বিদ্যাবার্তা ১০০৫
  2020-10-05 19:55:59  cri

 


দারিদ্র্যবিমোচন চলতি বছরে চীন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের অন্যতম। দারিদ্র্যবিমোচন বাস্তবায়নে শিক্ষার উন্নয়নও অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও পদ্ধতি। চীনের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্র জেলাগুলোতে কর্মরত শিক্ষকরা স্থানীয় বাচ্চাদের শিক্ষাদানে ভুমিকা পালন করে থাকেন। এমন জায়গায় শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্তি বাস্তবায়নে ১৫ বছর আগে তথা ২০০৫ সাল থেকে 'বিশেষ কর্মসংস্থান পরিকল্পনা' বাস্তবায়ন শুরু হয়। এর মাধ্যমে চীনের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি প্রদেশের ১০০০টিরও বেশি জেলার ৩০ হাজারেরও বেশি স্কুল ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে মোট ৯.৫ লাখ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে দরিদ্র গ্রামাঞ্চলে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, শিক্ষার মান শ্রেষ্ঠ, এবং সংশ্লিষ্ট ভর্তুকিব্যবস্থাও বেশ আকর্ষণীয়। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের গ্রামাঞ্চলে কর্মরত শিক্ষকদের গল্প তুলে ধরবো।

বিশেষ কর্মসংস্থান পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত শিক্ষকরা চীনের গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে দারিদ্র্যবিমোচনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকেন। তাঁরা ভালোবাসা ও আবেগ নিয়ে দারিদ্র্যের বিস্তারে বাধা দেন এবং দরিদ্র গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি বাচ্চার স্বপ্ন বাস্তবায়নে চেষ্টা করেন। চীনের সবচেয়ে দূরবর্তী, দরিদ্র ও কঠোর এলাকায় বসবাস করেন তাঁরা। তবে পরিকল্পিত সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নে আর সার্বিক সচ্ছল সমাজের গড়ে তোলায় তাদের অবদান রাখছেন শিক্ষকরা।

চীনের হাইনান প্রদেশের ছোংচুং লি জাতি ও মিয়াও জাতির অধ্যুষিত এলাকার হুংমাও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা ওয়াং ইয়াং ইং সংবাদদাতাকে বলেন: "আমার দাদা, চাচা ও বাবা—সবাই শিক্ষক। তাই শিক্ষকতা ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন। ২০১৮ সালে আমি শিক্ষকদের 'বিশেষ কর্মসংস্থান পরিকল্পনায়'-য় অংশগ্রহণ করি। তখন থেকেই হাইনানের এ প্রাথমিক স্কুলে কাজ করছি। স্কুল আমার কাছে অনেক আনন্দের স্থান। কারণ, এখানে উন্নত মাল্টিমিডিয়া যন্ত্রপাতি রয়েছে, স্কুলের খেলার মাঠও নতুন নির্মিত, এবং সাঁতারের পুলও নির্মিত হচ্ছে। আমরা এ জন্য অপেক্ষা করছি। স্কুলে মোট ৪৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আমার আসার আগে শুধু একজন মিউজিক শিক্ষিকা ছিলেন। গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য কোয়ার দল গঠন করতে চাই। ছাত্রছাত্রীরা যখন গান শেখে, তখন অনেক উত্সাহ বোধ করি। ক্লাসের পরিবেশ খুবই আনন্দদায়ক। তবে আলাদাভাবে গান গাওয়ার সময় সবাই লজ্জা পায় এবং কেউ একা গাইতে চায় না। পরে আমি সংগীত শেখার পদ্ধতি পরিবর্তন করি। ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করা হয় এবং তাদের ভয় ও সংকোচ ধীরে ধীরে কেটে যায়। সন্ধ্যাবেলায় স্কুলের ক্লাস শেষ করে আমি বাচ্চাদের সাথে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথেও গান গাই। সূর্যাস্ত ও পাখির ডাকের সাথে গান গাওয়া বাচ্চাদের জন্য অনেক মজার কাজ। গত বছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা জেলা পর্যায়ের গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে প্রতিযোগিতার জন্য চর্চা করে ও প্রস্তুতি নেয়। তারপর জেলায় ড্রাম শিং দল আয়োজন করে, তখন বাচ্চারাও আগ্রহের সাথে অংশ নেয়। তাদের হাসিমুখ দেখে আমার অনেক গর্ব লাগে এবং তারা যেন সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে গেছে।"

