আকাশ: সুপ্রিয় শ্রোতা, সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠানে। আপনাদের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আমাদের সাপ্তাহিক আয়োজন 'রোববারের আলাপন'। আপনাদের সঙ্গে আছি আলিম এবং শিয়েনান আকাশ।
বড় ভাই, এখন গ্রীষ্মকাল । গ্রীষ্মকাল আমার সবচেয়ে পছন্দের ঋতু।
আলিম: আমি জানি আপনার গরম সবচেয়ে ভয় লাগে, তাই না? আমি মাঝে মাঝে দেখছি গরমকালে আপনি সবসময় ঘামেন; বিশেষ করে উত্তরায় আপনার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই আমি তা লক্ষ্য করেছি!
আকাশ: হা হা বড় ভাই, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি সত্যি গরম কালে অনেক কষ্ট পাই, বিশেষ করে উত্তরায় থাকার সময়। সবসময় ঘামতে থাকি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমি গ্রীষ্মকাল সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। কারণ, আমার ধারণা, গ্রীষ্মকাল মানে আশা, আগ্রহ, এবং জীবন আবার নতুন করে শুরু করা।
আলিম: জীবন আবার শুরু করা? মানে দ্বিতীয় জীবন? খুবই মজার।
আকাশ: হ্যাঁ। হয়ত প্রত্যেক মানুষ দ্বিতীয় জীবন চায়, তাই না? আসলে আমাদের অতীত অবশ্যই ফিরে আসতে পারে না; কিন্তু যদি এখনকার প্রতিটি মুহূর্ত আমরা কাজে লাগাই তবে একটা নতুন জীবন তো শুরু হবে, তাই না? বড় ভাই, আপনার প্রিয় ঋতু কোনটি?
আলিম:...
আকাশ: বন্ধুরা, উত্তরায় থাকার সময়, প্রতিদিন সকালে অফিস শুরুর আগে বা সন্ধ্যায় সব কাজ শেষের পর, আমি সবসময় সেক্টারের পার্কে দৌড়াতাম। অনেক সময় দৌড়ানোর পর, ঘামে আমার জুতাও ভিজে যেতো। কিন্তু দৌড়ানোর পর এক-দুইটা কচি ডাব খেলেই আমি ফ্রেস হয়ে যেতাম। বন্ধুরা, আজকে আমরা চীনের একজন বাবা ও ছেলের ম্যারাথনের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করব, কেমন?
সংগীত
আলিম: "সুখ মানে কী? সুখ হয়ত একটা বোকা বাবার সঙ্গে একটি বোকা ছেলের মিলন।" বন্ধুরা, একজন বাবা, তাঁর নাম হচ্ছে লুও সু চিয়ান, তিনি এ বাক্য লিখেছেন। এ গল্প বাবা ও তাঁর ছেলের প্রসঙ্গে। তাঁর ছেলে cerebral palsy রোগে ভুগছে। তাকে আনন্দ দেয়ার জন্য বাবা তাঁকে ট্রলিতে করে ঠেলে ঠেলে ৪০টিরও বেশি ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এ গল্প ভালবাসা ও যত্নের গল্প।
আকাশ: বাবা ১১ বছর বয়সী লুও চি পাইকে উদ্দেশ্য করে লিখেন:
'তুমি ভাল আছো? আমি তোমার বাবা লুও সু চিয়ান । এখনও তুমি আমাকে 'বাবা' ডাকোনি, হয়ত সারাজীবন আমি এটা শুনতে পারব না। ২০০৯ সালের ৮ নভেম্বরে তোমার জম্ম হয়। আমি এবং তোমার মা সেই দিনটির প্রত্যাশায় ছিলাম। কিন্তু, তোমার জন্ম আমাদেরকে একটি বড় আঘাত দিয়েছে। জম্মের পর তুমি কাঁদোনি। ১৫ মিনিট পর তুমি আক্রান্ত হও cerebral palsy রোগে। চিকিৎসকের মন্তব্য দেখে আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি! "cerebral palsy!?" আমরা তোমাকে নিয়ে অনেক বড় হাস্পাতালে গিয়েছি, অনেক বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছি। কেউ কেউ বলেন, এক বা দুই মিলিয়ন ইউয়ান খরচ করলেও এ রোগ সারবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, আশা আছে। যদি আশা থাকে, তবে হাল ছাড়বো না। তোমার চিকিৎসা শুরু হলো। চিকিৎসা মানে বিশেষ থেরাপি। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে থেরাপি শুরু হয়। শুরুতে তুমি অনেক কাঁদতে, তোমার মা-ও কাঁদতো। কিন্তু থেরাপি চলতে থাকল। ৮১৮ দিন পর তুমি হাঁটতে শুরু করলে! আমি এবং তোমার মা তা দেখে খুশিতে কাঁদলাম এবং হাসলাম। কিন্তু একটু যখন আশার আলো দেখছি, তখন দ্বিতীয় আঘাত এলো। তিন মাস পর তুমি epilepsy রোগে আক্রান্ত হলে। হাঁটতে গেলে পড়ে যাও; প্রতিদিন বিশ থেকে ত্রিশ বার এমনটা হতে লাগলো। থেরাপি স্থগিত রাখতে হয়। এরপর আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক বাবা ও ছেলের ভিডিও দেখি; দেখে চমকে উঠি।
মার্কিন ছেলে রিকের জম্মের সময় Hypoxiaর কারণে তার ব্রেনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তার বাবা ডিক আবিষ্কার করেন যে, রিক খেলাধুলা পছন্দ করে। এরপর তিনি তাঁকে ট্রলিতে বসিয়ে একসাথে ১১৩০টি দৌড় প্রতিযোগিতা ও ২০০টিরও বেশি আয়রনম্যান ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ২০১১ সালে বোস্টন ম্যারাথন প্রতিযোগিতার আরম্ভবিন্দুতে তাদের দুঁজনের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
আমিও দেখতে পেলাম যে, তুমি অন্য মানুষের দৌড় দেখে আনন্দ পাও, তাদের পেছনে পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করো। ওই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও তোমাকে নিয়ে একসাথে ম্যারাথনে অংশ নেব!
তাঁরা বলল, তুমি বুড়ো হয়ে গেছো; তুমি কি পারবে?
আমি বলি, এখন হয়তো পারব না; কিন্তু সমস্যা নেই, চর্চা শুরু করি। সেই থেকে প্রতিদিন ভোর ৪টায় উঠে আমি প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি।
২০১৫ সালের পয়লা নভেম্বর, তোমার মনে আছে? এদিন আমরা প্রথমবার হাং চৌয়ে ম্যারাথনে অংশ নিলাম।
তুমি দেখে অনেক খুশি হয়েছিলে। তুমি যখন-তখন খুশিতে হাত নাড়ছিলে। ডিসেম্বর, ওযেন চৌ ম্যারাথন, পরের বছরের মার্চ, উ সি ম্যারাথন, এপ্রিল হেং তিয়ান ম্যারাথন, জুন, লান চৌ ম্যারাথন, সেপ্টেম্বর, বেইজিং ম্যারাথন...
৫ বছরে আমরা একযোগে ৪০টিরও বেশি ম্যারাথনে দৌড়েছি, মনে আছে তোমার?
প্রতিবার ম্যারাথনের দিনের সকালে, তুমি অনেক আগে ঘুম থেকে উঠতে। প্রতিবার দৌড়ানোর সময় তুমি ভীষণ খুশি হতে। তুমি তোমার নিজের পায়ে বেশিদূর যেতে পারতে না। কিন্তু তাতে কী? আমি আমার দু'টি পা ও বাহু তোমাকে দিতে পারি! তুমি এ দিয়ে বাইরের জগত দেখতে পারো!
