১-৮ অক্টোবর চীনে টানা ৮ দিনের জাতীয় ছুটি ছিল। এই ৮ দিনে ৬০ কোটি চীনা মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করেছেন। এ সময় পর্যটন খাতে আয় সাড়ে ৪৬৬ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। এসময় দেশে খুচরো পণ্য ও ক্যাটারিং কোম্পানির সেবা বিক্রয় হয় ১.৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ানের। এ থেকে বোঝা যায়, মহামারি নিয়ন্ত্রণ করে চীন তার অর্থনীতিকে সাফল্যের সঙ্গেই পুনরুদ্ধার করতে পারছে।
চলতি বছরের পয়লা অক্টোবর যেমন চীনের জাতীয় দিবস ছিল, তেমনি ছিল চীনের ঐতিহ্যিক মধ্য-শরত্ উত্সব। তাই এবারের ছুটির মাহাত্ম্যও ছিল অন্যরকম। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি এখনও ছড়িয়ে পড়ছে, বিশ্ব অর্থনীতি পড়েছে মন্দাবস্থায়। তবে, চীনের জাতীয় দিবসের 'গোল্ডেন সপ্তাহ' ছুটি থেকে আমরা কিছু সম্ভাবনা ও আশার আলো দেখতে পারছি।
এ ছুটিতে বিমানপথ, দ্রুতগতির রেলপথ ও সড়কপথে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষ। তাদের মূল গন্তব্যস্থান ছিল বাড়ি। বেইজিংয়ে কাজ করেন ম্যাডাম শেন। তার হোমটাউন হুপেই প্রদেশের সিয়াং ইয়াং শহরে। তিনি প্রায় এক বছর ধরে হোমটাউনে ফিরতে পারেননি, মহামারির কারণে। এবার ছুটিতে তিনি হুপেই প্রদেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, মনের আনন্দ কথার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মহামারির কারণে অনেক মানুষ ম্যাডাম শেনের মতো দীর্ঘসময় ধরে হোমটাউনে ফিরতে পারেননি। চলতি বছরের শুরুতে যখন মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তখন ছিল চীনের বসন্ত উত্সবের সময়। অনেক মানুষ বাড়িতে ফেরা বা ভ্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। অনেকে আবার তখন থেকেই ফ্রন্টলাইনে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তাদের জন্য এবারের জাতীয় দিবসের ছুটি যেন দেরিতে আসা বসন্ত উত্সবের ছুটি!
মহামারি চীনে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অর্থনীতিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। চীন আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। পয়লা অক্টোবর কুয়াং চৌ নান রেল স্টেশনে যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩৭ হাজার। গত ১০ বছরে এ স্টেশনে একদিনে এতো বেশি যাত্রী আগে কখনও দেখা যায়নি। ছুটির প্রথম ৬ দিনে কুয়াং তুং প্রদেশের ১৫০টি দর্শনীয় স্থানে পর্যটকের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যায় এবং শাংহাই শহরে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৬৫ লাখ, যা ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় বেশি।
চীনের পরিবহন বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১-৮ অক্টোবর চীনের রেলপথ, সড়কপথ, নৌপথ ও বিমানপথে দৈনিক গড় যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২১ লাখ ১৫ হাজার। বিমানবন্দর ও হাইস্পিড ট্রেন স্টেশনে সব যাত্রীকে মাস্ক পরতে দেখা গেছে। তারা সবাই সুশৃঙ্খলভাবে বিমান বা ট্রেনে উঠেছেন ও নেমেছেন। কোটি কোটি মানুষের এমন অবাধ যাতায়াত ১৪০ কোটি চীনা মানুষের যৌথ প্রচেষ্টার ফল। চীনের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটন কার্যক্রম চলেছে, ভোক্তাদের কেনাকাটা বেড়েছে, আবার মহামারি-বিরোধী কঠোর ব্যবস্থাও সমানতালে কার্যকর থেকেছে। জাতীয় দিবসের লম্বা ছুটিতে কোটি কোটি মানুষের নিরাপদ যাতায়ত আবার প্রমাণ করেছে যে, মহামারি প্রতিরোধ এবং অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে চীনের দক্ষতা আছে। মার্কিন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা চীনের জাতীয় দিবসের ছুটির 'গোল্ডেন সপ্তাহ' সম্পর্কে বলেছে, চীন আশ্চর্যজনকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে।
