এই রান্নাঘরে, এমন মানুষ আছে, যে নিজের স্ত্রীকে যত্ন নেওয়ার জন্য ৫০ বছর বয়সী হলেও জীবনে প্রথমবারের মতো রান্না করার স্বামী। মা অসুস্থ হয়েছে, ১৬ বছর বয়সের কিশোর রান্না করতে শুরু করেছে, আর কেউ নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেও নিজের জন্য রান্না করে। ছোট রাস্তায় অবস্থিত এই খোলা মাঠের রান্নাঘর খুব জরাজীর্ণ হলেও, প্রতিদিন এখানে প্রাণের স্বাস্থ্যকর গন্ধ ও আশা উপলব্ধি করা যায়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এই রান্নাঘরের মালিক ওয়ান সো ছেং ও সুং কেং সিয়াং দম্পতির গল্প বলবো।
স্বামী ওয়ানের বয়স ৬৭ বছর। ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি ও স্ত্রী সুং ক্যান্সার হাসপাতালের কাছে রেস্তরাঁ খোলেন। পরে কাছাকাছি রাস্তা পুনর্নির্মাণের কারণে তাদের রেস্তরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তারা এই ছোট রাস্তায় স্থানান্তর করেন এবং নাস্তা বিক্রি শুরু করেন।
২০০৩ সালের এক দিন সকালে, হাড়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত দশ বারো বছর বয়সের একটি শিশু তার মায়ের রান্না করা খাবার খেতে চায়। তার মা ওয়ানের নাস্তার দোকানে এসে অনুরোধ করেন যে, তোমাদের রান্নাঘরকে আমি কি আমার ছেলের জন্য একটি মিল রান্না করতে পারি? ওয়ান কোনো দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে যান। এত ছোট শিশু কিন্তু হাড়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত! তার পা কেটে ফেলা হয়েছে, সে শুধু মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খেতে চায়। এ কথা ওয়ানের মনে ভীষণ নাড়া দেয়। ওয়ান এই মাকে জানান, সে প্রতিদিন তার রান্নাঘরে এসে ছেলের জন্য রান্না করতে পারবে, এতে তার কোনও আপত্তি নেই।
অল্প সময়ের মধ্যে ওয়ানের উষ্ণহৃদয়ের কথা ক্যান্সার হাসপাতালের রোগীদের আত্মীয়স্বজনরা জানতে পারে। শুরুর দিকে প্রতিদিন দশ বারোজন তার রান্নাঘর ব্যবহার করত, পরে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ এখানে আসে। যথেষ্ট চুলা ছিল না, ছয়টি চুলার সামনে অনেকেই লাইন ধরে অপেক্ষা করত। খাবার রান্না করার জন্য কেউ কেউ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করত। তাই ওয়ান আরও দশ-বারোটি চুলা কিনেন। এরপর আরো বেশি মানুষ তার রান্নাঘরে আসতে শুরু করে।
ওয়ান বলেন, তার রান্নাঘর আসলে সেখানের রোগী ও আত্মীয়স্বজনের জন্য একটি স্বল্পমেয়াদী বাড়ি। যেখানে খাবার আছে, সেটাকে বাসা বলা যায়। খাবার ছাড়া কোনও বাসা হতে পারে আন। নিজের পরিবারের রান্না খাবার খেতে হয়।
শুরুর দিকে রোগীদের আত্মীয়স্বজনরা ওয়ানের রান্নাঘরে রান্না করতে কোনো ফি দিতে হতো না। তবে, পরে তারা বলে যে, মালিক আমাদের কোনো টাকা না নিলে আমরা খুব লজ্জা বোধ করি। মালিক ওয়ান, তুমি কিছু টাকা নাও। ওয়ান বলেন, পানি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যয় বহন করার জন্য এবং রোগীদের আত্মীয়স্বজনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তিনি অল্প কিছু ফি নেওয়া শুরু করেন।
অপরিচিত শহরে অপরিচিত মানুষ এখানে এসে পরিচিত হয়। ছোট রাস্তায় ২০টিরও বেশি চুলা এক লাইনে রাখা আছে। মানুষ সবচেয়ে বেশি হলে ৫০/৬০জন একসাথে শাকসবজি ধুয়ে রান্না করছে। তারা এ জন্য যে ফি দেয় তা হল, শাকসবজি ভাজতে এক ইউয়ান, সুপ রান্না করতে ২.৫ ইউয়ান, ভাত এক ইউয়ানে এক বক্স। আসলে এই ফি শুধুই দম্পতি ওয়ান ও সুং-এর ভারসাম্য বজায় রাখার পদ্ধতি।
ওয়ান বলেন, একজনের অনেক বেশি টাকা উপার্জনের প্রয়োজন নেই; অনেক বেশি টাকা মজুদের দরকারও নেই। আমরা একে-অন্যকে সাহায্য করতে পারি, অন্যরা আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়, আমরা এজন্য আনন্দ বোধ করি।
১৭ বছর ধরে, এখানে মানুষ আসে ও যায়, চুলার আগুন কখনওই নেভে না। ওয়ান দম্পতি প্রতিদিন সকাল ৪টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন, বছরের কখনও বিশ্রাম নেন না। ওয়ান বলেন, অনেকে বলে যে আমার মাথা খারাপ, আমার বাইরে ভ্রমণ করা উচিত। তবে আমরা মনে করি, আমরা তো ভ্রমণ না করেও সুখী! এখানে এত বেশি মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে! এই সুখের কোনও তুলনা হয় না!
