চলুন বেড়িয়ে আসি: তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল
  2020-10-16 16:46:51  cri

ইউরোপের পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত তুরস্কের ইস্তাম্বুল  পর্যটকদের জন্য একটি স্বপ্নের গন্তব্য। দুই মহাদেশকে সংযোগকারী এই শহরের প্রতিটা স্থাপত্য থেকে শুরু করে খাবারের মাঝেও লুকিয়ে আছে অনেক জানা অজানা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ব্যস্ত এই শহরের প্রাণবন্ত জীবন থেকে বিরতির জন্য রয়েছে বিভিন্ন টুরিস্ট স্পট যা নিমিষেই শরীর ও মনকে শান্ত করে দেয়। তুরস্ক (Turkey) ভ্রমণ করলে "সুলতান সুলেমান" খ্যাত এই শহরে অবশ্যই ঘুরে আসা উচিৎ।

ইস্তানবুলে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়

ইস্তাবুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে জুন থেকে অগাস্ট হল পিক সিজন আর তাই এই সময় এড়িয়ে শরত ও বসন্তকাল হিসেবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর ও মার্চ থেকে মে-এই সময়ের যেকোনো সময় ঘুরে আসতে পারেন এই শহর থেকে। এই দুই সময়েই আবহাওয়া অনেক সুন্দর থাকে আর পর্যটকদের ভিড়ও কিছুটা কম থাকে।

ইস্তানবুলের দর্শনীয় স্থান

ইস্তানবুলে অটোম্যান ও রোমানদের নির্মিত বিখ্যাত মসজিদ, প্রাচীন কিছু ধ্বংসাবশেষ সহও আরও অনেক নিদর্শন আছে দেখার মত। যত ঘুরবেন তত মুগ্ধ হবেন এই শহরের নানা রূপে। ৭-৮ দিনের মতো সময় হাতে নিয়ে আসলে সবচেয়ে ভালো ভাবে ঘুরতে পারবেন এই শহর। পর্যটকদের জন্য কিছু বিশেষ জায়গা সংক্ষিপ্ত বিবরণ সহ তুলে ধরা হল-

সুলেমানিয়া মসজিদ : তুরস্কের সবচেয়ে বড় ও সুন্দর মসজিদের মধ্যে এই মসজিদটি উল্লেখযোগ্য। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাতটি পাহাড়ের উপর একটি সুন্দর মুকুট। বিশাল জায়গা নিয়ে বানানো কমপ্লেক্সের মতো এই মসজিদের প্রাচীন অনেক ভবন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং বর্তমানে পুনঃব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে। এখানে মসজিদের সাথে সাথে হাম্মাম খানা (গোছলখানা) , হাসপাতাল ও সুলেয়মানিয়ের সমাধি দেখতে পারবেন।

হাজিয়া সোফিয়া  : ইস্তানবুলের কিছু বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে এই প্রাচীন স্তম্ভটি বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ। মহান সম্রাট বিজ্যান্টাইন অনুমোদিত এই ভবন ৫৩৭ সাল পর্যন্ত চার্চ হিসেবে পরিচিত ছিল পরবর্তীতে ১৪৫৩ সালে সুলতানের নির্দেশে এই চার্চ মসজিদে রূপান্তরিত হয়। তারপর ১৯৩৫ সালে এই ভবনের স্থাপত্য শিল্প, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ধর্মীয় গুরত্ব ও অসাধারন সৌন্দর্যের জন্য কামাল আতাতুর্ক এই মসজিদকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন। এই পুরো ভবনটি পর্যটকদের দেখার জন্য তিন ভাগে বিভক্ত-নিচের তালা, উপরের তালার গ্যালারি ও বাইরের ভবন। নিচের তালা মূলত এই জাদুঘরের প্রধান ভবন। এখানের ডোম, বড় একটি গির্জার প্রধান অংশ ও সোনার মোজাইক পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। বাইরের ভবনে সুলতান সুলেমানের স্ত্রী হুররামের স্নানাগার চোখে পড়বে।

টপকাপি প্যালেস  : বর্তমানের ক্রেজ সিরিয়াল "সুলতান সুলেমান" এর সুলতানের বাসভবন ছিল এই প্যালেস। ১৪৬১ সাল পর্যন্ত পরিবার সহ সুলতান এখানে বসবাস করতো পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর পর বসফরাসের উপকূলের বাড়িতে তারা স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এই প্যালেসের সৌন্দর্য আমরা টিভিতেই দেখে মুগ্ধ হই আর বাস্তবে কতটা সুন্দর তা হয়তো কেউ না গেলে বুঝতে পারবে না। চারটি ভাগে বিভক্ত এই ভবনের প্রথম ভাগে প্যারেড কোর্ট ও আয়া ইরানি নামের এক গির্জা চোখে পড়বে। দ্বিতীয় ভাগে বসার জন্য সুন্দর একটি পার্ক আছে যেখানে সুলতানের আমলে শুধু সুলতান ও তার মায়ের প্রবেশাধিকার ছিল।

