বিদ্যাবার্তা ০৯১৪
  2020-09-14 15:52:20  cri

১০ সেপ্টেম্বর চীনের শিক্ষক দিবস। প্রাচীনকাল থেকে শিক্ষকতা চীনাদের মধ্যে অনেক সম্মানীয় পেশা এবং চীনের একটি প্রবাদে বলা হয়েছে: 'একদিনের শিক্ষক হলেও তিনি হবেন সারাজীবনের জন্য পিতামাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ'। এ থেকে বোঝা যায়, চীনাদের মনে শিক্ষকের স্থান অনেক উঁচুতে।

চলতি বছর সারা বিশ্বের জন্য একটি অতুলনীয় বর্ষ, কারণ কোভিড-১৯ মহামারী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এ বিশেষ মুহূর্তে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। বরাবরের মতো এবারও শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শিক্ষকদের আন্তরিক শুভকামনা জানান।

প্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠানে চীনের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষকদের গল্প তুলে ধরবো।

শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট সি বলেন, চীনের শিক্ষকরা নৈতিকতা ও জ্ঞান অর্জনসহ বিভিন্ন দিক থেকে বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দেন, নতুন যুগে নতুন শিক্ষকতার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেন, এবং বাচ্চাদের প্রশিক্ষণদক্ষতা উন্নত করেন। আরে এর মাধ্যমে চীনা সমাজের দক্ষ নির্মাণকারী ও নতুন প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে ব্যাপক অবদান রাখেন তারা।

২০২০

সালে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়ও কখনো ক্লাস বন্ধ করেননি শিক্ষকরা। তারা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন, প্রতিদিন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁরা স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে দরিদ্র এলাকার বাচ্চাদের অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাতে কোটি কোটি গ্রামের বাচ্চার সোনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

উত্তর চীনের হেইলুংচিয়াং প্রদেশের মুতানচিয়াং শহরের ছাংআন প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র লিউ লাং সি নিজের বাড়িতে খেলাধুলা ক্লাসে অংশ নেয়। ল্যাপটপ ও যোগব্যায়ামের মাদুর নিয়ে বাবা'র সাথে সে শরীরচর্চা করে। তখন মহামারীর কারণে চীনের বিভিন্ন স্কুল বন্ধ। এ অবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভিন্ন ধরনের খেলাধুলার ক্লাসের ভিডিও করেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। খেলাধুলার শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য 'বাড়িতে শরীরচর্চা পরিকল্পনা' প্রণয়ন করেন এবং নিয়মিতভাবে ভিডিও রেকর্ড করে অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে খেলাধুলার ক্লাস করেন।

ছাংআন প্রাথমিক স্কুলের এ খেলাধুলা ক্লাস পরিবারকে 'ক্লাসরুমে' পরিণত করেছে। বাচ্চাদের বাবা-মা তাদের সহপাঠীতে পরিণত হয়েছেন। এ সম্পর্কে ছাত্র লিউ'র বাবা লিউ ফেং বলেন, 'শিক্ষক ভিডিওয়ের মাধ্যমে আমার ছেলের খেলাধুলার ক্লাস নেন। এ ক্লাসের মাধ্যমে আমাদের দু'জনের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আমার খুবই ভালো লাগছে।'

চীনের চিয়াংসি প্রদেশের ওয়ানজাই জেলার কাওছুন উপজেলার সিনজু প্রাথমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট লুও ছাং শি প্রতিদিন মোটরগাড়ি চালিয়ে ইউ ডিস্ক নিয়ে নতুন ক্লাস ডাউনলোড করেন এবং গ্রামের ৫ জন শিক্ষার্থীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কারণ, সিনজু গ্রাম চিয়াংসি প্রদেশের দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত; জেলা থেকে এ গ্রামের দূরত্ব কয়েক ডজন কিলোমিটার। স্থানীয় ইন্টারনেটের অবস্থাও খারাপ। তাই প্রতিদিন নতুন ক্লাসের ভিডিও ক্লিপ প্রেসিডেন্ট লুও'র মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পাঠানো হয়।

