বিদ্যাবার্তা ১০১২
  2020-10-12 17:34:36  cri

 


চীনের ইয়ুননান প্রদেশ একটি সংখ্যালঘু জাতির বসবাস এলাকা, বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির মানুষ এখানে জীবনযাপন করেন। প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে ইয়ুননান প্রদেশের সংখ্যালঘু জাতির মানুষদের অনেকে দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলে থাকেন। তাই অতীতে স্থানীয় বাচ্চাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেক দূরের পথ হেঁটে স্কুলে পৌঁছতে হতো। এতে অনেক বাচ্চাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিতও থাকতো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয় চীন সরকার। আর এতে স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের কর্মীদের যৌথ প্রয়াসে এখন ইয়ুননান প্রদেশের দরিদ্র এলাকাগুলোতে শিক্ষাবঞ্চিত বাচ্চার সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। আজকের আসরে স্থানীয় বাচ্চাদের শিক্ষাগ্রহণ সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনে বাধ্যতামূলক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ লাখ থেকে ২৪১৯ জনে নেমে আসে। আর দরিদ্র পরিবারে নিবন্ধিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২ লাখ থেকে নেমে আসে শূন্যে। সম্প্রতি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

এ তথ্য দেখে ইয়ুননান প্রদেশের ফুকুং জেলার এক স্কুলের প্রেসিডেন্ট জি ইউয়ে ফাং বলেন, "আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। ফুকুং জেলা নুচিয়াং গিরিখাতের মাঝখানে অবস্থিত। এটা চীনের দূরবর্তী দরিদ্র এলাকাগুলোর অন্যতম। এখানকার উঁচু পাহাড় ও গিরিখাতের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি সুন্দর, তবে বসবাস এলাকা থেকে স্কুলে যাওয়ার পথ অনেক জটিল। তাই স্থানীয় শিশুদের অনেকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। স্থানীয় শিক্ষক, গ্রামের কর্মকর্তা ও দারিদ্র্যবিমোচন কর্মদলের কর্মীদের বিভিন্ন পরিবারে গিয়ে বাচ্চাদের শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হয়।"

বাচ্চাদের পিতামাতাদের সাথে পরামর্শকালে ৬০ বছর বয়সী স্কুলের প্রেসিডেন্ট ই জাতির জি ইউয়ে ফাং বলেন, 'স্বল্পকালীন দারিদ্র্যবিমোচন চাকরি নেওয়ার মাধ্যমে, শিল্প উন্নয়ন করে আরো বেশি সময় সুখী জীবন কাটানো সম্ভব। তবে দীর্ঘকালের মতো দারিদ্র্যবিমোচন বাস্তবায়ন করতে চাইলে শিক্ষাকে নির্ভর করতে হবে।' তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পারেন যে, দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য শিক্ষাগ্রহণ একটি সহজ ব্যাপার নয়।

জনাব জি'র কর্মজীবনে ছাত্রছাত্রীদের গুরুত্ব অনেক। ২১ সেপ্টেম্বর আরও দু'জন ছাত্র দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্কুলের পড়াশোনায় ফিরে আসে। এ খবর জনাব জি'র জন্য অতি আনন্দদায়ক। দু'জন ছাত্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দু'জন ছাত্রের মধ্যে একজনের পরিবার বহু দূরের পাহাড়াঞ্চলে থাকে। তার বাবা-মা মনে করেন, শিক্ষাদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই তারা পড়াশোনায় সমর্থন দিতেন না। পরে গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন সহায়কদল তাদের সঙ্গে দেখা করে ও পরামর্শ দেয়। ফলে অবশেষে এ বাচ্চা স্কুলে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। আরেকজন ছাত্রের পরিবারের ৮ জন ভাই-বোন রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

ফুকুং জেলা চীনের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। স্থানীয় দরিদ্র লোকসংখ্যা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে একটু বেশি। ফলে বাচ্চাদের পিতা-মাতারা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন না। অনেক বাচ্চাও লেখাপড়া করতে আগ্রহী নয়। প্রত্যেক বাচ্চার শিক্ষাগ্রহণ নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষকরা, স্কুলের প্রেসিডেন্ট, জেলা ও গ্রামের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাবৃন্দ, শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ স্কুলবঞ্চিত বাচ্চাদের ক্লাসের ফিরিয়ে আনতে যৌথ প্রচেষ্টা চালান।

কয়েক বছর আগে ছাত্রী ইয়ান পিং না ছুটির পর আর স্কুলে ফিরে আসেনি। তখন প্রেসিডেন্ট জি সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসারকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কয়েক শ কিলোমিটারের যাত্রার পর অবশেষে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায়। পরে জানা গেল যে, মেয়ে ইয়ান পিং না'র বাড়ি দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলে। একদিন সে মোটরগাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে তার পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থের অভাবে সে হাসপাতালেও যেতে পারেনি। তার পায়ের অবস্থা দিন দিন গুরুতর হতে থাকে। তখন প্রেসিডেন্ট জি গাড়িতে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসেন এবং পরে তাকে চিকিত্সার জন্য হাসপাতালে পাঠান।

অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া সমর্থন করেন না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পরামর্শ দিতে হয়, পদক্ষেপ নিতে হয়। এ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জি বলেন, গত বছর তাদের জেলায় একজন ছাত্র পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে স্কুল থেকে বঞ্চিত হয়। তার বাবা-মা তার স্কুলে ফেরার ব্যাপারে রাজি নন। তখন জেলার বিভিন্ন পর্যায় ও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা তার বাবা-মাকে পরামর্শ দেন এবং আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে তার স্কুলে ফেরা নিশ্চিত করেন।

