জনগণকে কেন্দ্র করে দেশের উন্নয়ন, তাদের ওপর মনোযোগ দেওয়া এবং বাস্তবতা মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হলো নতুন যুগে চীনা চলচ্চিত্রের নতুন বিষয়। চলচ্চিত্র কীভাবে যুগ ও জীবনের সঙ্গে সমন্বিত করা যায়? সম্প্রতি চীনের হ্যনান প্রদেশের চেংচৌ শহরে অনুষ্ঠিত চায়না গোল্ডেন রুস্টার অ্যান্ড হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স ফিল্ম ফেস্টিভালে এ বিষয়টি চীনের চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বাস্তবতার উর্বর মাটিতে চীনা চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ উন্নয়নের গাছপালা বেড়ে উঠছে। চীনের চলচ্চিত্র সমিতির সিপিসি'র শাখা সম্পাদক ও ভাইস চেয়ারম্যান চাং হোং বলেন, চলতি বছর মহামারীর কারণে চলচ্চিত্র মহল তীব্র কঠিন সময়ে প্রবেশ করেছে। তবে সিনেমা হল ধীরে ধীরে খুলে দেওয়ার পর বাজারের উষ্ণতার গতি কল্পনার চেয়ে আরো দ্রুত হয়েছে।
দীর্ঘ সময় হোম-কোয়ারেন্টিন ও একাকী জীবন শেষ করার পর জনগণ সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার প্রত্যাশা করেন। চীনের চলচ্চিত্র তহবিলের চেয়ারম্যান চাং পি মিন মনে করেন, সৃষ্টিশীল ব্যক্তি ও শিল্পীদের আরো নিখুঁতভাবে চিন্তা করা উচিত্, কী ধরনের শিল্পকর্ম দিয়ে আধুনিক সমাজে নিজের দায়িত্ব পালন করা যায়- তা ভেবে বের করা উচিত।
চায়না ফিল্ম কর্পোরেশনের প্রধান ফু রুও ছিং বলেন, সার্বিক সচ্ছল সমাজ গঠন করার জন্য পরিশ্রম করার প্রক্রিয়ায় অথবা, চীনা জনগণের একযোগে মহামারী প্রতিরোধ করার গল্প দারুণ মনোমুগ্ধকর। চীনা গল্পের মাধ্যমে চীনা চেতনা ও চীনা শক্তি তুলে ধরা হলো আধুনিক সমাজে চীনা চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও মিশন।
৯২ বছর বয়সী শিল্পী থিয়েন হুয়া বলেন, 'শিল্প জীবন থেকে এসেছে এবং জনগণ হচ্ছে আমাদের সৃষ্টির উত্স।'
বাস্তবতা হলো, চলচ্চিত্রের চিরন্তন থিম। চীনের চলচ্চিত্র তহবিলের চেয়ারম্যান চাং পি মিন বলেন, চলচ্চিত্র খাতে বড় রাষ্ট্র থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের দিকে চলে যাওয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাস্তবতা-ভিত্তিক শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনা চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম।
গত শতাব্দীর আশির দশকে বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে চীনের বাস্তবতা এবং চীনা জনগণের সত্যিকারের ভাবানুভূতি তুলে ধরে নানা চলচ্চিত্র জন্ম হয়েছিল। এতে চীনা চলচ্চিত্রের শৈল্পিক গুণগতমান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭৮ বছর বয়সী চলচ্চিত্র পরিচালক সিয়ে ফেই বলেন, 'সেই সময়ের উজ্জ্বলতা সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ এবং আদর্শিক মুক্তি বয়ে এনেছিল।' নতুন ঐতিহাসিক মোড়ে সারা বিশ্ব ইন্টারনেটের সঙ্গে চলচ্চিত্র প্রকাশের সমন্বয়ের যুগে প্রবেশ করেছে। চীনের চলচ্চিত্র শিল্পে কীভাবে উজ্জ্বলতা আবার সৃষ্টি করা যায়, তা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের প্রচেষ্টা সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
চলচ্চিত্র সৃষ্টির বাস্তব পদ্ধতি হলো- প্রজন্মের প্রজন্ম ধরে চলচ্চিত্র তৈরির জন্য জীবনভর অনুসন্ধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
