সিয়াও লিয়াং বলে, যেন বাবা মা দূরে যাওয়া ছেলেমেয়ের জন্য সবসময় দরজা খুলে রাখে, উদ্ধারকেন্দ্রের ভাই বোনরাও আমার জন্য সবসময় একটি টেবিল রাখবে, আমার জন্য একটি বাতি জ্বালিয়ে রাখবে। কারণ, এটিই আমাদের বাসা, এখানে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষরা থাকে।
৭ জুলাই ছিল শাংহাই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার দিন। শাংহাই শহরের ইয়াং ভু উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষার একটি স্থান। উচ্চ বিদ্যালয়ের বাইরে ইয়াং ভু উদ্ধারকেন্দ্রের কর্মীরা দাঁড়িয়ে তাদের 'মেয়ে' সিয়াও লিয়াংকে মানসিক শক্তি দিয়েছিল।
উদ্ধারকেন্দ্রের কর্মী লি হুই বলেন, পরীক্ষার আগের দিন রাতে, আমি সিয়াও লিয়াংয়ের চেয়েও বেশি উত্তেজিত ছিলাম। আশা করছিলাম, পরীক্ষার পর তার আরো সুন্দর জীবন শুরু হবে। অন্যদিকে, তাকে চলে যেতে দিতেও মন চাচ্ছিল না!
আসলে সিয়াও লিয়াং-এর একটি দুর্ভাগ্যজনক শৈশবকাল আছে। মাত্র ৫ বছর বয়সে তার বাবা রোগে ভুগে মারা যায়। তার মা তখন থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাকে ইয়াং ভু উদ্ধারকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সিয়াও লিয়াংকে আরো ভালো জীবনযাপনের পরিবেশ দিতে তখনকার ইয়াং ভু উদ্ধারকেন্দ্রের প্রধান লি ফু ছিয়াং এবং ইয়াং ভু এলাকার কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা করেন। এ কারণে, উষ্ণ হৃদয়ের দম্পতি মিস হু এবং মিস্টার খুং সিয়াও লিয়াংয়ের পালক অভিভাবক হন। সিয়াও লিয়াং তাদের সঙ্গে আট বছর ছিল। ২০১৫ সালের শেষ দিকে ওই দম্পতির পারিবারিক কারণে সিয়াও লিয়াংয়ের লালন-পালন চুক্তি এগিয়ে নিতে পারে নি। আবারও সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্র সিয়াও লিয়াংকে গ্রহণ করে। এই শিশু রক্ষাকেন্দ্রটি ঠিক যেন তার দ্বিতীয় বাড়ি।
সিয়াও লিয়াং-এর জন্মদাতা বাবা-মা বিয়ে করে নি। এ কারণে সিয়াও লিয়াং-এর 'পারিবারিক নিবন্ধন' নেই। আর চীনের উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে 'পারিবারিক নিবন্ধন' খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি না হলে সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। যদি এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে, সিয়াও লিয়াং-এর লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যাবে, সিয়াও লিয়াং খুব সম্ভবত সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্র থেকে আর কখনও বের হতে পারবে না এবং নিজের ভবিষ্যতও গড়তে পারবে না! তাই সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রের কর্মীরা সিয়াও লিয়াং-এর পরিবার নিবন্ধনের জন্য বহু বছর ধরে চেষ্টা করতে থাকেন।
এরপর চীনে 'পারিবারিক নিবন্ধন না-হওয়া নাগরিকদের সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব' গৃহীত হয়। এতে করে সিয়াও লিয়াং-এর 'পারিবারিক নিবন্ধন' সমস্যার সমাধান হয়। সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্র ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এ সুযোগে খুব দ্রুত সিয়াও লিয়াং-এর 'পারিবারিক নিবন্ধনের' কাজটি সম্পন্ন করে। ফলে সিয়াও লিয়াং সে বছরের উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