চলতি বছরের ২০ মে ইয়ুননান প্রদেশের নিংলাং জেলার আদালতে স্থানীয় সিয়াওলিয়াংশান স্কুলের কর্তৃপক্ষ একজন ছাত্রীর পিতামাতার বিরুদ্ধে মামলা করে। কারণ, এ পরিবারের মেয়ের বয়স ১৫ বছর; তার বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু তার বাবা-মা মেয়ের পড়াশোনা সমর্থন করেন না। সে মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর লেখাপড়া ছেড়ে চাকরি নেয়। স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা বহুবার তার বাড়িতে যান এবং বাবা-মাকে পরামর্শ দেন। কিন্তু আর্থিক অবস্থার অজুহাতে তার বাবা-মা রাজি হননি। ফলে বিষয়টি স্থানীয় আদালতে গড়ায়। বিচারক তার বাবা-মাকে জানান যে, বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানে বাধা দেওয়া অবৈধ। তাই মেয়ে যদি স্কুলে ফিরে যেতে না-পারে, তবে তাদেরকে আইনানুগ শাস্তি পেতে হবে।

এমন ঘটনা মাঝে মাঝে ইয়ুননান প্রদেশে ঘটে। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে লানপিং জেলার বাই জাতির অধ্যুষিত এলাকার লাচিং উপজেলায় ৫টি পরিবারের পিতা-মাতারা সংশ্লিষ্ট বাচ্চাদের শিক্ষাগ্রহণে বাধা দেন। এতে মামলা হয়। পরে ৫টি পরিবারের সকল বাচ্চা স্কুলে ফিরে যায়। এখন জেলায় কোনো স্কুলবঞ্চিত শিশু নেই। ৫ বছর আগে এ জেলায় শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা ছিল ২০১ জন। এখন সে সংখ্যা শূন্য।

শুধু স্কুলে পড়াশোনা নয়, বরং ভালোভাবে শিখতে হবে। ১২ সেপ্টেম্বর ইয়ুননান প্রদেশের লানপিং জেলায় ৩ নম্বর প্রাথমিক স্কুলে বাই জাতির মেয়ে ফেং ই অনলাইন লাইভ ক্লাসে অংশ নেয়। বেইজিংয়ের একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক এ ক্লাস পরিচালনা করেন। বেইজিংয়ের শিক্ষক সুং লোকশিল্পের ওপর আলোচনা করেন এবং অনেক সুন্দর সংগীতের সুর ও গীত গেয়ে শোনান। চলতি বছরের মে মাসে ইয়ুননানের এই প্রাথমিক স্কুল বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্কুলের সাথে মৈত্রী বান্ধব সম্পর্ক স্থাপন করে। তখন থেকে ইয়ুননানের ছাত্রছাত্রীরা অনলাইনে বেইজিংয়ের শিক্ষকদের ক্লাস করতে পারছে।

গত কয়েক দিনে বেইজিংয়ের প্রাথমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট ম্যাডাম চেং রুই ফাং ইয়ুননানের এই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়তা দিয়েছেন। এ স্কুল ঘুরে দেখার পর তিনি সংশ্লিষ্ট সহায়ক পরামর্শ দেন। এখানকার অবকাঠামো বেইজিংয়ের সাথে তুলনা করলে বেশি পার্থক্য নেই। তবে শিক্ষাদানের চিন্তাভাবনা বদলাতে হবে। স্কুলের শিক্ষকদের বেইজিংয়ে আসার আমন্ত্রণ জানান তিনি। এতে বেইজিংয়ের শিক্ষকদের পড়াশোনার পদ্ধতি সম্পর্কে তারা জানতে সক্ষম হবেন। সাথে সাথে অনলাইন লাইভ ক্লাস চলতে থাকে।

শিক্ষক ফেংয়ের অনলাইন ক্লাসে ইয়ুননানের স্থানীয় শিক্ষকরাও মনোযোগ দিয়ে অংশগ্রহণ করেন। তারা বেইজিংয়ের শিক্ষকদের পড়াশোনার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি শিখতে আগ্রহী। এ সম্পর্কে লানপিং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছুন ইয়ান লিং বলেন, কয়েক বার ক্লাস করার পর তিনি পড়ানোর আরও ভালো পদ্ধতি শিখেছেন। এখন তার ক্লাসে অমনোযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমেছে। এখন শিক্ষার্থীরা অনেক প্রশ্ন করে। তাদের মান দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে।

লানপিং প্রাথমিক স্কুলের জনৈক ছাত্রের মাতা ইয়াং ছিউ জু বলেন, তার বাচ্চা এখন আগের চেয়ে আরো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে এবং হোমওয়ার্কও দ্রুত শেষ করতে পারে। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানে, তাহলে সহপাঠীর কাছ থেকে সাহায্য নেয়। এ সবই ভালো পরিবর্তন। পাহাড় থেকে নতুন স্কুলে স্থানান্তর করার সময় তিনি বাচ্চার পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তবে এখন অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে তার বাচ্চা বেইজিংয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের কাছে শিখছে। এটা খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। স্থানীয় অঞ্চলে নতুন নির্মাণাধীন স্কুলে মোট ৩০০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব হবে। এটাও সবার জন্য সুখবর।

'এখন বাচ্চারা বিনা খরচে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা পেতে পারছে। আমি শুধু মনোযোগ দিয়ে চাকরি করি। আমাদের সুখী জীবন শুরু হয়েছে। আর কোনো চিন্তা নেই।' ম্যাডাম ইয়াং এমন কথা বললেন।

সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040