গত সপ্তাহে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুটি খবর গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে। এর প্রথমটি হলো চীনের রাষ্ট্রদূত লি চি মিংয়ের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। আর দ্বিতীয়টি হলো যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। দুটি ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পেয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু। আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা নজর দেব এ সব বিষয়ের দিকে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি চি মিং ১১ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন না হলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। এ ব্যাপারে বন্ধু্প্রতীম চীনের সহযোগিতা কামনা করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে কাঁটা তারের বেড়া না থাকায় অপরাধ বাড়ছে বলে জানান তিনি। এছাড়া সম্প্রতি সীমান্তে মিয়ানমার সৈন্য সমাবেশ করায় বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জবাবে লি চি মিং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনো শুরু না হওয়ায় পেইচিংয়ের উদ্বেগের কথা জানান। চীন সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যয়সঙ্গত সমাধান চায় জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, শিগগির এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেবে পেইচিং।
এদিকে, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান। সফরকালে তিনি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সবক্ষেত্রেই আলোচনায় ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু।
১৪ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের পর তার দেশ মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরো চাপ দেবে। করোনা সঙ্কট মোকাবেলা এবং এ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেন মার্কিন মন্ত্রী। ১৫ অক্টোবর মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে। সেই বৈঠকেও তিনি জানান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার দেশ সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে। তবে এর স্থায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উদ্যোগকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মার্কিন মন্ত্রী।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকবে বাংলাদেশ- এমন কথাও সাংবাদিকদের জানান স্টিফেন ই বিগান। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরী অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বললেও এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ, উন্নয়ন, বাংলাদেশি ছাত্রদের ভিসাসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান আব্দুল মোমেন।
একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাতেরও মূল আলোচ্য ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। মার্কিন মন্ত্রী এ সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রও চায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বন্ধুপ্রতীম চীনের। বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রও ভূমিকা রাখতে পারে এ ইস্যুতে। দুদেশই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও এ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান চায়। তবে দুদেশের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। চীন চায় বাংলাদেশ ও
মিয়ানমার মূলত দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করুক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উদ্যোগকে গুরুত্ব দেয়।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে- এ কথা সর্বজনবিদিত। চীন সে উদ্যোগ নিয়েছেও। এর আগেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করেছে পেইচিং। শিগগিরই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে চীন দ্বিতীয় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতে চায়। চীনা রাষ্ট্রদূত লি চি মিং আগেই তা নিশ্চিত করেছেন।
দ্বিপক্ষীয়-ত্রিপক্ষীয় কিংবা বৈশ্বিক উদ্যোগে- যাই হোক না কেন- বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হোক আর রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।