ওয়াং চিন লিয়াং চীনের চ্য চিয়াং প্রদেশের ছাং সান জেলায় সুং ফান প্রাথমিক স্কুলের তুং লু স্কুলের একজন চীনা ভাষার শিক্ষক। তিনি ৩৭ বছর ধরে শিক্ষাদান করছেন এবং গ্রামের শিক্ষা কাজের ফ্রন্ট লাইনের কর্মী। চলতি বছর করোনাভাইরাসের মহামারি হলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখার জন্য দিনের বেলায় তিনি শিশুদের অনলাইনে ক্লাস দেন, বিকাল তিনটায় তিনি বের হয়ে শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে তাদের হোমওয়ার্কগুলো নিতে যান। তারপর চেক করার পর পরের দিন অনেক সকালে আবার শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে হোমওয়ার্কের খাতা পৌঁছে দেন। এমন কাজ মহামারি চলাকালে তিনি প্রতিদিন করেছেন।
ওয়াং চিন লিয়াং ছাং সান জেলার সুয়াং সি খৌ গ্রামে থাকেন। ভোর সাড়ে ছয়টায় তিনি একটি লাল রংয়ের স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইরে যান। এই ভারী ব্যাগে আছে তার ক্লাসের ৩৫ জন শিক্ষার্থীর আগের দিনের হোমওয়ার্ক। তিনি হোমওয়ার্কের সব ভুল ঠিক করে তাদের হাতে পৌঁছে দেন।
করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে চ্য চিয়াং প্রদেশে অনলাইনে লেখাপড়ার শুরু হয়। শুরুর দিকে, শিক্ষক ওয়াং অনলাইনে শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক চেক করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে তিনি আবিষ্কার করেন- এভাবে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখানো যায় না। তিনি বলেন, এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকের বাবা-মা বড় বড় শহরে গিয়ে চাকরি করেন, তারা শুধু দাদা-দাদির সঙ্গে থাকেন। ৩৫জন শিক্ষার্থীর মধ্যে হোমওয়ার্ক করা এবং দাখিল করা শিক্ষার্থী অর্ধেকেরও কম। শিক্ষক ওয়াং বলেন, তাঁর বয়স হয়েছে। মোবাইলফোনে সবার হোমওয়ার্ক চেক করা তার জন্য বেশ কঠিন ব্যাপার।
শিক্ষার্থীদের সময়মত হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করা এবং তাদের লেখাপড়ার অবস্থা জানার জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষক ওয়াং ঠিক করেন, প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের বাসায় যাবেন এবং তাদের লেখাপড়ার সাহায্য করবেন। শিক্ষক ওয়াং বলেন, এই উপায় ততটা আধুনিক না হলেও তা খুব কার্যকর।
শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক নেওয়া এবং বিতরণ করার নির্দিষ্ট রুট আছে। ৩৫ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন গ্রামে থাকে, সবার বাসায় যেতে ১৫ কিলোমিটার পথ পার হতে হয়।
শিক্ষক ওয়াং বলেন, আমি গাড়ি চালাতে পারি না, তবে আমি মোটর সাইকেল চালাতে পারি। এত বছর ধরে আমি হেঁটে হেঁটে অভ্যস্ত হয়েছি। স্কুল বাসার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে। আমি প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে অফিসে যাই। ওয়াং বলেন, এভাবে শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক নেওয়া ও বিতরণ করার মাধ্যমে তাদের কাছে শরীরচর্চার ভালো দৃষ্টান্ত রাখতে পারি।
শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে তাদের হোমওয়ার্ক বিতরণের পর ওয়াং নিজের বাসায় ফিরে নাস্তা করেন। এসব কাজ শেষ হলে তখন ঘড়িতে বাজে মাত্র সকাল ৯টা। ওয়াং মোবাইলফোন খুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। ক্লাস শেষে তিনি আবার শিক্ষার্থীদের কিছু হোমওয়ার্ক দেন, তিনি নিজেও এসব হোমওয়ার্ক একবার করে দেখান। প্রতিদিন বিষয়গুলো ভালোভাবে জানলে ভালোভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা যায়।
বিকাল তিনটার সময়, ওয়াং আবারও স্কুল ব্যাগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাসায় যান। এবার তিনি শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক নিতে গেছেন। একই রুট, দুই ঘন্টার একই পথ, ওয়াংয়ের কখনওই ক্লান্তি বা বিরক্ত লাগে না। মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সমস্যা থাকলে তিনি তাদের সাহায্যও করেন।
প্রতি সেমিস্টারে ওয়াং শিক্ষার্থীর অবস্থা জানার জন্য তাদের বাসায় সফর করেন। শিক্ষার্থীরা কোন গ্রামে থাকে, তিনি চোখ বন্ধ করেও তাদের বাসায় যেতে পারেন। অনেক শিক্ষার্থীর বাবা মাও শিক্ষক ওয়াং-এর শিক্ষার্থী ছিলেন।
ওয়াং-এর ছাত্রী ওয়াং মেং নি'র বাবা শিক্ষক ওয়াংয়ের প্রশংসা করে বলেন, শিক্ষক ওয়াং আমাদের চেয়েও দায়িত্বশীল। প্রতিবার তিনি আমাদের বাসায় এসে ধৈর্যের সঙ্গে আমার মেয়েকে লেখাপড়ায় সাহায্য করেন। এ অবস্থা আমাদের খুব মুগ্ধ করে।
শিক্ষক ওয়াং বাসায় এসে হোমওয়ার্ক চেক করা শুরু করলে অনেক বাবা-মাও সন্তানের লেখাপড়ার ওপর আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। তারা শিশুকে বলেন, দেখো, শিক্ষক ওয়াং হোমওয়ার্ক নিতে আসছেন, শিক্ষক প্রতিদিন এই কাজ করেন, কখনও বন্ধ করেন না। এরপরও তুমি কেন ভালোভাবে লেখাপড়া করো না!
