শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম মহামারি যেন বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা, মূল্যবোধ, সহযোগিতা, ও প্রশাসনকে বড় পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ যেন বর্তমান সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে।
বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের প্রধান সম্পাদক তাঁর সর্বশেষ লেখায় একটি প্রশ্ন করেছেন: কোভিড-১৯-এর আরকেটি বিপর্যয়কে কীভাবে বাধা দেওয়া যায়? এটা শুধু তার প্রশ্ন, তা নয়। এর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে গোটা মানবজাতিকে। কীভাবে এ ধরনের মহামারির পুনরাবির্ভাব ঠেকানো যায়? যুদ্ধ, সংর্ঘষসহ প্রচলিত নিরাপত্তা ইস্যু থেকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও ইন্টারনেট হামলাসহ আধুনিক নিরাপত্তা হুমকি পর্যন্ত মানুষের নিরাপত্তা-ধারণা প্রসারিত হচ্ছে। স্প্যানিস ফ্লু, এইডস্, সার্স, ইবোলা, ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বার বার আমাদেরকে জৈবঝুঁকি মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সর্তক করে দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে এখন পযন্ত বিশ্বব্যাপী ৭ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অর্থনৈতিক উত্পাদন, সামাজিক জীবন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পরিস্থিতি—সবকিছুর ওপর এই মহামারির নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মানুষের জন্য ভাইরাস সবসময়ই বড় ধরনের হুমকি। নোবেলবিজয়ী জীববিজ্ঞানী জোশুয়া লেডারবার্গ একবার এ কথা বলেছেন। কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় মানবজাতির নিরাপত্তা ইস্যু আবারও গুরুত্ব পাচ্ছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস মানুষের সঙ্গে আপস করে না। যখন মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়, তখন সে দেশ, জাতি, ধর্মের পার্থক্য করে না। মহামারি এক দেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের কোনো দেশই এ মহামারির বাইরে থাকতে পারে না।
চীনের নেতারা যৌথ, ব্যাপক, সহযোগিতামূলক ও টেকসই নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টির কথা বলেন। তারা স্নায়ুযুদ্ধের চিন্তাভাবনা ও গ্রুপভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারণার বিরুদ্ধে কথা বলেন। কোনো একটি দেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ধারণারও তারা ঘোর বিরোধী। তাদের কথা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলেই কেবল বিশ্বের সকল দেশ শান্তি ও উন্নয়ন উপভোগ করতে পারবে। তারা আরও মনে করেন, কোন উপায়ে সংকট মোকাবিলা করা হলো, সেটা বড় কথা নয়; বড় কথা হচ্ছে, মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
একেক দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি একেক রকমের; অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নের মানও ভিন্ন। মহামারি মোকাবিলায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে এবং ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে মহামারি প্রতিরোধ করা গেলে, তা-ই করতে হবে। তবে জীবন রক্ষা করা মানবজাতির অভিন্ন মূল্যবোধ। জীবন ও স্বাস্থ্যের অধিকার মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ কোনো কোনো দেশ রাজনৈতিক স্বার্থ ও অর্থকে প্রথম স্থানে রেখে মহামারির শীর্ষ সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছে, নির্বাচনী কার্যক্রম চালু করেছে। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। মহামারি আরও মারাত্মকভাবে ছড়িয়েছে। এসব দেশে অনেক দরিদ্র মানুষ চিকিত্সাসেবা পায় না; নার্সিং হোমগুলোতে প্রবীণরা উপযুক্ত যত্ন পায় না। কিন্তু চীন মহামারি মোকাবিলায় নিয়েছে সর্বোচ্চ মানবিক ব্যবস্থা। যে-কোনো মূল্যে মানুষের জীবন বাঁচানোকেই মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেন চীনের নেতারা। পাকিস্তানের পণ্ডিত মাহমুদ হাসান খান বলেন, মহামারির মোকাবিলায় চীন সময়মতো, কার্যকর, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল কাজ করেছে। এর থেকে আন্তর্জাতিক সমাজ অনেক কিছু শিখতে পারে।
কিছুদিন আগে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আদ্হানম সাংবাদিক সম্মেলনে চোখে অশ্রু নিয়ে বলেন: কেন আমরা মতভেদ দূর করে ঐক্যবদ্ধ থেকে মহামারি প্রতিরোধ করতে পারব না? গেল এক শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা ও বৈশ্বিক আর্থিক সংকট মানবজাতি ঐক্যবদ্ধ থেকে কাটিয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার জন্য ঐক্য অনেক প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় মানবজাতির মধ্যে সেই ঐক্যের অভাব প্রকট।
কোনো কোনো বড় দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিত্সা খাতে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু তারা মহামারি মোকাবিলায় অবিশ্বাস্যভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মহামারি মানবজাতির অভিন্ন শত্রু এবং একে পরাজিত করা আন্তর্জাতিক সমাজের অভিন্ন কর্তব্য। কোভিড-১৯ মহামারি যেন দেশ ও বিশ্ব প্রশাসনের মানের একটি ব্যবহারিক পরীক্ষা। বিশ্বব্যাপী মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্ব প্রশাসনব্যবস্থা আরও কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ করে গড়ে তোলা জরুরি ব্যাপার। কোনো কোনো দেশের অজ্ঞানতা, সমন্বয় ও চিকিত্সাসম্পদের অভাবের কারণে মহামারি গুরুতর আকার ধারণ করে। বিশ্বব্যাপী মহামারি পর্যবেক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিত্সাসহ নানা ক্ষেত্রে দেখা যায় নানান অভাব। এখন এসব বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার।
মানুষের ওপর ভাইরাসের আক্রমণ কখনও শেষ হবে না এবং মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি এখনও কষ্টকর ও জটিল। এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে বিশ্ব প্রশাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করা। মহামারি প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে হবে, চিকিত্সাসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিরোধক ওষুধের গবেষণাকাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কেবল বহুপক্ষবাদ রক্ষা করলে, ন্যায় ও কার্যকর বিশ্ব প্রশাসনব্যবস্থা ত্বরান্বিত করলে সহজে মহামারির মতো নানান ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরহিস বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ঐক্যবদ্ধ থাকলে, বিশ্ব প্রশাসন জোরদার করলে, শক্তিশালী বহুপক্ষীয় সংস্থা থাকলে মানবজাতি শক্তিশালি হতে পারবে। এ বিশ্বে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এর মোকাবিলায় সঠিক চেতনা, সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রশাসনব্যবস্থা ও দক্ষতার উন্নয়ন প্রয়োজন।
মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাস ও মহামারি প্রতিরোধের ইতিহাস পাশাপাশি এগিয়েছে। কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে আমাদেরকে। কোভিড-১৯ মহামারিকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে মানবজাতি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে—এমন আশা করি। (শিশির/আলিম/রুবি)