যদিও কোভিড-১৯ মহামারীর অবস্থা ভয়ঙ্কর, তথাপি কোটি কোটি শিক্ষক নিজেদের শিক্ষার্থীদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। ২০২০ সালের বসন্ত উত্সবের সময় হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের ইয়ুইং স্কুলের শিল্পকলা শিক্ষক অনলাইন ক্লাসের জন্য অনেক ব্যস্ত ছিলেন। সারা রাত তিনি ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নেন এবং পিপিটি ফাইল তৈরি করেন। পরের দিন স্কুলে গিয়ে নতুন ক্লাসের রেকর্ডিংকাজ সম্পন্ন করেন।

মহামারী-প্রতিরোধক কার্যক্রমবিষয়ক ধারাবাহিক ক্লাসে তিনি চমত্কারভাবে বাচ্চাদের সামনে চীনা চিকিত্সক ও নার্সদের সাহসিকতা ও অবদান তুলে ধরেন। ভিডিও-ক্লাসের পর অনেক ছাত্রছাত্রী নিজেদের মতামতও প্রকাশ করে।

একজন ছাত্র লিখেছে, 'শিক্ষক কুও'র ক্লাসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, বীররা সবসময় থাকে এবং অবদান রাখে। আমিও ভবিষ্যতের একজন বীর হতে চাই।'

এ সম্পর্কে শিক্ষক কুও বলেন, 'ছাত্রছাত্রীদের চিঠি ও মতামত দেখে আমার অনেক আনন্দ লাগে। তাই বলা যায়, আমার চেষ্টার বিশেষ তাত্পর্য রয়েছে। মহামারী-প্রতিরোধক কার্যক্রমে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার গর্বিত দায়িত্ব আছে।'

অনলাইন ক্লাসের নব্যতাপ্রবর্তন, শিক্ষার্থীদের মানসিক পরামর্শ, মহামারী-প্রতিরোধক ব্যবস্থা এবং নিরাপদে স্কুলে ফিরে আসা—ইত্যাদি বিভিন্ন বিশেষ মুহূর্তে বড় চাপের সম্মুখীনে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় চেষ্টা করেন চীনা শিক্ষকরা।

চল

তি বছরের শিক্ষক দিবসের আগের দিন তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের শিকাজে শহরের তিংরি জেলার একটি প্রাথমিক স্কুলের ২৭ বছর বয়সের শিক্ষিকা বসং ডলমা তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ইয়াংজং তরজারিং কাছ থেকে শুভেচ্ছাবাণী পেয়েছেন। ছেলে চিঠিটি শিক্ষকের হাতে দিয়েই লজ্জায় দৌড়ে পালায়। আসলে বসং ডলমা এ স্কুলে ৫ বছরের মতো কাজ করছেন। এ স্কুল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং চুমুলাংমা শৃঙ্গের সাথে এর দূরত্ব বেশি না।

শিক্ষিকা বসং ডলমার ক্লাসে মোট ৯৪ জন ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে ১০ জন স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের এবং সরকারিভাবে নিবন্ধিত। যদিও পরিবারের আর্থিক অবস্থা দরিদ্র, তবে বাচ্চারা মনোযোগ ও পরিশ্রমের সঙ্গে পড়াশোনা করে। শিক্ষিকা ডলমা এতে অনেক খুশি। প্রতিবন্ধী ছাত্র ফুপুচাশির জন্য পায়ের অসুবিধার কারণে স্কুলে যাওয়া-আসা অনেক কষ্টকর। তাই শিক্ষক ডলমা নিয়মিত তার বাড়িতে যান। এ সম্পর্কে শিক্ষিকা ডলমা বলেন, 'বাচ্চাদের পরিশ্রমে পড়াশোনায় প্রতিদিন নতুন অগ্রগতি অর্জিত হয় এবং আমিও শিক্ষকতার পেশার জন্য গর্বিত।'