বাবার কারণে শিক্ষক ওয়াং-এর মেয়ে ওয়াং ওয়েই এখন ছাং সান জেলার একটি কিন্ডারগার্ডেনে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। ওয়াং ওয়েই-এর মনে আছে, একবার ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিল; আগের সময়মতো বাবার বাসায় ফিরে আসা উচিত। তবে সেদিন অনেক দেরি হয়। পরে তারা জানতে পারে যে, শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক যাতে ভিজে নষ্ট না হয়, সেজন্য শিক্ষক ওয়াং বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর বাসায় ফিরে আসেন। তার কোলে সবার হোমওয়ার্কের খাতা ছিলো শুকনা, তবে শিক্ষক ওয়াং-এর কাপড় ছিল ভেজা।
শিক্ষক ওয়াং বলেন, ১৯৮৩ সালে যখন আমি প্রথম এই কাজ শুরু করি, তখন আমার বেতন ছিল মাসে ২৬ ইউয়ান। আমি এই গ্রামের লোক, তাই আমি এই গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু কাজ করতে চাই। শিক্ষক ওয়াং বলেন, তিনি একজন শিক্ষক, একজন সিপিসির সদস্য, তিনি দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে শিক্ষাদান করতে চান। শিক্ষক ওয়াং যেভাবে কাজ করেন, তার সহকর্মী তা নিজের চোখে দেখেছেন। শিক্ষক ওয়াং যেন একটি ভালো দৃষ্টান্ত রেখেছেন। অন্য শিক্ষকরাও শিক্ষক ওয়াং-এর মত প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে লেখাপড়ার সাহায্য করেন।
২১ এপ্রিল শিক্ষক ওয়াং-এর স্কুল স্বাভাবিকভাবে পুনরায় চালু হয়। এই স্কুল পাহাড়ের কাছে অবস্থিত। স্কুলে মোট ১৫১ জন শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষকের সংখ্যা ১১ জন। প্রতি গ্রেডে শুধু একটি ক্লাস আছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরে আসাকে স্বাগত জানানোর জন্য শিক্ষকরা অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করেন।
শিক্ষক ওয়াং ষষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষার্থীদের পড়ান। তার দৃষ্টিতে, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হল- একদিকে শিশুদেরকে কিছু জ্ঞান দেওয়া, অন্যদিকে তাদের ভালো গুণ ও চরিত্র গড়ে তোলা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো অভ্যাস তৈরি করা। ওয়াং বলেন, ষষ্ঠ গ্রেড হল প্রাথমিক স্কুলের শেষ বছর। শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হবে। তাই তাদের মজবুত ভিত্তি স্থাপন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েক বছর ধরে ওয়াং-এর স্কুলে অনেক শিক্ষার্থী জেলার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হতে পাহাড়ি এলাকা থেকে বের হয়ে এসেছে। শিক্ষকতার ৩৭ বছরে শিক্ষক ওয়াং সবসময় গ্রামীণ শিক্ষার ফ্রন্ট লাইনে মনের জোরে টিকে রয়েছেন। তিনি সচক্ষে দেখেছেন গ্রামের বিভিন্ন পরিবর্তন। তার স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে, আরো বেশি পরিবার নিজের ছেলেমেয়েকে জেলার ভালো স্কুলে ভর্তি করতে সক্ষম হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা আরো ভালো মানের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে।
শিক্ষক ওয়াং ছাং শান জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার 'সবচেয়ে সুন্দর শিক্ষক'সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও মর্যাদা পেয়ছেন। ২০১৯ সালে শিক্ষক ওয়াংকে চীনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবেও নির্বাচিত করা হয়। শিক্ষক ওয়াং-এর টেবিলের বিপরীত পাশে বসা শিক্ষক ছেং কুয়াং হুং শিক্ষক ওয়াং-এর 'পুরোনো অংশীদার'। তিনি শিক্ষক ওয়াংয়ের মূল্যায়ন করে বলেন, শিক্ষক ওয়াং শিক্ষার্থীদের পাঠদানে খুব দায়িত্বশীল মনোভাব পোষণ করেন।
শিক্ষক ওয়াং-এর কাহিনী গণমাধ্যমে প্রকাশের পর চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। কেউ বলেন, 'আমার এই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। আশা করি শিক্ষক ওয়াং অবসর নেওয়ার পর ভালো থাকবেন। শিক্ষক ওয়াং দীর্ঘজীবী হোন।' কেউ বলেন, 'শিক্ষক ওয়াংয়ের পিঠের ওই স্কুলব্যাগটি হলো গ্রামীণ শিশুদের ভবিষ্যত!'
শিক্ষক ওয়াং বলেন, লেখাপড়া করার মাধ্যমে গ্রামীণ শিশুদের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। আরো দুই বছর পর আমি অবসর যাবো। আমি অবসর পর্যন্ত ভালোভাবে শিশুদের শিক্ষাদান করবো, পাহাড়ি এলাকা থেকে বের হতে চায়, এমন শিশুদের সাহায্য করবো।