'পারিবারিক নিবন্ধন' সনদ পাওয়ার সেই মুহূর্তে, সিয়াও লিয়াং আনন্দে কেঁদে দেয়। সে বলে, আমি অবশেষে লেখাপড়া করতে পারছি। অন্যরা জন্ম থেকে যে অধিকার পায়, আমি ১৫ বছর বয়সে সেই অধিকার পেয়েছি।
উচ্চ বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে সিয়াও লিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষার আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সিয়াও লিয়াং-এর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে অনেক সাহায্য করে। ইয়াং ভু এলাকার কর্তৃপক্ষ ভালো মানের স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে সিয়াও লিয়াংকে পাঠদান করায়। আর 'অতি দরিদ্র পরিবারের ভালো শিক্ষার্থীদের' জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিনা খরচে প্রশিক্ষণ ক্লাসের ব্যবস্থা করে। সিয়াও লিয়াংও তাতেও যোগ দেয়।
জানালা দিয়ে বাইরের নরম আলো আসছে। ঘরটি খুব পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। পড়ার টেবিলে প্রতি ঘণ্টায় লেখাপড়ার একটি সময়সূচি লাগানো আছে। সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রে সিয়াও লিয়াং-এর জীবন ছিল সুষ্ঠু, আরামদায়ক ও আনন্দময়।
সিয়াও লিয়াং-এর ১৮তম জন্মদিনে সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্র একটি বিশেষ জন্মদিন উদযাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ঘরে গোলাপি রংয়ের বেলুন দিয়ে সাজানো হয়; বিভিন্ন রকমের উপহার টেবিলে রাখা হয়। দেয়ালেও লেখা হয় বিভিন্ন শুভকামনা। ইয়াং ভু সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রের কর্মীরা পুরো সকালে সিয়াও লিয়াং-এর জন্মদিন উদযাপনী অনুষ্ঠানের জন্য ব্যস্ত থাকে। যাতে সিয়াও লিয়াং নতুন জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
উদযাপনী অনুষ্ঠানে সিয়াও লিয়াং বলে, যে জন্য আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ বোধ করি তা হলো, বছরের পর বছর ধরে আমার প্রতি সবার যত্ন ও সাহায্য। আন্টি সবসময় এক দিন আগে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আমি কী কী খেতে চাই। পরের দিন আমার জন্য সে খাবারই রান্না করতেন তিনি। ড্রাইভার চাচা সকালবেলা সবার আগে ওঠেন। আবহাওয়া যত খারাপই হোক না কেন, তিনি প্রতিদিন সময়মতো আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন এবং স্কুল থেকে আমাকে উদ্ধারকেন্দ্রে নিয়ে আসতেন।
সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রের প্রধান জুই চিয়া তিং বলেন, ২০১৫ সালে সিয়াও লিয়াং এখানকার শিশু রক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি হয়। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তাকে নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও ভালোভাবে লেখাপড়া করানোর জন্য এখানকার বেশ কয়েকজন কর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাতে সিয়াও লিয়াং-এর জীবন গঠন, লেখাপড়া, শরীরচর্চা ও মানসিকভাবে সাহায্য করা যায়।
সিয়াও লিয়াং-এর মতো সবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রের ক্যান্টিনে প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা হতো। পরীক্ষার সময়, প্রতিদিন ডিম, দুধ, ফল নিশ্চিত করা হতো। সাপ্তাহিক ছুটিতে সিয়াও লিয়াং-এর পছন্দ মতো আরো কিছু সুস্বাদু খাবার রান্না করা হতো। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া এবং স্কুল থেকে ঘরে ফিরে আসার জন্য বিশেষ ড্রাইভার ও গাড়ি প্রস্তুত রাখা হতো।