জাতীয় দিবসের ছুটিতে ইয়াং মেই নামের একটি প্রাচীন নগরে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। স্থানীয় বাসিন্দা তু পাং ছুয়ান একটি কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান খুলেছেন এবং ছুটির সময়ে তার ব্যবসা ভাল হয়েছে। দোকানে ৩০ আসনও এসময় যথেষ্ট ছিল না। তিনি জানান, ছুটির সময় তার আয় ১০ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে। অন্যদিকে, চিয়াং সি প্রদেশ থেকে আসা মিঃ দু তার পরিবার নিয়ে বেইজিং ভ্রমণ করেন। তারা একটি টাইম-অর্নার রেঁস্তোরার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। রেঁস্তোরার ম্যানেজার জানিয়েছেন, ছুটির সময়ে রেঁস্তোরার আয় গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। মহামারি শুরুর পর এবারই তার আয় বেড়েছে। তিনি বলেন, 'এটা ভাল একটি প্রবণতা এবং বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে ব্যবসা আরও ভাল হবে।'
মহামারিতে চাপা ছিল ভোক্তাদের চাহিদা। এবার ছুটির সময়ে এ চাহিদা মুক্তি পায়। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১-৮ অক্টোবর চীনের প্রধান খুচরা বিক্রি এবং ক্যাটারিং কোম্পানিগুলোর সেবা বিক্রয়ের পরিমাণ ২০১৯ সালের জাতীয় দিবসের ছুটির তুলনায় ৪.৯ শতাংশ বেশি ছিল। চলচ্চিত্র, প্রদর্শনী ও শো দেখে এবং জিমে যাওয়া ছিল এবার চীনা মানুষের ছুটি কাটানোর নতুন পদ্ধতি। এবার ১-৭ অক্টোবর মুভি বক্স অফিস ৩৭০ কোটি ইউয়ান আয় করে, যা জাতীয় দিবসের ছুটির সময়ের নতুন রেকর্ড।
চীনের অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এবারের ছুটির সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে। চীনের অর্থনীতি মহামারির চাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এবং মহামরি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ নানা ক্ষেত্রে চীন নিজেকে এগিয়ে নিয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ পূর্বাভাস প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর চীনের অর্থনীতি ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যা জুন মাসের পূর্বাভাসের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি। জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন অধিবেশন সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৪.৩ শতাংশ হ্রাস পাবে; তবে চীনের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন অধিবেশনের জনৈক কর্মকর্তা বলেন, চীনের সরকার দেশের অর্থনীতির পুরুদ্ধারে নানান নীতি গ্রহণ করতে পারবে এবং তা বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে।
স্পেনের 'লা মন্ডে' পত্রিকায় সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল: 'করোনাভাইরাসামুক্ত চীনে ৬০ কোটি মানুষের ভ্রমণ ও জাতীয় দিবসের ছুটি উদ্যাপন'। প্রবন্ধে বলা হয়, মহামারিতে যখন অন্যান্য বড় দেশগুলো কাবু, তখন চীনে দেখা যাচ্ছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রবণতা।
মহামারির পর চীনারা আরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করছে এবং বিশ্বের সামনে সমৃদ্ধ ও উন্নয়নের দৃশ্য তুলে ধরছে। দু'বছরের নির্মাণকাজ শেষে সম্প্রতি কুয়াং চৌ শহরের একটি হাঁটারাস্তা জাতীয় দিবসের ছুটিতে চালু হয় এবং প্রথম দিনেই ৪ লাখের বেশি পর্যটককে আকর্ষণ করে।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, হাই নান প্রদেশের শুল্ক মুক্ত শপিং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জাতীয় দিবসের ছুটির ৭ দিনে হাই খৌ, সান ইয়া ও ছুং হাইসহ ৪টি এলাকার শুল্কমুক্ত দোকানের খুচরা বিক্রয়ের পরিমাণ ও ভোক্তাদের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ১৬৭ শতাংশ ও ৬৪ শতাংশ বেশি ছিল।
অনলাইন কেনাকাটা, অনলাইনে খাবার অর্ডার ও কাস্টমাইজড ভ্রমণসহ নানান নতুন ধরনের ভোগের পদ্ধতিও উন্নত হচ্ছে চীনে। পাশাপাশি চীনে চালু হয়েছে খাবার সাশ্রয় কার্যক্রম। চে চিয়াং প্রদেশের চিয়ান ত্য শহরের একটি রেঁস্তোরা বিশেষ একটি নীতি চালু করেছে। গ্রাহক যদি কোনো খাবার অপচয় না-করেন, তবে তিনি ১০ শতাংশ ডিস্ককাউন্ট পাবেন। নিজের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে খাবার অর্ডার করা এখন চীনে নতুন প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। পর্যটন শিল্প পুনরুদ্ধার দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমেও অবদান রাখছে। যারা গ্রামীণ পর্যটনের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত হন, তারাও আবার ব্যবসার সুযোগ পাচ্ছেন। মানুষের জীবন মহামারির আগের মতো চলছে, এমনকি আরও ভাল এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। (শিশির/আলিম/রুবি)