টপকাপি প্যালেজ, ইস্তাম্বুল

এছাড়াও এখানে কিছু প্যাভিলিয়ন, রাজকীয় কিচেন, বড় কিছু হল রুম, বিচার কক্ষ ও সুলতানদের শয়নকক্ষ নজরে পড়বে। আর "হারেম" নামের বিশেষ একটা জায়গা আছে এখানে, যার জন্য আলাদা করে টিকেট কাটতে হয়। বলা হয়ে থাকে এই হারেমে সুলতান নিজের ইচ্ছেমত যাবতীয় ব্যভিচারমূলক কাজ করতে পারতো। তৃতীয় ভাগে সুলতানের রাজকীয় ট্রেজারি ও সভা কক্ষ আছে। চতুর্থ ভাগে সুলতানের বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে বাগান, পুল ও টেরেস চোখে পড়বে। সুলতান সুলেমান পবিত্র কাবা শরিফের সংস্কার করেছিলেন তাই সেই সময়ের কাবা শরিফের অংশ ও চাবি এই প্যালেসের সংগ্রহ শালায় আছে। এছাড়াও এখানে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর দন্ত মবারক, পা' এর ছাপ, হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) এর ব্যবহৃত জামা ও সাহাবিদের তলোবারি সংরক্ষিত রয়েছে।

বেসিলিকা সিস্টার্ন : এই সিস্টার্ন বা জলাধারটি মূলত গ্রেট প্যালেস ও তার আশে পাশের ভবনের পানি সরবারাহের জন্য বানানো হয়েছিল। তবে যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে একসময় ময়লার স্তুপ জমে গেলেও পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ইস্তাম্বুল মেট্রোপলিটন এই জলাধারটি পরিষ্কার করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা এই জলাধার বর্তমানে শহরের একটি বিশেষ টুরিস্ট স্পট হিসেবে গণ্য করা হয়।

ব্লু মসজিদ: ইস্তানবুলের বিশেষ কিছু ভবনের মধ্যে অন্যতম এই ভবন। সুলতান আহমেদ ১ এর আমলে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয় যার সমাধি এই মসজিদের উত্তর পাশে অবস্থিত। এই মসজিদের গম্বুজ ও ছয়টি মিনার পর্যটকদের নজরে পরার মতো। নীল রঙের নকশা করা টাইলস এক ভিন্নমাত্রার সৌন্দর্য যোগ করছে এই মসজিদে।

পেরা মিউজিয়াম  : সুইস ব্রিস্টল হোটেলে অবস্থিত এই জাদুঘর তুর্কিশ শিল্পের এক নিদর্শন। এই জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় তুর্কিশ শিল্পীদের বিভিন্ন আর্ট পর্যটকদের মুগ্ধ করার মতো। তুর্কিশ শিল্পী সুনা ও ইয়ান কাইরাসের ব্যাক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে অনেক ছবি এখানে স্থান পেয়েছে। মূলত এই চিত্রশিল্প গুলো ১৭ থেকে ২০ শতাব্দীরমধ্যেরসময়ে আঁকা। আর এখানের অন্যান্য ফ্লোরে সাধারনত অস্থায়ী চিত্র প্রদর্শনী হয়ে থাকে। মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত, শনিবার রাত ১০ টা পর্যন্ত, শুক্র ও রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬ তা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। এই জাদুঘরের পাশেই আছে ইস্তাম্বুল রিসার্চ ইন্সটিটিউট যেখানে রিসার্চ লাইব্রেরি ও অস্থায়ী প্রদর্শনী স্থান রয়েছে।

গ্র্যান্ড বাজার : রঙ্গিন ও ব্যস্ততম এই বাজার শত বর্ষ ধরে ইস্তাম্বুল শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সবার কাছে। ১৪৬১ সালে সুলতানের নির্দেশে নির্মিত এই বাজার শুরুতে ছোট্ট একটি গুদাম ঘর ছিল আর এখন আশেপাশের অনেক দোকান ও রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এখানে প্রধান প্রবেশদ্বারের রাস্তা দিয়ে হাঁটলে প্রাচীন আমলের বেশ কিছু পান্থশালা নজরে পড়বে যেখানে কারিগরের সূক্ষ্ম কাজ দেখতে পাবেন। সোম থেকে শনিবার সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত খোলা থাকলেও ৬টার পর এখানে আর প্রবেশের অনুমতি নেই। তাই ৬ টার আগে যেকোনো সময় ঘুরে আসতে পারবেন এই বাজার থেকে।

কিছু টিপস

এখানে ইস্তাম্বুল কার্ড নামে একটি ট্রান্সপোর্ট কার্ড পাওয়া যায় টুরিস্টদের জন্য। সেই ক্ষেত্রে এই কার্ড দেখিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ঘুরতে খরচ অনেক কম হবে।

এখানে হেঁটে হেঁটে শহর ঘুরে দেখলে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হবে।

ট্যাক্সি তে উঠলে মিটার চালু আছে কিনা চেক করে নিবেন, মিটার ছাড়া দামাদামি করে ট্যাক্সিতে উঠবেন না।

প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০ তা পর্যন্ত কোনও টিকেট ও ফি ছাড়াই ঘুরতে পারবেন পেরা মিউজিয়ামে।

গ্র্যান্ড বাজারে অন্তত তিনঘণ্টা সময় নিয়ে আসলে ভালো ভাবে ঘুরে দেখতে পারবেন। আর লোকাল দোকানগুলোতে দাম গ্র্যান্ড বাজারের চেয়ে কম।

দা বসফরাস স্ট্রেইটের উস্কুদার (Uskudar) থেকে সূর্যাস্ত দেখার দৃশ্য মিস করবেন না।

মুসলিম দেশ হিসেবে এখানে বেশ কিছু নিয়ম কানুন আছে তাই পর্যটক হিসেবে সেই নিয়ম কানুন মেনে চলার সাথে সাথে নিজেদের আচরণ ও পোশাকের ব্যাপারে সংযত থাকার চেষ্টা করবেন।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040