কর্কটক্রান্তির কাছাকাছি, ২০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তা ইয়াও পাহাড়ে, হাজার হাজার বছর ধরে বাস করে আসছে চীনের ইয়াও জাতির মানুষ। তারা দিনরাত পাহাড়ের সঙ্গে থাকে এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
তা ইয়াও পাহাড়ের প্রধান শিখরকে ডাকা হয় 'শেং থাং শান' এবং এর নীচে প্রবাহিত নদীর নাম তি সুই। নদীর পানি খুব পরিষ্কার, তবে এ নদী ইয়াও জাতির হ্য থুন গ্রাম ও প্রধান সড়ককে বিভক্ত করেছে। বন্যার মওসুমে নদীর পানি বেড়ে যায় এবং মানুষের পক্ষে নদী অতিক্রম করা কঠিন হয়ে যায়। আগে এমন পরিস্থিতিতে শিশুরা স্কুলে যেতে অন্য একটি পাহাড়ি পথে দশ-বারো কিলোমিটার হেঁটে। কয়েকবার নদীর উপর সেতু নির্মিত হলেও, বন্যায় সেগুলো নষ্ট হয়।
লক্ষ্যযুক্ত দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প চালু হবার পর, সরকার ও সহায়তা সংস্থার সাহায্যে নির্মিত হয় একটি সিমেন্টের সেতু ও একটি চেইন সেতু। সেতুর মাধ্যমে হেং থুন গ্রাম ও বাইরের জগত যুক্ত হয়েছে। বাইরের মানুষ এখন ইয়াও জাতির সংস্কৃতি ও শেং থাং শান পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য সম্পর্কে জানতে পারছে।
সু হং ফাং স্থানীয় একজন বাসিন্দা। তিনি নিজের বাড়িকে একটি হোটেলে রূপান্তরিত করেছেন। লম্বা ছুটির সময়ে তার হোটেলের সব রুম অনেক আগে থেকেই বুক হয়ে যায়। সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে সু হং ফাং নানান কাজ করেন। দিনে তিনি হোটেলের ব্যবস্থাপক ও গাইড হিসেবে কাজ করেন এবং রাতে তিনি একজন অভিনেত্রী হিসেবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। যখন তার হোটেল চালু হয় তখন তিনি নিজের নতুন একটি জাতীয় পোশাক তৈরি করেন। তিনি বলেন, এ পোশাকের মাধ্যমে পর্যটকদের দেখাতে চান তার সুন্দর জীবন।
পুরাতন সমাজে দরিদ্র ইয়াও জাতির একটি নাম ছিল। আর তা হচ্ছে কুও শান ইয়াও। তারা অন্যদের জমি ভাড়া করে চাষ করতেন এবং গৃহহীন জীবনযাপন করতেন। ৮০ বছর বয়সী ইয়াও জাতির প্রবীণ চাও ছেং রেন স্মৃতিচারণ করে বলেন, চাষ করার পর উত্পাদিত ফসলের ১০ ভাগের ৮ ভাগ ভাড়া হিসেবে জমিদারকে দিতে হতো। এ প্রবীণের গ্রাম থুন সি গ্রাম কুও শান ইয়াও জাতির অধ্যুষিত এলাকা। তবে এখন তার চেহারা অন্যরকম। দুটি হুয়ানশান রোড চালু হয়েছে এবং গ্রামে অনেক ভবন আছে। অনেক পরিবার দুটি গাড়ি কিনেছে। একটি ট্রাক এবং একটি সাধারণ গাড়ি। পরিবহনসহ অবকাঠামোর বড় পরিবর্তনে তা ইয়াও পাহাড়ের বিছিন্নতা দূর হয়েছে। পাহাড়ের মধ্যেও ফ্ল্যাট গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে আছে এক একটি দু'তলার সাদা রঙ্গের বাসভবন এবং প্রতিটি বাড়িঘরের সামনে লন আছে। গ্রামের রাস্তার দু'পাশে রয়েছে সৌরবাতি। চিন সিউ জেলার লিউ তুয়ান গ্রাম একটি স্থানান্তর দারিদ্র্যবিমোচন স্থল এবং তার সুন্দর নাম আছে, তা হল লা চিয়ার পরীস্থান। ইয়াও জাতির মানুষ নিজেদের লা চিয়া বলে ডাকে। ইয়াও জাতির নারী মো ইউয়ু ছুং বলে, 'আমাদের পরিবারের ৬ জন একসময় ৫০ বর্গমিটারের একটি ঘরে বাস করতাম। আগে গ্রামের মানুষ মূলত চা পাতার চাষ করতো এবং দশ-বারো কিলোমিটার দূরের জেলায় গিয়ে চা বিক্রয় করতো। ভোর ৬টায় কাজে বের হলে রাত ৯টা ফিরতে পারত। চা বিক্রির টাকা দিয়ে কেবল প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে পারত। এখন পরিবহনব্যবস্থা উন্নত হয়েছে এবং স্থানীয় মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। এখানে স্থাপিত হয়েছে জৈব চা চাষের বেস এবং এর মাধ্যমে অনেকে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন।' মো ইউয়ু ছুং নিজেও ১০ মু জমিতে জৈব চা চাষ করেন এবং তার স্বামী ব্যবসা করেন। তিনি বাড়িতে চা প্রক্রিয়াজাত করে অনলাইনে তা বিক্রি করেন।
চিন সিউ জেলার সিপিসি সাধারণ সম্পাদক জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় সরকার ১০০ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করে ১০০০টির বেশি দারিদ্র্যেবিমোচন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এখন সারা জেলার ৭৭টি গ্রামে পাকা রাস্তা আছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে চিন সিউ জেলা দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
