প্রিয় বন্ধুরা, এখন চীনের লজিস্টিক ব্যবস্থা খুব সমৃদ্ধ। উন্নত সড়কব্যবস্থার কারণে ট্রাক দিয়ে পণ্য পরিবহনের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এখন অনেক ট্রাক ড্রাইভার আছেন, যারা ট্রাক চালিয়ে বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করেন, মানুষের পাঠানো পার্সেল সরবরাহে তারা ব্যস্ত থাকেন। তারা জন্মস্থান ত্যাগ করে বিভিন্ন শহরাঞ্চলে জীবনযাপন করছেন। আজকে আমরা আপনাদেরকে চীনের হাং চৌ শহরের কিছু ট্রাক ড্রাইভারের গল্প বলবো। তারা জীবনকে প্রাণচঞ্চল রাখার চেষ্টা করছেন ও আনন্দ করছেন। তারা ব্যস্ততা ও তিক্ত জীবনের কষ্ট ঝেড়ে ফেলে জীবনকে মধুর করার চেষ্টা করছেন।
একটি ট্রাক, দুটি বাতি, এক সেট হাই-ফাই সাউন্ড সিস্টেম, কয়েকজন মানুষ.........গ্রীষ্মের এক রাতে ট্রাকটি যেন গান গাওয়ান মঞ্চে পরিণত হয়েছে। গান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে হাং চৌয়ের কিছু ট্রাক ড্রাইভার নিজের আনন্দে মেতে ওঠেন।
এই বিশেষ কনসার্ট হাং চৌ শহরের বন পার্কের পার্কিং এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৪.২ মিটার লম্বা একটি পুরোনো ট্রাকই হল তাদের মঞ্চ।
ট্রাক ড্রাইভার লিউ তুং ফাং ট্রাকের উপরে লাফ দিয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, আমার নাম লিউ তুং ফাং, আমি চীনের হ্য নান প্রদেশের মানুষ, এটাই হল আমার ট্রাক, এটাই হল আমার মঞ্চ।
দিনে সব কাজ শেষ করেন, রাতে থাকার জায়গায় ফিরে ৩২ বছর বয়সী ট্রাক ড্রাইভার লিউ নিজের খাবার রান্না করেন, কাপড় ধুয়ে রাখেন, বিছানায় শুয়ে গান শোনেন। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে আমি গান গাইতে পছন্দ করি, গান গাওয়ার সময় আমার মনে হয়, জীবন মানে শুধু ট্রাক চালিয়ে পণ্য পরিবহন করা নয়। জীবনের কোনো স্বাদ না থাকলে, স্বাদ খুঁজতে হয়।
চীনের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এসব ট্রাক ড্রাইভার, মালামাল পরিবহনের কারণে হাং চৌ শহরে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হন, অভিন্ন শখের কারণে তারা একসাথে গান গাওয়া শুরু করেন।
ড্রাইভার লি চি চীনের হু পেই প্রদেশের লোক। মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি একসময় কুয়াং চৌ শহরে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৫ সালে স্ত্রীকে নিয়ে হাং চৌ শহরে আসেন। তিন বছর আগে ড্রাইভারের লাইসেন্স পান এবং ট্রাক চালানো শুরু করেন।