চলচ্চিত্র পরিচালক লি শাও হোং বলেন, গত শতাব্দীর আশির দশকে চীনের চলচ্চিত্র খাতে উন্নয়ন গোটা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি উন্নত হয়েছে। অনেক উন্নতমানের ডমেস্টিক চলচ্চিত্র যুগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
লি শাও হোং বলেন, এসব উন্নত শিল্পকর্ম সঠিকভাবে যুগের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত করেছে এবং বিশ্ব ও সমাজের অগ্রসরে অবদান রেখেছে।
বস্তুবাদী চলচ্চিত্র সৃষ্টি প্রসঙ্গে পরিচালক ওয়াং সিও শুয়ে বলেন, চলচ্চিত্র পরিচালক হচ্ছেন গল্প বলা মানুষ। যে বিষয় আমাকে মুগ্ধ করেছে সে বিষয় হলো জনগণের মূল্যবোধের পরিবর্তন ও আন্তরিক ভাবানুভূতি।
ওয়াং সিও শুয়ে বলেন, তিনি যুগের একজন রেকর্ডার হিসেবে কাজ করতে চান। ফাইভ-জি'র যুগে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের প্রযুক্তির সংস্কারে সৃজনশীল প্রবণতার সঙ্গে বাস্তব ঐতিহ্য থাকা উচিত্।
কোন বিষয়টি বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্রের বিষয়? চাইনিজ ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান ইন লি মনে করেন, ভালো বাস্তবসম্মত বিষয় সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও দর্শকদের চিন্তাজগতে আলোড়ন তৈরি করে এবং প্রত্যেকের চিন্তাধারাকে নাড়া দিতে সক্ষম।
ইন লি বলেন, চীনের ৯৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার ভূমিতে ১৪০ কোটি চীনা জনগণ প্রতিদিন চমত্কার জীবন কাটাচ্ছেন। এসব জীবন চলচ্চিত্র সৃষ্টিতে বৈচিত্র্যময় উপাদান সরবরাহ করে। একই রকম আবেদন তৈরি করা হলো বাস্তবসম্মত চলচ্চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় শক্তি। আমরা দর্শকদেরকে বোঝাতে চাই যে, তাদের জীবন আসলেই শিল্প।
বাস্তব জীবন থেকেই আমরা শক্তি পেতে পারি। 'Coffee or Tea?' নামে চলচ্চিত্রের পরিচালক সুই হোং ইউ এ কথাই বলছিলেন। তাঁর এ চলচ্চিত্রটি এবারের চায়না গোল্ডেন রুস্টার অ্যান্ড হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চেংচৌ শহরে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুই হোং ইউ বাস্তব জীবন তুলে ধরার মতো বিষয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। 'Coffee or Tea?' নামে তাঁর এ চলচ্চিত্রে তিন তরুণের বড় শহর থেকে ইউননান প্রদেশের প্রাচীন গ্রামে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করার গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশে 'সপ্তম রেশমপথ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের' ওপর দৃষ্টি দেবো।
১১ থেকে ১৬ অক্টোবর 'সপ্তম রেশমপথ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সব চীনের' শ্যানসি প্রদেশের সি'আন শহরে অনুষ্ঠিত হয়। 'এক অঞ্চল, এক পথের' পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে চলচ্চিত্রের বিনিময় দিন দিন বাড়ছে। দেশগুলোর মধ্যে ফিচার ফিল্ম, তথ্যচিত্র ও কার্টুন চলচ্চিত্র খাতে সহযোগিতা হয়েছে। চলচ্চিত্র যেন এসব দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দূত হয়ে উঠেছে।