কেউ কেউ বলতো, তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে দৌড়াও বিখ্যাত হওয়ার জন্য। তুমি সবার সহানুভূতি চাও, তাই না?
আসলে, কে কী বলল, আমি তা সত্যি পরওয়া করি না।
আমি অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে চাইনি। কারণ, আমি দেখেছি আমার ছেলের মতো ছেলে অনেক পরিবারে আছে। তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ। আমি দেখেছি, এমন শিশুর জন্য অনেক পিতামাতা ডিপ্রেশনে ভুগছেন, কোনো কোনো সংসার ভেঙ্গে গেছে, কেউ কেউ এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে! আর আমরা আনন্দ করছি, দৌড়াচ্ছি। কেন আমরা এমনটা করব না?!
এজন্য আমি তোমাকে নিয়ে দৌড়াতে থাকবই। ভবিষ্যতেও এটা করবই। আশা করি এতে আমাদের মতো পরিবারগুলোও কিছু একটা করার আগ্রহ পাবে; তারাও নিজেদের বাচ্চার যত্নে বিশেষ কিছু করবে।
অবশ্যই আমরা অনেক দয়ালু মানুষের দেখাও পেয়েছি। কেউ কেউ আমাদের উৎসাহিত করেছেন; বলেছেন: সামনে এগিয়ে যাও। কেউ কেউ আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছেন। একজন আন্টি আমাদের দৌড়ের পথে দুধ এগিয়ে দিয়েছেন। একজন আপু তোমাকে সরাসরি কিছু অর্থ সাহায্য হিসেবে দিতে চেয়েছেন....
আসলে, আমার প্রত্যাশা হচ্ছে, তুমি বাইরে গেলে, মানুষ তোমাকে একটি মৃদু হাসি উপহার দেবে; সেটাই হবে যথেষ্ট।
তুমি এখন ১১ বছর বয়সী। কিন্তু তোমার আইকিউ এক বছর বয়সী বাচ্চার মতো। হয়তো সারাজীবন তা-ই থাকবে।
তুমি শক্ত কিছু খেতে পারো না। তোমার মা তোমার জন্য নরম খাবার তৈরি করে। তোমার জম্মের পর, তোমার মা আর চাকরি করেনি; তার কাজ কেবল তোমার যত্ন নেওয়া। আমি সরবরাহকর্মী হিসেবে কাজ করি।
তোমার একটি ছোট বোন আছে। সে বাইরে কোনো খাবার খেলে তোমার জন্যও খানিকটা নিয়ে আসে। দু' বছর আগে, সে একটি বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। সেখানে সে আমাদের দু'জনের গল্প বলেছে। সে বিশেষ একটি পুরস্কারও পেয়েছে।
আমি একটি বাক্য অনেক পছন্দ করি, তা হচ্ছে: "Don't ask about harvest, but ask about cultivation"। দিন এরকমই, নদী বয়ে চলার মতো।
যদি সুস্থ হয়ে ওঠা এতোই কঠিন, তবে আমার একমাত্র তোমার জন্য প্রার্থনা: তুমি আনন্দে থাকো।
বাবা, সারাজীবন তোমার পাশে থাকব।
তোমার বোকা বাবা,
লুও সু চিয়ান।
বন্ধুরা, জনাব লুও সু চিয়ানের Wechat Momentsর signature হচ্ছে: "জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জয়ী হওয়া নয়, বরং তা হচ্ছে ভালবাসা।"
৫ বছর ধরে, তিনি তার ছেলে ও ভালবাসা নিয়ে এ লম্বা জীবনের ম্যারাথনে দৌড়াচ্ছেন। আশা করি, আমরা সবাই একে অপরকে আনন্দ দেওয়া চেষ্টা করে যাবো এবং এভাবে বিশ্বটা সুন্দর হবে। ভাইয়া, এ গল্প শুনে আপনার কেমন লাগল?
আলিম:....