সিয়াও লিয়াংকে যে ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে বড় করা হয়েছে, তা পরিবার নিবন্ধনের পরই শেষ হয়ে যায় নি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তার জন্য 'নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক নিশ্চয়তা ভর্তুকির' আবেদন করে। এ বছরের মার্চ মাসে সব প্রক্রিয়া শেষ হয়। এখন প্রতি মাসে ১৯০০ ইউয়ান 'জীবনযাপনের ফি' পায় সিয়াও লিয়াং। উদ্ধারকেন্দ্রের একজন কর্মী তার জন্য এ অর্থ ব্যবস্থাপনা করে। এ অর্থ দিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বহন করা যাবে।
সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রসহ প্রত্যেকের ভালোবাসা ও সাহায্যের কথা সিয়াও লিয়াং মনে রেখেছে এবং তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সবার ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞতা জানায়।
সিয়াও লিয়াং বলে, জন্মদিনে সে তিনটি 'প্রার্থনা' বা 'উইশ' করেছে। একটি হলো, শিশুবেলায় তাকে আট বছর ধরে লালন-পালন করা পরিবারে একবার যাওয়া। সেই ইচ্ছাপূরণ হয়েছে।
আরেকটি হলও, সহপাঠীর সঙ্গে স্নাতকের সময় একবার ভ্রমণ করা।
অন্য আরেকটি আশা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হলো, সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রের সাবেক প্রধান লি ফু ছিয়াং-এর কবরে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা। তিনি সিয়াও সিয়াং-এর 'উদ্ধারকেন্দ্রের বাবার' মতো তাকে একটি বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিয়েছেন। সে 'উদ্ধারকেন্দ্র বাবার' কবরের কাছে গিয়ে বলতে চায়, 'বাবা, তোমার মেয়ে এখন বড় হয়েছে। সে এখন ভালোভাবে লেখাপড়া করে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। বাবা, আমি তোমার চাওয়া বাস্তবায়ন করেছি!'
মৃত লি ফু ছিয়াং এর আগে সিয়াও লিয়াংকে বলেছিলেন, মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে ঝড়-বৃষ্টি-দুর্যোগ আসে। কিন্তু তারপর চেষ্টা করলে নিজের জীবনকে সুন্দর করা যায়।
১৮তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সিয়াও লিয়াং স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে, সে বড় হয়ে গেছে। এখন আর চাচা-চাচি ও ভাই-বোনদের ওপর নির্ভর করা ঠিক না। এখন নিজের স্বাধীন জীবন শুরু করার সময় এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে সিয়াও লিয়াং-এর নিজস্ব চিন্তা আছে। যেমন, কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হওয়া, একজন স্বেচ্ছাসেবক হওয়া, অন্য মানুষকে সাহায্য করা ইত্যাদি। সিয়াও লিয়াং চিকিত্সক হতে চায়, কারণ চিকিত্সকরা মানুষকে সাহায্য করতে পারে; অন্যকে ভালোবাসা দিতে পারে।
সিয়াও লিয়াং-এর মতো অনেক শিশু এভাবে চীনের সামাজিক উদ্ধারকেন্দ্রগুলোতে বেড়ে উঠছে। এই কেন্দ্রের প্রধান জুই চিয়া তিং বলেন, আমাদের টেকসইভাবে এই কল্যাণমূলক কাজ করে যেতে হয়, অসহায় শিশু-কিশোরদের বিশেষ সেবা দিতে হয়। তাদের ভালো চরিত্র ও ভালো জীবনের জন্য মনোভাব জাগিয়ে তুলতে হয়; যাতে তারা জীবন পরিবর্তন করার মানসিক ও বাস্তব সামর্থ্য অর্জন করতে পারে।
জন্মদিনের সভায় সিয়াও লিয়াং অনেক উপহার পেয়েছে। তার সবচেয়ে পছন্দের হলো 'সূর্যের ফুল'। সিয়াও লিয়াং এতিম হলেও সবসময় 'সূর্যের ফুলের' মতো চারদিকে আলো বিলাতে চায়।