গাড়িতে লি চি যেভাবে গাইতে চান, সেভাবেই গান গাইতে পারেন। একেবারে অবাধ, মুক্ত ও স্বাধীন অনুভূতি। বেশিরভাগ সময় রাতে তার ট্রাক চালানোর দরকার হয় না। তিনি মোবাইল এপিপিতে গান গাইতেন, গোসলের সময় গান গাইতেন, শিশুর জন্যও গাইতেন। অবশ্য, স্ত্রীর জন্য অনেক প্রেমের গানও গেয়েছেন তিনি।
সেদিন রাতের কনসার্টে ড্রাইভার লি চীনের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লিউ দ্য হুয়া'র গান 'আজ' গাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গানের কথাগুলো এমন:
আমি বার বার হতাশ হই, বার বার নতুন আশা তৈরি করি। জীবনের তিক্ততা নিজেই হজম করি, আনন্দগুলো অন্যের সঙ্গে ভাগ করি। এখন মঞ্চে দাঁড়াই, যদি আরো উপরে উড়তে চাই, তাহলে দিগন্ত ভুলে যেতে হবে। অনেক দিন অপেক্ষা করি, অবশেষে আজকের আনন্দ পেয়েছি।
এই হল 'আজ' গানের কথাগুলো, যা ড্রাইভার লি'র মনের কথা।
ড্রাইভার সুন এ কনসার্টের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ মানুষ। কনসার্টের আগে তিনি নিজের গাড়ি চালিয়ে একবার মালামাল সরবরাহ করেন। দশ কিলোমিটার দূরত্বে মাল পরিবহন করে তিনি একশ ইউয়ান আয় করেন।
যদিও এই কনসার্ট খুব জরাজীর্ণ, তবুও সবাই খুব সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেয়। ১৭টি গান মন দিয়ে গাওয়া হয়। দর্শকদের মধ্যে ১ বছরের কম বয়সী শিশুও আছে, ৭০ বছর বয়সের বেশি বৃদ্ধও আছে। কিছু কিছু গান শুনে দর্শকদের চোখে পানি চলে আসে। একজন দর্শক বলেন, এসব পুরানো গান শুনে আমার তরুণ জীবনের কথা মনে পড়ে।
কনসার্ট শেষ হলে এসব ড্রাইভারের জীবন আগের মতো সাধারণ ও কর্মচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ভোর ৬টায় অ্যালার্মের শব্দে ড্রাইভার লিউ ঘুম থেকে ওঠেন, নাস্তা খেয়ে সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি বের হয়ে যান। তার নতুন একটি দিনের কাজ শুরু হয়।
রাতে তাঁর গান গাওয়ার 'মঞ্চ' হল দিনে তাঁর টাকা উপার্জনের বাহন। গান তাঁর অন্যতম বন্ধুও বটে। গত মে মাসে তিনি ৩০ লাখেরও বেশি ইউয়ান ব্যয় করে এই ট্রাক কিনেছেন। ট্রাকটি তাঁর জীবনকে সচল রেখেছে। তবে ট্রাকে এসি নেই, তাই ট্রাকের সঙ্গে গ্রীষ্মকাল কাটানো খুব কঠিন।
ড্রাইভার লিউ বলেন, এটি পুরোনো গাড়ি, তখন বিক্রেতা বলেছিল যে- কেনার পর গাড়িতে এসি লাগানো যায়। তবে পরে আমি জানতে পেরেছি, গাড়িতে এসি লাগানোর জায়গা নেই, কোনও উপায় নেই।
লিউ নিজেকে সান্ত্বনা দেন, এসি না থাকলে গাড়ির তেলের খরচ অনেক কম হবে। মানে নিজের ব্যয় একটু সাশ্রয় হবে। তবে গ্রীষ্মকালে আসলেই তাঁর অনেক কষ্ট হয়!