ওয়ান বলেন, তারা প্রতি বছর ৩৬৫দিন, প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা এখানে থাকেন। তাঁর কথায়, এখানে একদিনের জন্যও আগুন নেভে না। চীনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উত্সবের রাতে আমার মেয়ের সাথে 'বছরের শেষ রাতের খাবার' খেয়েছি। এক ঘণ্টা পর আমি আবার এই রান্নাঘরে ফিরে এসেছি। আমরা ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতো এখানে ২৪ ঘণ্টা ধরে কাজ করি।
চলে যাওয়ার সময় অনেক রোগীর আত্মীয়স্বজন তাদের ফোন নং রান্নাঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। তারা ওয়ান দম্পতিকে কোনো এক দিন তাদের বাসায় নিতে চায়।
ওয়ান বলেন, যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং জীবনের শেষ মুহূর্তে চলে আসে, তাদের মনেও ওয়ানের জন্য স্থান আছে। কিছু রোগী চিকিত্সায় সুস্থ হওয়ার আশা না দেখে বাসায় চলে যায়। তারাও বিশেষ করে ওয়ানের রান্নাঘরে এসে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যায়। ওয়ান বলে, একজন রোগীর বয়স ৪০ বা ৫০ বছরের মতো, তিনি তার পরিবারকে বলেন যে, হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় যেতে পারি, কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একবার ওয়ানের রান্নাঘরে নিয়ে যাও। আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। আমি তাদের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। ওয়ান এ-কথা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি। ওই রোগী বাসায় ফিরে যান এবং কিছুদিন পর মারা যান।
প্রতিদিন রোগীদের সময় মতো খাবার খাওয়া নিশ্চিত করার জন্য ওয়ান দম্পতিকে অনেক আগে থেকেই রান্নাঘর প্রস্তুত করতে হয়। যখন রান্না করার সব মানুষ চলে যায় তারপর তারা নিজেদের খাবার খায়। বিকাল ৩টার দিকে, ওয়ান দম্পতি নিজের জন্য কিছু খাবার রান্না করেন, এটি হলো তাদের দুপুরের খাবার। তাদের রাতের খাবার আরো অনেক দেরিতে, প্রায় রাত ৯টার পর তারা খেতে বসেন।
স্ত্রী সুং স্বামী ওয়ানের কথা উল্লেখ করলে গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, আমার স্বামী চুলা সারাতে পারে, সব কাজেই তিনি দক্ষ, তিনি খুব স্মার্ট। আর স্ত্রী সুং-এর কাজ স্বামীকে 'নির্দেশ দেওয়া'।
স্ত্রী সুংয়ের জন্য স্বামী ওয়ানের মনে অনুতপ্ত বোধ করেন। তিনি বলেন, আমি ভালোভাবে স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে পারি না। আমার স্ত্রীর বয়স অনেক বেশি হলেও আমার সঙ্গে এই কঠিন কাজ করে যাচ্ছে, এজন্য আমার অনেক কষ্ট লাগে।
২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, ওয়ান দম্পতি দশ বারো বছর ধরে কাজ করা নাস্তার দোকান বন্ধ করে দেন। তবে, তাঁরা 'ক্যান্সার প্রতিরোধের ভালোবাসার রান্নাঘর' বন্ধ করেন নি। তারা নিজেদের ছেলেমেয়ের কাছে গিয়ে পরিবারের সুখী ও আরামদায়ক জীবন উপভোগ করতেও যান নি। বরং তারা এখনও এখানে মনের জোর রয়ে গেছেন। তারা রোগীদের প্রতিদিনের খাবাররক্ষী হিসেবে কাজ করছেন।
গণমাধ্যমের কল্যাণে ওয়ান দম্পতির রান্নাঘরের ঘটনা সবার কাছে পৌঁছে যায়। স্থানীয় সরকার রান্নাঘর পুনর্নির্মাণের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেয় এবং অর্থ ভর্তুকি দেয়। প্রতিদিন স্বেচ্ছাসেবকরা এখানে এসে তাদের কাজে সাহায্য করে। ছোট এই রাস্তার ছোট এই রান্নাঘরে নানা মানুষের বিভিন্ন স্বাদের জীবন চলতে থাকে।
কেউ ওয়ানকে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কত দিন এ কাজ করবে? ওয়ান বলেন, যখন আমরা আর দাঁড়াতে পারব না, ততদিন আমি তাদেরকে সাহায্য করে যাবো।