ছোংচুং এলাকায় প্রায় দুই বছর সময় কাটিয়েছেন শিক্ষক ওয়াং। এখানকার পরিবেশ ও বাচ্চাদের বেশ পছন্দ করেন তিনি। তাদের সাথে থাকার সময় যেন কাজ ও গান শেষ হতে চায় না। স্কুলের কাছে একটি পরিচ্ছন্ন নদী বয়ে গেছে। বাচ্চাদের সঙ্গে এই ছোট নদীর মতো থাকতে চান শিক্ষক ওয়াং এবং বাচ্চাদের অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছাতে সহায়তা দেন তিনি।

আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা

চীনের ইয়ুননান প্রদেশের কুংশান তুলুং ও নু জাতির অধ্যুষিত জেলার পুলাতি উপজেলার এক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা শাও বেন জুয়ান ২০১৭ সাল থেকে এখানে চাকরি শুরু করেন। স্কুলে পৌঁছার পর প্রথম সাপ্তাহিক ছুটিতে তিনি এক শিক্ষার্থীর বাড়িতে যান। ছাত্রী সিয়াওছুন তাঁকে নিয়ে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায়। সিয়াওছুনের নানী শিক্ষক শাওকে দেখে অনেক আনন্দিত হন। কারণ, সিয়াওছুনের বাবা-মা বড় শহরে চাকরি নিয়েছে। শিক্ষক তাকে যত্ন নিচ্ছেন দেখে নানী অনেক খুশি হন। তখন শিক্ষক শাও নানীকে বলেন, 'আমি অবশ্যই সিয়াওছুনের যত্ন নেবো। আপনার কোনো চিন্তা থাকবে না।'

সেইদিন সিয়াওছুন ও তার নানীর ছবি তোলেন শিক্ষক শাও। ছবি দেখে নানী মুগ্ধ হয়ে কেঁদে ফেলেন। কারণ, এর আগে তিনি কখনো নাতনীর সাথে ছবি তুলেননি।

পাহাড় থেকে নেমে অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে শিক্ষক শাও সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভবিষ্যতে পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য আরও বেশি কাজ করবেন। পরে তিনি নিয়মিতভাবে দূরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে যাওয়া শুরু করেন এবং ক্লাসের ২৫টি বাচ্চার সবার বাড়িতে যান।

একবার যখন তিনি মেয়ে সিয়াওহুয়া'র পরিবারে পৌঁছান, তখন খেয়াল করেন যে, তার জলরঙ কলম নেই। সে পেন্সিল দিয়ে সুন্দর ছবি আকেঁ। তিনি আরও দেখেন, ছেলে সিয়াওপু বাড়িতে গাছের শাখায় বাস্কেট বসিয়ে বাস্কেটবল খেলে। কারণ, সে একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড় হতে চায়।

বাচ্চাদের বাড়িতে যাওয়ার পর শিক্ষক শাও বুঝতে পারেন, বাচ্চাদের পাহাড় থেকে বের করে আনতে ও তাদের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে তাকে অনেক চেষ্টা করতে হবে।

চীনের সিছুয়ান প্রদেশের মিয়ানইয়াং শহরের ইয়ানথিং জেলার উলুং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নি শান ছিং বলেন, 'ছোটবেলায় আমি গ্রামে বড় হয়েছি। আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল। তাই ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের সাথে দূরবর্তী পাহাড়ে ভেষজ ওষুধ সংগ্রহ করতাম। বৃষ্টির পর রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে যেতে। মনে আছে, তখন অনেক লম্বা লম্বা কাঠের সেতু অতিক্রম করে পাহাড়ে যেতে হতো। সেতুর নিচে দ্রুত প্রবাহিত নদী। তখন আমি ভাবতাম, এমন পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নত করতে হবে।' ২০১৪ সালে শিক্ষক নি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তখন তিনি বিশেষ কর্মসংস্থান পরিকল্পনায় অংশ নেন। গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের সুন্দর জীবন বাস্তবায়নে চেষ্টা করেন তিনি।

তাঁর ক্লাসে মোট ২৯ জন ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে ২০ জন বাবা-মায়ের সাথে থাকে না। কয়েকজন শুধু বাবা বা মায়ের সাথে থাকে। তখন তিনি আপন বাচ্চাদের মতো তাদের যত্ন নেওয়া শুরু করেন।

১০ বছর বয়সী ছাত্র সিয়াওজুন সবসময় কান্নাকাটি করতো। সে একা একা থাকে। তার বাসায় গিয়ে জানা গেল যে, সে ৬০ বছর বয়সী নানীর সাথে বসবাস করে। কারণ, তার বাবা-মার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। তখন থেকে সিয়াওজুনের মানসিক অবস্থার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন শিক্ষক নি। তিনি নিয়মিত সিয়াওজুনের সাথে কথা বলতে শুরু করেন এবং তার কথা মন দিয়ে শোনেন। নানীর জন্মদিনে সিয়াওজুনের সাথে নানীর জন্য নুডলস রান্না করেন শিক্ষক নি। তখন থেকে সিয়াওজুন শিক্ষককে বেশি বিশ্বাস করতে ও তার ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন।