চলতি বছর করোনাভাইরাসের মহামারি চলাকালে তিনি ড্রাইভারদের স্কুলের একজন প্রশিক্ষক ছিলেন। মহামারির কারণে সেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। বাসায় থাকা অবস্থায় তাঁর কোনো কাজ ছিল না। অবশেষে বন্ধুর সহযোগিতায় তিনি মালবাহী দলের একজন ড্রাইভার হিসেবে কাজ পান।
দুপুর ১টার দিকে খাবার খাওয়ার সময়ও পান না ড্রাইভার লিউ। তাকে দ্রুত এক ট্রাক সামগ্রী অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতে হয়। সামগ্রী ট্রাকে তুলতে ৩৫ মিনিট সময় লাগে, এজন্য ড্রাইভার লিউকে ৫ ইউয়ান পার্কিং ফি দিতে হয়। তিনি জানেন, কিছু ক্রেতার মেজাজ ভালো না এবং তাঁর পার্কিং ফি দেবে না। লিউ বলেন, এ অবস্থায় আমাকে হাসি মুখে তার সঙ্গে কথা বলতে হয়। হাসি মুখ দেখলে সে রাগ করতে পারবে না। যদি আমি খারাপ মেজাজে তার সঙ্গে কথা বলি, তাহলে ক্রেতা নিঃসন্দেহে আমার জন্য এই পার্কিং ফি দেবে না। লিউ বলেন, বাইরে কাজ করতে করতে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি জানি, বাইরে কাজ করার উদ্দেশ্য হলো টাকা উপার্জন করা। অল্প কিছু টাকার জন্য অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করলে সে টাকা উপার্জন করা যাবে না। তা ছাড়া, এটা ঠিক না।
বিকাল তিনটার দিকে ট্রাকের সামগ্রী গন্তব্যে পৌঁছে দেন লিউ। এরপর তিনি দুপুরের খাবার খেতে পারেন। তাঁর দুপুরের খাবার হল- দুটি রুটি এবং অল্প কিছু সবজি। তিনি বলেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় খাবার খেতে পারি না। তাই আমি সবসময় দুটি রুটি কিনে খাই।
একবার পণ্য পাঠাতে ২৩ কিলোমিটার দূরে যেতে হয় তার, আর এতে ১৭৪ ইউয়ান আয় করেন লিউ। লিউ বলেন, প্রতিদিন এ রকম তিন চারটি অর্ডার পেলে আমি খুব সন্তুষ্ট হই। তবে বাস্তবতা স্বপ্নের চেয়ে একটু কঠিন। প্রতি মাসে কয়েক দিন তার ব্যবসা খুব মন্দ হয়।
লিউ বলেন, বিশেষ করে রোববার। এদিন সরকারি ছুটি; অনেক অফিস বন্ধ থাকে। তাই মাল পরিবহনের চাহিদাও খুব কম। তাই লিউ প্রতি সপ্তাহের রোববার কাজ থেকে একদিন ছুটি নেন।
এবার আমরা দেখবো আরেকজন ড্রাইভার সুন হাও-এর অবস্থা। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ড্রাইভার সুন বার বার মোবাইলফোন দেখেন, দেখেন কোনো নতুন অর্ডার আছে কি না। রাত দশটার দিকে তিনি অবশেষে একটি ভালো অর্ডার পান—একজন তরুণের জন্য বাসা স্থানান্তর করার কাজ।
সুন বলেন, রাতের বেলা গাড়ি বেশি থাকে, অর্ডারের পরিমাণ কমে যায়। অর্ডারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি মোবাইলফোনে ভিডিও দেখি অথবা গান গাই। আরো ভালো মিউজিকের স্বাদ নিতে ড্রাইভার সুন ৬ হাজারেরও বেশি ইউয়ান ব্যয় করে নিজের ট্রাকে এক সেট পেশাদার হাই-ফাই সাউন্ড ব্যবস্থা লাগিয়েছেন।
সুন দিনের বেলা মদের ব্যবসা করেন, রাতে মালবাহী গাড়ির ড্রাইভারের কাজ করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ও তার বন্ধু জন্মস্থানে একটি মদ বিক্রির কোম্পানি দেন। শুরুর দিকে কোম্পানির অবস্থা বেশ ভালো ছিল। তখন তিনি অতিরিক্ত আয় দিয়ে একটি ফলের দোকানও খুলেছিলেন। আগে তিনি জন্মস্থানে নিজের চেষ্টায় দোকানের মালিক হয়েছিলেন এবং একটি ভালো মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।
