২৬ অগাস্ট ছিল শেন চেন, চীনের প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার, ৪০তম জন্মদিন। দক্ষিণ চীনের একটি ছোট গ্রাম থেকে আধুনিক নগরে পরিণত হয়েছে শেন চেন। সেখানে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ স্থায়ীভাবে বাস করেন এবং প্রতি সেকেন্ডে ৮৫ হাজার ইউয়ান মূল্য সৃষ্টি করেন।
শেন চেন শহরের পিং আন আর্থিক কেন্দ্রের লিফট প্রতি সেকেন্ডে ১০ মিটার উচুঁতে যেতে পারে। অনেকটি উড়ে যাওয়ার মতো। ১১৬ তলার এ ভবন শেন চেনের সর্বোচ্চ উচ্চ একটি ভবন। গেল ৪০ বছরে, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতির সাহায্যে, শেনচেন দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আজকাল এ শেন চেন শহরের জিডিপি ১৯৭৯ সালের ১৯৭ বিলিয়ান ইউয়ান থেকে বেড়ে ২০১৯ সালের ২.৬৯ টিলিয়ান ইউয়ানে পৌঁছায়। এসময় জিডিপি বেড়েছে ১৪ হাজার গুণ! বার্ষিক গড়ে ২১.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে আছে ৮.৫টি জাতীয় উচ্চ প্রযুক্তির কোম্পানি। এখানকার প্রতিদিন গড়ে ৭১টি পেটেন্ট পাওয়া যায়। হুয়া ওয়ে, চীন মার্চেন্টস ব্যাংক, টেনসেন্ট, ভানকেসহ বিশ্বের ৮টি সেরা কোম্পানির সদরদফতর এখানে অবস্থিত। বিশ্বের সেরা ৫০০টি কোম্পানির মধ্যে বিদেশের ৩০০টি শেনচেনে শাখা-অফিস স্থাপন করেছে।
১৯৮০ সালের ২৬ অগাস্ট, পঞ্চম জাতীয় গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ১৫তম সম্মেলনে, শেনচেনে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা স্থাপনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। শেন চেন আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা হয়। এখানে চীনের প্রথম জমি নিলাম হয়, প্রকাশিত হয় চীনের প্রথম স্টক, স্থাপিত হয় চীনের প্রথম রপ্তানি শিল্প পার্ক। গেল ৪০ বছরে, শেনচেন চীনের ১০০০টির বেশি 'প্রথম' উপহার দিয়েছে। এক একবার প্রথম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে চীনের স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্রিক বাজার অর্থনীতি।
শেন চেনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ বিশেষ দায়িত্ব বহন করে। শেন চেন চীনা সংস্কার ও উন্মুক্তকরণে সাফল্যের সূচনাস্থল। শেনচেন, চু হাই, শান থৌ, সিয়ান মেন—এই চারটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার পর ১৯৮৪ সালে চীনের ১৪টি সামুদ্রিক শহরে চালু হয় বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম। ১৯৮৮ সালে হাই নান প্রদেশ এবং হাই নান বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে শাংহাইয়ের ফুতুং এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
শেনচেন শহরে, বিওয়াইডি কোম্পানির সিইউ ওয়াং ছুয়ান ফু নতুন একটি স্বপ্ন দেখেন। তার কোম্পানি ব্যাটারি থেকে, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়। চলতি বছরের শুরুতে মাহামরি মোকাবিলায় কোম্পানি শুরু করে মাস্ক উত্পাদন। মানুষ ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কার ও নবায়ন করা কোম্পানির একটি নিয়মিত কাজের অংশে পরিণত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে ওয়াং ছুয়ান ফু শেনচেনে ২৫ বছরের মতো স্বপ্ন অনুসন্ধান করতে থাকেন। তিনি বলেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ না থাকে আজকের শেনচেন হতো না এবং শেনচেন না থাকলে বিওয়াইডি কোম্পানিও থাকতো না।
১৯৮২ সালে শেনচেনে প্রথম হংকং স্বায়ত্তশাসিত শিল্প প্রতিষ্ঠান, একটি খেলনা কারখানায় স্থানীয় কর্মী নিয়োগ শুরু করে। তেং ইয়ান পিং নামে একজন মেয়েসহ শতাধিক মেয়ে চীনের প্রথম নারীদল হিসেবে শহরে কাজ করা শুরু করে। বাহির থেকে আরও বেশি মানুষ শেনচেনে আসে এবং তারা শহরের উন্নয়নে অবদান রাখেন।
২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি ও চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ যৌথভাবে প্রকাশ করে শেনচেনকে চীনের স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্রের পাইলট দৃষ্টান্ত এলাকায় পরিণত করার প্রস্তাব। এ প্রস্তাব অনুযায়ী, ভবিষ্যতে শেনচেনে প্রতিটি কমিউনিটিতে একটি করে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থাকবে। ৬০ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষ বিনামূল্যে বাস ও সাবওয়ে ব্যবহার করবেন।
কোভিড-১৯ মহামারি হবার পর, চীনের সবচেয়ে তরুণ এবং একটি নবায়ন শহর হিসেবে শেনচেন থেকে চীনের পক্ষে বিশ্বে নানান মহামারি প্রতিরোধক সামগ্রী পাঠানো হয়। শেনচেনের চুচিয়াং নদীর বদ্বীপ অঞ্চলকে বিশ্বের কারখানা বলে ডাকা হয়। বসন্ত উত্সবের দ্বিতীয় দিন থেকে মহামারি প্রতিরোধে ভেন্টিলেটর, মনিটর সরবরাহ করতে কাজ করছে শেনচেনের কোম্পানিগুলো। এর আগে চীন-হু কোভিড-১৯ বিশেষজ্ঞদল চীন সফর করে এবং এর পর প্রকাশিত একটি প্রতিদেবনে শেনচেনের মাহামরি-প্রতিরোধ অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
২৬ অগাস্ট, শেনচেনরে ৪০তম জন্মদিনে, চালু হয় শহরের ২৯তম বন্দর। একটি শহরে ২৯টি শুল্কবন্দর, যা চীনে শেনচেন ছাড়া আর কোথাও নেই। শেনচেনের প্রথম বন্দরের তত্কালীন প্রধান, ৮২ বছর বয়সী লি চু ওয়েন বলেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ শেনচেনের বৈশিষ্ট্য এবং ভবিষ্যতে শহরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষমতা বাড়ানোর চাপিকাঠি।
পাশাপাশি কুয়াং তুং প্রদেশের ডিজিটাল সরকার প্রকল্পের পরীক্ষামূলক শহর হিসেবে স্মার্ট শহর ও ডিজিটাল সরকারসহ নানা বিষয়ে শেনচেন সামনে এগিয়ে আছে। চলতি শতাব্দীর মধ্যভাগে শেনচেন বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত শহরের একটি হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষমতা, নবায়ন ও প্রভাবসহ নানা ক্ষেত্রে বিশ্বের দৃষ্টান্ত হবে। শেনচেনের উন্নয়ন আবার প্রমাণ করে যে, চীনে চীনের স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্র চলছে এবং চীনের বাস্তবতার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ।
চীনা জাতির মহা পুনরুত্থানে শেনচেন প্রথম 'দ্রুতগতির জাহাজ' হিসেবে সামনে এগুচ্ছে এবং শেনচেনের জন্য উজ্জ্বলতর ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। (শিশির/আলিম/রুবি)