জেলার রাজধানী থেকে ছাং থুং উপজেলা যাবার হাইওয়ের পাশে লক্ষ্যণীয় একটি বোর্ডে লেখা আছে 'ইয়াও চিয়া চুয়াং'। এখানে একটি গ্রাম পর্যটনকেন্দ্র। তার মালিক পাং ইন ফু ২০১৮ সালে জন্মস্থানে ফিরে আসেন। তখন তিনি একটি কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা খুলতে চেয়েছিলেন। কারণ, তিনি নিজে একজন কাঠমিস্ত্রি। তবে গ্রামের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পর্যটকদের আনাগোনা দেখে তার মন পরিবর্তন হয়। তিনি একটি গ্রাম পর্যটন ব্যবসা শুরু করেন। এখানে পর্যটকদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি, স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পণ্য বিক্রি হয় এবং পর্যটকরা এখানে ইয়াও জাতির ঐহিত্যবাহী স্নানপদ্ধতি উপভোগ করেন। নিজের নকশা ও তৈরি করিডোরে বসে পাং ফু ইন বলেন, পানি ও পাহাড়সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ হচ্ছে আসল সম্পদ।
তা ইয়াও পাহাড় একটি প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। আগে ইয়াও জাতির মানুষ গাছ কাটা, ওষুধ সংগ্রহ, মাছ ধরার মাধ্যমে আয় করত। তবে এ কাজগুলোতে প্রাকৃতিক পরিবেশের অনেক ক্ষতি হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন উন্নয়ন ধারণার নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক পরিবেশ পুনরুদ্ধার ও অবকাঠামো সম্পূর্ণ হবার সাথে সাথে তা ইয়াও পাহাড়ের বাসিন্দাদের আয়ও অনেক বেড়েছে।
৫৮ বছর বয়সী চাও ছেং পিন ছোটবেলা থেকে পরিবারের সঙ্গে পাহাড়ে ওষুধ সংগ্রহ করে আসছিলেন। পরে ভেষজ ওষুধ দিন দিন কমতে থাকে। কীভাবে পাহাড়ের মূল্যবান সম্পদ রক্ষা কারার পাশাপাশি মুনাফা সৃষ্টি করা যায়? ২০১৪ সালে তিনি পাহাড়ে ভেষজ ওষুধ চাষ করার চেষ্টা শুরু করেন। এখন চাও ছেং পিনের বাড়ির কাছাকাছি নানান ধরনের ভেষজ ওষুধের গাছ চাষ করা হচ্ছে এবং অদূরে চাষ-সংরক্ষণ-প্রক্রিয়াজাতকরণ-বিক্রয়ের একটি সম্পূর্ণ শিল্প চেইনও গড়ে ওঠে। এখন গ্রামে ভেষজ ওষুধ গাছের চাষের আয়তন ৭০০০মু এবং ৫০০ জন এ শিল্পে জড়িত আছেন।
কু চান, এ ইয়াও জাতির গ্রামের ইতিহাস শতাধিক বছরের বেশি আর এখানে একটি যাদুঘর আছে। তিন তলার এ ভবনে শান চি ইয়াও, এ ইয়াও জাতির শাখার আচার ব্যবহার ও রীতি-নীতি, পোশাক বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। তা ইয়াও পাহাড়ে ইয়াও জাতির চা শান, আও, হুয়া লান, পান ও শান চি—এ ৫টি শাখা বাস করে। ভাষা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আচার ব্যবহার ও রীতি-নীতি ও পোশাকসহ নানা ক্ষেত্রে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে তাদের। এ ৫টি শাখার মানুষের অধ্যুষিত গ্রামে নিজ নিজ যাদুঘরও আছে।
দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্পের মাধ্যমে জীবন পরিবর্তন হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় সংস্কৃতিও পুনরুদ্ধার হয়েছে। কু চান গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইয়াও জাতির সাংস্কৃতিক দল। তারা ইয়াও জাতির নানান ঐতিহ্যবাহী নৃত্যাঅনুষ্ঠান করেন। ২০১৯ সালে ৪ লাখের বেশি পর্যটক কু চান গ্রাম ভ্রমণ করেন। এখন ইয়াও পাহাড়ে আসলে ৫টি ইউয়া জাতির শাখার নৃত্য, উত্সব উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা।
২০১৮ সালে ২৬০টি দরিদ্র পরিবারকে 'সিং ফু লি' নামের একটি কমিউনিটিতে স্থানান্তর করা হয় এবং এর মধ্যে অর্ধেক মানুষ তা ইয়াও পাহাড় থেকে আসে। লি ওয়ে ছুয়ান তাদের মধ্যে একজন। তিনি এখন তিনটি চাকরি করেন: খাবার বিতরণ, টেলিযোগাযোগ কোম্পানির রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী এবং বাকি সময়ে গাইড হিসেবে কাজ করেন। তার স্ত্রী নাচ করতে পছন্দ করেন এবং নিজের একটি স্টুডিও খুলে নাচ শিখিয়ে থাকেন। কখনও কখনও কমিউনিটির নারী ও শিশুদের জন্য বিনামূল্যে ক্লাস নেন। লি ওয়ে বলেন, 'সরকারের নীতিগত সমর্থনে প্রচেষ্টা চালিয়ে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমাদের জীবন এখন সুখী।' (শিশির/আলিম/রুবি)