তবে, জীবন সবসময় মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলে না। বাজারের তুমুল প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে সুন-এর ব্যবসা ব্যর্থ হয় এবং তিনি অনেক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন।
জন্মস্থানে আর থাকতে পারেন না। সুন বাবাকে নিয়ে হাং চৌ শহরে চলে আসেন। হাং চৌ শহরে আসার প্রথম দিনেই সুন নিজের লক্ষ্য স্থির করেন। আর তা হলো- হাং চৌ শহরে নিজের সামর্থ্য পুনরায় প্রমাণ করা।
২০১৯ সালে সুনের অবস্থা ভালো হয়ে ওঠে। তবে হাং চৌ বাজার তাঁর কাছে নতুন, আরও ভালো অবস্থায় যেতে কিছুটা সময়ও দরকার। কোম্পানির কর্মীদের বেতন এবং অফিসের ভাড়া প্রতি মাসে ২০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি। সুনের জন্য এটি অনেক বড় ব্যয়। আর করোনাভাইরাসের মহামারিও তাঁর ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রাতে ড্রাইভারের কাজ তিন মাস ধরে করেন সুন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে রাত দুইটার দিকে তিনি বাসায় ফিরতে পারেন। কখনও কখনও ভোর ৫টার দিকেও তাকে মাল পরিবহন করতে হয়। সুন বলেন, এভাবে কাজ করলে এক মাসে ৬, ৭ হাজার ইউয়ান আয় হয়।
আসলে সুনের একটি পরিকল্পনা আছে: কষ্ট হলেও কোম্পানির কর্মীদের বেতন বন্ধ করা যাবে না। সুন বলেন, মাঝে মাঝে ব্যবসার সমস্যা হলে তিনি বাসার কথা মিস করেন, বাবা মাকে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলেন। ফোন শেষ হলে তাঁর চোখে পানি চলে আসে। তবে, এসব কষ্ট মনে লুকিয়ে রাখেন তিনি।
সুনের প্রিয় গানের নাম 'আমার মত মানুষ'। এই গানটি তিনি সেই রাতের কনসার্টে গেয়েছিলেন। তিনি গানের মাধ্যমে বলতে চান: জীবন যত কষ্টের হোক না কেন, হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে আবারও উঠে দাঁড়াতে হয়। চেষ্টা করা কত সহজ ব্যাপার!
ড্রাইভার লি জি তাঁর পরিবারের আশা। পুরো পরিবারের বোঝা তাঁর কাঁধে। তিনি দুটি ছোট মেয়ের জন্য কিছু টাকা জমা করতে চান। এক মেয়ের বয়স ৪ বছর, অন্য মেয়ের বয়স ১ বছর। লি জির স্ত্রী মেয়েদেরকে যত্ন নেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বাসা ভাড়া ও প্রতি মাসে খাওয়া-দাওয়ার খরচ ৫, ৬ হাজার ইউয়ানের বেশি। পরিবারের জন্য লি জি অনেক কাজ করেন।
হাং চৌ শহরে এসে লি জি'র সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হল- এই শহরে একটি বাড়ি কেনা। তাঁর স্ত্রী জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। তাই লি জি স্ত্রীকে একটি ভালো বাড়ি দিতে চান। লি জি বলেন, আরো তিন বা পাঁচ বছর সময় লাগবে, তখন আমি একটি বাড়ি কিনতে পারবো। তিনি বলেন, আমি অবশ্যই এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবো।
জীবন উন্নয়নের জন্য এসব ট্রাক ড্রাইভার 'সামনের পথে' এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদাও তারা পূরণ করার চেষ্টা করছে। ড্রাইভার লিউ-এর মতে- গান যেন একটি হৃদয়ের বন্দর; যেখানে হৃদয়ের নৌকা এতে অল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে। মনের দুঃখ-কষ্ট এখানে ফেলে দিলে মন ভালো হয়ে যায়, জীবনের দুঃখকে ভুলে থাকা যায়।
একটি বিশেষ কনসার্ট, যেন একটি আয়নার মতো, এতে শহরের ভ্রাম্যমাণ মানুষের চেহারা দেখা যায়। এই গল্পের মধ্যে তেমনই অনেক ট্রাক ড্রাইভারের গল্প শোনা যায়।