চীনের হুপেই প্রদেশের এনশি শহরের সিনথাং জেলার একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক উ ইয়ান ফেং ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। তারপর তিনি এনশি থুচিয়া জাতির অধ্যুষিত এলাকার লুংফেং জেলার লুংমা গ্রামের একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ানো শুরু করেন।

একজন নতুন শিক্ষক হিসেবে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় পায় এবং লজ্জায় চুপ করে থাকে। শিক্ষক উ বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস গঠনে অনেক চেষ্টা করেন। তাদের জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি চরিত্র বিকাশে সহায়তা করতে থাকেন তিনি। তিনি স্কুলে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা ও হোস্টেল সুন্দর করাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন। তার প্রচেষ্টায় বাচ্চারা আরও প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। পরে তার শিক্ষার্থীদের অনেকে বেইজিং ও চেচিয়াং প্রদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হয়। শিক্ষক উ'র যত্নে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে।

শিক্ষক উ'র ছাত্রী থাং শান বর্তমানে নিজেও শিক্ষিকা। চলতি বছর কোভিড-১৯ মহামারির সময় তার অনলাইন ক্লাস ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। মাধ্যমিক স্কুলে থান শান ছিলেন লাজুক প্রকৃতির। তবে পরে শিক্ষক উ'র সহায়তায় তিনি আত্মবিশ্বাস ফিরে পান এবং অনেক প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি শিক্ষক উ'র মতো গ্রামাঞ্চলে ফিরে এসেছেন।

বর্তমানে শিক্ষক উ সিনথাং জেলার একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট। গত কয়েক দশকের শিক্ষক জীবন স্মরণ করে তিনি বলেন, "গ্রামাঞ্চল আমার জন্য বড় মঞ্চ। আমি শিক্ষার্থীদের জন্য সুন্দর মঞ্চে শিক্ষার প্রদর্শনীর চেষ্টা করি। মঞ্চ থাকলে আমার শিক্ষার্থীরাও উজ্জ্বল হয়ে যাবে।"

চীনের হ্যনান প্রদেশের পুইয়াং জেলার স্যু জেলার এক কমিউনিটির প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক ইয়াং ছেং প্রায় ১১ বছর ধরে কাজ করছেন। ২০০৯ সালে তিনি হ্যনান প্রদেশের প্রথম দলের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক হন। তখন স্কুলের প্রেসিডেন্ট মোটরগাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে গ্রামে পৌঁছেছিলেন। প্রাথমিক স্কুলে মাত্র ৪ জন শিক্ষক ছিল তখন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়ার শিক্ষকের বয়স ছিল ৫৩ বছর।

একজন যুব শিক্ষক হিসেবে ইয়াং ছেংয়ের দায়িত্ব অনেক ভারী ছিল। কারণ, ক্লাসরুমের অবকাঠামো দুর্বল, আলাদা হোস্টেল পাননি তিনি, রাতে ক্লাসরুমেই থাকতে হয়।তিনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই কঠোর অবস্থাও সহ্য করতে শুরু করেন। তিনি হয়ে ওঠেন বাচ্চাদের আশাস্থল। একবার তিনি জেলায় গিয়ে এক মিটিংয়ে অংশ নেন। রাতের সময় বাসে স্কুলে ফিরে যান। তখন স্কুলের বাইরে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ছাতা নিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের চোখে অশ্রু। তারা বলে, "শিক্ষক, আমরা ভেবেছিলাম আপনি আর ফিরে আসবেন না। আমাদের অনেক দুঃখ লাগছিল।" তখন শিক্ষক ইয়াং বলেন, 'আমি এখানে তোমাদের সাথে থাকবো; আর কোথাও যাবো না।'

২০১১ সালে হুয়াংহ্য নদীর স্থানান্তর প্রকল্পের আওতায় শিক্ষক ইয়াং ও তাঁর ৫২ জন ছাত্রছাত্রী নতুন প্রাথমিক স্কুলে আসে এবং ২০১৫ সালে নতুন নির্মিত কমিউনিটির প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়া শুরু করে। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ৪০ জন থেকে ১৫০০ জনেরও বেশি হয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে বাচ্চাদের সুন্দর জীবনের জন্য কাজ করছেন তিনি।

সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040