'Yellow Cat' নামের চলচ্চিত্রটি কাজাখস্তান এবং ফ্রান্সের যৌথ সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি, 'sunless shadows' নামে ইরান ও নরওয়ের সহযোগিতায় তৈরি একটি চলচ্চিত্র এবং 'Persian Lessons' নামে জার্মানি ও রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মিত চলচ্চিত্রসহ ১৬টি চলচ্চিত্র 'বিশেষ সুপারিশ চলচ্চিত্র তালিকায়' অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ১৬টি চলচ্চিত্র বিভিন্ন দেশের পেশাগত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের উদ্যোগে ১১৬টি দেশ ও অঞ্চলের ৩৫০০টিরও বেশি শিল্পকর্ম থেকে বাছাই করা হয়েছে।
ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং অস্কার পুরস্কারে দু'বার শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার পুরস্কারজয়ী আসঘার ফারহাদি হচ্ছেন চলচ্চিত্র উত্সবের শৈল্পিক পরিচালক। তিনি অনলাইনে এসব চলচ্চিত্র বাছাই করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটসম্পন্ন চলচ্চিত্রগুলো চলচ্চিত্র উত্সবের কারণে জড়ো হয়েছে। এতে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য দেখা যায়।
মহামারীর কারণে এবারের চলচ্চিত্র উত্সবে আমন্ত্রিত বিদেশের চলচ্চিত্র মহলের পেশাগত লোকেরা অনলাইনে এতে অংশ নেন। এতে তাদের অংশগ্রহণের আগ্রহ একেবারেই কমেনি। পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র পরিচালক মালগোর্জাতা স্মোভস্কা বলেন, আমি দু'সপ্তাহ ধরে এসব চলচ্চিত্র উপভোগ করেছি। এর থিম অনেক বৈচিত্র্যময় এবং বৈশিষ্ট্যও সুস্পষ্ট।
চীন ও ইতালি বহুবার যৌথ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে এবং চলচ্চিত্র আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। 'Caffè' নামে ইতালি, চীন ও বেলজিয়ামের সহযোগিতায় তৈরি চলচ্চিত্রটিতে কফি-কে কেন্দ্র করে তিনটি দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ভাবানুভূতি তুলে ধরা হয়েছে।
ইতালির মুভি অডিওভিজুয়াল ও মাল্টি-মিডিয়া শিল্প সমিতির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রোবার্ট স্তাবিল বলেন, চলচ্চিত্র হলো সহযোগিতার সেতু। চীনে অনলাইনে প্রদর্শনের জন্য ইতালির বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র বাছাই করেছি আমরা। ইতালিতে আরো বেশি চীনা চলচ্চিত্রের প্রদর্শন করতে চাই আমরা।
চলচ্চিত্র উত্সব দেশি-বিদেশি পেশাগত লোকদের বিনিময়ের প্লাটফর্ম নয়, বরং এটি সাধারণ দর্শকদের জন্য 'এক অঞ্চল, এক পথের' পার্শ্ববর্তী দেশ ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এবারের চলচ্চিত্র উত্সব প্রদর্শনের অংশে পাঁচ শতাধিক দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র খোলা জায়গায়, সিনেমা হলে ও অনলাইনে প্রদর্শিত হয়েছে। এসবের মধ্যে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১০২টি এবং ৭০ শতাংশেরও বেশি 'এক অঞ্চল, এক পথের' পার্শ্ববর্তী দেশ ও অঞ্চল থেকে এসেছে।
চীনের মতো চলতি বছর বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের বাজার নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই চলচ্চিত্র মহলের অনেকেই সহযোগিতার মাধ্যমে এ শিল্পের রূপান্তর ও উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে চান। সিঙ্গাপুরের চলচ্চিত্র কমিটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হুয়াং রু ছিন বলেন, সিঙ্গাপুর চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র খাতে মেধাবীদের বিনিময় জোরদার করবে। সহযোগিতার মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতিতে যৌথভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা করেন তারা।