শিক্ষাদান হবে দারিদ্র্য নির্মূলের কার্যকর পদ্ধতি। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকরা কোটি কোটি গ্রামবাসীর বাচ্চাদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। চিয়াংসি প্রদেশের সিনকান জেলার জুশি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক চৌ সিয়াও মিং গত ৪১ বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। চুশি প্রাথমিক স্কুলের জেলার সাথে দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারেরও বেশি। এখন স্কুলে দুটি শ্রেণী রয়েছে, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৪ জন। যদিও স্কুলের অবকাঠামো দুর্বল, তবে তিনি কখনো অভিযোগ করেননি। ২০০৫ সালে মাথার স্ট্রোকের কারণে শিক্ষক চৌর ডান দিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি প্রতিদিন স্ত্রীর সাহায্যে পাহাড়াঞ্চলের পথ এক ঘন্টার মতো হাঁটাহাটি করেন। স্কুলে অনুপস্থিত থাকার সময়টা তিনি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করেন। একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি পাহাড়াঞ্চলের স্কুলে ফিরে যান। তাঁর কাছে ছাত্রছাত্রীদের সময়মতো ক্লাস নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের ফুসিন শহরের চাংউ জেলায় স্থানীয় শিইয়ান প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা নিয়ে ফেং জুন ২৪ বছর ধরে শিক্ষাদানের কাজ করছেন। তাঁর সাহায্যে পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চারা দেশ-বিদেশের ৪০০টিরও বেশি নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। তারা ছোটবেলা থেকে শিল্পকলার আমেজ অনুভব করতে শিখেছে। এ সম্পর্কে শিক্ষিকা নিয়ে বলেন, 'বড় শহরের নৃত্যদলের সাথে তুলনা করা যায় না। তবে আমি ছাত্রছাত্রীদের বলি যে, মঞ্চে প্রদর্শনীর সময় আবেগের প্রকাশ থাকতে হবে। যেমন, চোখের স্মার্ট ও নমনীয় ভঙ্গি থাকতে হবে।' বহু বছর ধরে তিনি নৃত্যের পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন, যাতে আরো বেশি গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রী নৃত্য শিখতে পারে।

দরিদ্র অঞ্চলের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলে লাখ লাখ শিক্ষকের অবদানে সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের জীবন পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

চিকিত্সকদের মানসিক অবস্থাও অতি গুরুত্বপূর্ণ। ইটারশিপ ডাক্তার প্রথমবারের মতো রোগীর সাথে পরিচয় হলে সহজভাবে মানসিক অবস্থার কারণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। চীনের হেইলুংচিয়াং প্রদেশের হারবিন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিঃশ্বাস বিভাগের ডাক্তার সু তুং জু এমন কথা বলেন। এ সময় ইন্টারশিপ ডাক্তাদের উত্সাহ ও পরামর্শ দেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা আরো দ্রুত হাসপাতালের বিভিন্ন কাজ ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে।

কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে ডাক্তার সু নিজেই হুপেই প্রদেশের উহান শহরে যান। তিনি সেখানকার ১০৫ জন কোভিড-১৯ রোগীর চিকিত্সা করেন। দক্ষ মেডিকেল প্রযুক্তি চিকিত্সকদের মূল সামর্থ্য। বিশেষ করে গুরুতর জনস্বাস্থ্য ঘটনার সম্মুখীনে একজন শিক্ষক ও অভিজ্ঞ ডাক্তারকে যথেষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী হতে হয়।

শ্রেষ্ঠ মেধাবী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণে চমত্কার ও দক্ষ শিক্ষকদের প্রয়োজন। চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের শেনইয়াং শহরের ফাকু জেলার মাধ্যমিক স্কুলে ৩২ বছর বয়সের শিক্ষক পান ফেং স্কুলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছেন। ১০ বছর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাদান প্রকল্পে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিবছর তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চীনের বিভিন্ন প্রদেশের দূরবর্তী এলাকার তৃণমূলের স্কুলে শিক্ষাদান প্রকল্পে অংশ নেন। এ পর্যন্ত চীনের ১৪টি প্রদেশের ৪৬টি জেলার ২১৯টি স্কুলের প্রায় এক হাজার জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা।

[মহামারীর পর বিভিন্ন স্কুলের নতুন সেমিস্টারের প্রতিরোধকব্যবস্থা ও নতুন পদক্ষেপ নিয়ে কিছু আলোচনা।]

সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040