চিকিত্সকের কাজ করেন। কাজ যত ব্যস্ত হোক না কেন, তিনি কখনই লেখাপড়া বন্ধ করেন নি।

অবসরের পর কাও জন্মস্থানে ফিরে যান। গ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে গ্রামের কর্মকর্তাদের কাজের সঙ্গে সহযোগিতা করতেন। লাউ উ জি গ্রামের সিপিসি'র শাখা সম্পাদক চেং মিং নেং বলেন, পথ নির্মাণ থেকে জমি ও পাহাড়ি সীমান্তের ঝামেলা থেকে শুরু করে প্রতিবেশীদের ঝগড়া থেকে দম্পতির দ্বন্দ্ব পর্যন্ত- নানা কাজে কাও সাহায্য করেন। গ্রামে কোনো আনন্দ উদযাপনের কিছু ঘটলে কাও নিজের ক্যামেরা দিয়ে কৃষকদের জন্য সুন্দর মুহূর্তগুলো ধারণ করেন।

এখন গ্রামবাসীদের জীবনযাপনের পরিবেশ অনেক ভালো হয়েছে। কাও অনেক খুশি বোধ করেন। তবে, তিনি লক্ষ্য করেন যে, গ্রামবাসীদের চিন্তাধারা ততটা উন্নত হয় নি। একজন সিপিসি'র সদস্য হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, গ্রামবাসীদের মানসিক জীবন সমৃদ্ধ করায় ভূমিকা রাখবেন। প্রদর্শনী কক্ষ স্থাপন করা হল তাঁরই একটি চেষ্টা। তিনি বিশেষ করে নিজের পুরানো বাড়িতে নিজের টাকা খরচ করে এই প্রদর্শনী কক্ষ স্থাপন করেছেন।

ছোট প্রদর্শনী কক্ষ গ্রামের বিরাট পরিবর্তন তুলে ধরেছে

গ্রামের প্রথম সিপিসির সদস্য, গ্রামের বিরাট পরিবর্তন, গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন কাজ...এই ছোট প্রদর্শনী কক্ষ যেন একটি 'টাইম মেশিনের' মত, লাউ উ জি গ্রামে যুগের তথ্য রেকর্ড করেছে।

গত ১৫ মে, কাও গ্রামের পাশের এক ছোট পাহাড়ের পর্বতে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, এক একটি নতুন বাড়ি খুব সুশৃঙ্খলভাবে তৈরি করা হয়েছে, হলুদ রংয়ের চন্দ্রমল্লিকা আড়ম্বরপূর্ণভাবে ফুটে রয়েছে, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নতুন তৈরি পথ দেখা যাচ্ছে, এই প্রাণচঞ্চল নতুন গ্রামীণ দৃশ্য ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করেছেন কাও।

তবে দশ বছর আগে লাউ উ জি গ্রামের চেহারা ছিল ভিন্ন রকম। প্রদর্শনী কক্ষে ২০১০ সালের বসন্ত উত্সবের সময় তোলা একটি ছবি তখনকার দৃশ্য রেকর্ড করেছে। তখন গ্রামবাসীদের ছিল মাটির বাড়িঘর, বাইরে বৃষ্টি হলে ঘরেও বৃষ্টির পানি পড়ত!

তখন বাড়িঘর ছিল জরাজীর্ণ, পথ ছিল মাটির। কাও বলেন, 'ছোটবেলায় আমি আমার বন্ধুদের বাসায় যেতাম, তখন প্রথমে জুতো হাতে নিতে হতো। তারপর খালি পায়ে বন্ধুর বাসায় পৌঁছে পা পরিষ্কার করে জুতো পরতে হতো। কারণ পথের কাদামাটি আমাদের হাঁটু সমান উঁচু ছিল! প্রতি বছরের জুলাই মাসে বৃষ্টি হলে ঘরে অনেক ঠান্ডা হয়ে যেত, আমরা কাঠের আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরম করতাম।'

পরিবর্তন শুরু হয় ২০১৬ সালে। দারিদ্র্যবিমোচনের নীতির সাহায্যে লাউ উ জি গ্রামে প্রথম পাকা পথ তৈরি হয়; অনেক কৃষক পরিবার সরকারের তৈরি নতুন বাড়িঘরে স্থানান্তরিত হন। এসব পরিবর্তন ছবিতে তুলে ধরেছেন কাও। পথে বাতি লাগানো, কলের পানির পাইপ লাগানোসহ নানা কাজের মুহূর্তের ছবি তুলেছেন কাও। তিনি ছবির মাধ্যমে গ্রামের এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো ধারণ করেছেন।

প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়া করতে পারেন নি, এটাই হলো কাও-এর মনে চিরদিনের দুঃখ। তাঁর ভালোভাবে মনে আছে: ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই, সেদিন থেকে চীনে নয় বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। পরের বছর শিশু দিবসে, কাও বিশেষ করে লাউ উ জি গ্রামের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের একটি গ্রুপ ছবি তুলেছিলেন। এটি পাহাড়ি এলাকার স্কুলের পরিবর্তনের একটি বড় প্রমাণ।

এখন লাউ উ জি গ্রামের সবাই নতুন বাড়িঘরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, গ্রামের সব পথ সিমেন্ট ঢালাই করা, প্রত্যেকের মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি। গ্রামের নিবন্ধিত সব দরিদ্র মানুষ ইতোমধ্যে দারিদ্রমুক্ত হয়েছেন। লাউ উ জি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলও নতুন করে নির্মিত তিন তলা ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে, এ ছাড়া গ্রামে কিন্ডারগার্টেনও স্থাপন করা হয়েছে।

স্কুলের পরিবর্তন শুধুই বিল্ডিং-এর পরিবর্তন নয়। লাউ উ জি গ্রামের সাবেক প্রধান ইয়াও লাই ইয়ুং বলেন, আগে সেখানের লোকজনের জীবন অনেক অনুন্নত ছিল, যথেষ্ঠ খাবার পাওয়া যেত না। তাই, শিশুদের স্কুলে পাঠানোর কোনো চিন্তাও ছিল না। স্কুল খোলার সময় প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে তাদেরকে লেখাপড়া করার গুরুত্ব বোঝানো হত। এখন কৃষকরা সক্রিয়ভাবে স্কুলে এসে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যায়।

কাওয়ের প্রদর্শনী কক্ষে আরো অনেক ছবি আছে। একটি ছবি হল স্থানীয় বৃদ্ধবৃদ্ধাদের পোট্রেইট ছবি। ছবিতে সবার চেহারা ও পোশাক আলাদা হলেও সবার হাসিমুখ দেখা যায়।

বহু বছর ধরে পাহাড়ে বসবাসের কারণে লাউ উ জি গ্রামের বয়স্করা শহরে বা থানায় যায় নি। নিজের জন্য সন্তোষজনক একটি ছবি প্রিন্ট করা খুব কঠিন কাজ। কাও ছবি তুলতে খুব পছন্দ করেন এবং তিনি উষ্ণহৃদয়ের মানুষ, তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামের ৬০ বছরের বেশি বয়সের মানুষদের সবার ছবি তুলে দিয়েছেন তিনি।

ছবি তোলার আগে, কাও তাদের পোশাকে নিজের তৈরি করা একটি সিল্কের লাল ফুল লাগিয়ে দেন। তিনি বলেন, চীনে লাল সিল্কের ফুল গর্বের প্রতীক। এসব বয়স্ক মানুষ সারা জীবন খুব কম ছবিই তুলেছেন। তারা পরিশ্রম করে গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তাদের এ গর্ব ও মর্যাদা দেওয়া উচিত। এ ছাড়া আমি চাই, তরুণ-তরুণীরা চিরদিন এসব সম্মানিত বয়স্কদের চেহারা মনে রাখুক।

কাও-এর কাছে, বয়স্কদের ছবি তোলা নিজের মনের এক দুঃখ পূরণের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তিনি বলেন, তাঁর বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছেন, তাঁর কাছে তাদের কোনো ছবি নেই। বাবা-মার চেহারা তাঁর একদম মনে নেই। আগে আমাদের গ্রামে কোনো বৃদ্ধ মারা গেলে, শেষকৃত্যানুষ্ঠানের কোনো ছবি তোলা হতো না। এটি আত্মীয়স্বজনের মনে চিরদিনের দুঃখ হয়ে থাকত। তাই বয়স্কদের ছবি তোলাই হল আমার বহু বছরের ইচ্ছা।

অবসরের পর থেকে এই পর্যন্ত, কাও পঞ্চাশ জনেরও বেশি বয়স্ক মানুষের ছবি তুলেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির বয়স ১০২ বছর। তিনি বলেন, আমার আর অন্য কোনো সামর্থ্য নেই, তাই আমি তাদের ছবি তুলি। তারা খুশি হলে আমিও খুশি হই। এ কাজ আমি অব্যাহতভাবে করে যাব।

এই গ্রামের মা কুও সিয়াং নামে একজন বৃদ্ধ আছেন, তাঁর বয়স ৭০ বছর। আইডি কার্ডের ছবি ছাড়া তাঁর আর কোনো অন্য ছবি নেই। তিনি ৬৩ বছর বয়সী স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে থাকেন, খুব কমই গ্রামের বাইরে যান।

মার ছবি তোলার দিনে বৃষ্টি পড়ছিল। সাংবাদিক দেখেন যে, কাও ক্যামেরা, ছাতা এবং নিজের তৈরি সিল্কের লাল ফুল হাতে নিয়ে মা-এর বাসায় হাজির। তাঁর বাসায় পৌঁছার পর দেখতে পান যে, মা দম্পতি অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার নতুন কাপড় পরে অপেক্ষা করছেন।

কাওয়ের তোলা ছবিতে দেখা যায়, দম্পতি গায়ে সিল্কের লাল ফুল দিয়ে হাসিমুখে রয়েছেন।

কাও-এর প্রদর্শনী কক্ষের কথা গোটা চীনে ছড়িয়ে পড়েছে। দর্শকের সংখ্যাও বাড়ছে। হৃদরোগের কারণে কাও অস্ত্রোপচার করেন। তাই কাও মাঝে মাঝে পরিবারের সঙ্গে শহরে থাকেন। তবে, তিনি নিজের ফোন নম্বর প্রদর্শনীকক্ষের দরজায় লাগিয়ে রেখেছেন। কেউ দেখতে চাইলে কাও আবারও তিন চার ঘন্টা সময় নিয়ে গ্রামে ফিরে যান ও বিনা খরচে সবার কাছে প্রদর্শনীর বিভিন্ন জিনিস ব্যাখ্যা করেন।

কাও বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে দারিদ্র্যমুক্তি বাস্তবায়ন করেছে; আমাদের জীবন ভালো হয়েছে, আমাদের জন্মস্থানও উন্নত হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের পরিবর্তন দেখে আমি খুব খুশি।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040