কুই চৌ চীনে সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশগুলোর অন্যতম এবং দারিদ্রবিমোচনের মূল যুদ্ধক্ষেত্র। বিগত কয়েক বছরে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ বাছাই করে গ্রামের সিপিসি সম্পাদক, গ্রামের প্রধান বা গ্রাম কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং তারা দারিদ্র্যবিমোচন কাজে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। স্থানীয় মানুষ তাদেরকে 'সৈনিক প্রধান' বলে ডাকেন। তাদের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা দারিদ্র্যবিমোচনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে এখন সচ্ছল জীবনের দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
কুই চৌ প্রদেশের আন সুন শহরের চিও হুয়াং গ্রামের স্থানীয় মানুষ ফসল ফলান। তারা চাইভস্ (Chives) চাষ করেন এবং গ্রামের নামও 'চাইভস্'। উত্পন্ন সবজিগুলো পরিষ্কার করা হয় এবং প্যাকেজকেন্দ্রে পাঠানো হয়। তারপর ফ্রিজ-ট্রাকের মাধ্যমে কুয়াং তুং, শাংহাই ও চেচিয়াংসহ নানান জায়গায় পাঠানো হয়।
চিও হুয়াং গ্রামের প্রধান ইয়াং সুও লিয়াং কৃষকদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি মু জমিতে ৩০০০ কেজি চাইভস্ ফলে এবং প্রতি কেজির দাম ৪ ইউয়ান। কৃষকরা যদি এক মু জমিতে চাইভস্ চাষ করেন তাহলে তাদের আয় হবে ১২ হাজার ইউয়ান। আর পরিষ্কার ও প্যাকেজিংয়ের পরে প্রতিকেজি চাইভসের দাম পড়ে ১২ ইউয়ান।
কয়েক বছর আগে, চিও হুয়াং গ্রামের অন্য এক পরিস্থিতি ছিল। এখানে বিশেষ একধরনের চাইভস্ ফলতো। কিন্তু স্থানীয় মানুষ চাইভস্ চাষ করতে চাইতে না। অধিকাংশ মানুষ ভূট্টা চাষ করতেন এবং পরিবারের গড় বার্ষিক আয় ১০ হাজার ইউয়ানের কম ছিল। সারা গ্রামের ৬৩৭৩ জনের মধ্যে ১৬৪৫ জন দরিদ্র এবং দরিদ্রতার হার ছিল ২৫.৮ শতাংশ।
চার বছর সৈনিক হিসেবে কাজ করার পর ইয়াং সুও লিয়াং অবসর নেন এবং সবজির ব্যবসা শুরু করেন। ইউন নান, কুয়াং সি ও হু নানসহ নানান জায়গা থেকে সবজি নিয়ে এখানে বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। কয়েক বছরে ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেন যে, চাইভস্ দারিদ্র্যবিমোচনকাজে লাগতে পারে। ২০১৬ সালে তিনি গ্রামের প্রধান হন এবং তিনি গ্রামবাসিন্দাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তার নেতৃত্বে সবাই দারিদ্র্যমুক্ত হবেন এবং সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারবেন। তিনি বলেন, দারিদ্র্যবিমোচনও একটি যুদ্ধ এবং সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে জয় লাভ করতে হবে।
তার প্রথম কাজ হল সড়কনির্মাণ। পরিবহন অবকাঠামো ভাল হলে পণ্যগুলো সময়মতো পাঠানো যাবে। তার দ্বিতীয় কাজ হল চাইভস্ চাষের পক্ষে প্রচারণা চালানো। স্থানীয় মানুষ চাইভস্ চাষ করতে চায় না। তাই তিনি ও অন্য ৭৪ জন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক কয়েকটি গ্রুপ করেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে স্থানীয় মানুষের কাছে সরকারি নীতি ব্যাখ্যা করেন। জমি ভাড়া ও অর্থ সমন্বয় বিষয়ে সহায়তা দেন এবং গ্রামে কোম্পানির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
চাইভস্ বিক্রির জন্য ইয়াং সুও লিয়াং ৩২ জনকে নিয়ে একটি 'কমান্ডো' গঠন করেন এবং চীনের নানান প্রদেশে গিয়ে বাজারের সুযোগ খুঁজে নেন। তারা কুয়াং তুং ও শাংহাইয়ের কয়েকটি বড় বাজার ও সুপারমার্কেটের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বর্তমানে চিও হুয়াং গ্রামে ৬০০০ মু জমিতে চাইভস্ চাষ করা হচ্ছে এবং বার্ষিক উত্পাদনের পরিমাণ ৪২০০ টন। এ শিল্পের মাধ্যমে মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং ২০১৯ সালে গ্রামের বাসিন্দাদের বার্ষিক নিষ্পত্তিযোগ্য আয় ১৬ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়েছে। ৩ বছরে চিও হুয়া গ্রাম একটি দরিদ্র গ্রাম থেকে উন্নত গ্রামে পরিণত হয়েছে।
আন সু শহরের পু ই ও মিয়াও জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলার ই সুও নামে একটি গ্রামে, প্রধান ইয়াং পিংও ব্যস্ত জীবন কাটান। তার নেতৃত্বে সবাই বেগুন চাষ করে। গ্রামে এখন ১২০০ মু জমিতে সবজি চাষ করা হয় এবং প্রতিদিন দশ-বারো টন সবজি বাইরে পাঠানো হয়। ২০০১ সালে বাহিনী থেকে অবসর নেন ইয়াং পিং। এর পর থেকে তিনি নানা ধরনের কাজ করছেন। গ্রামপ্রধান হবার পর তার উদ্যোগে গ্রামে বেগুন, শসা এবং আদার চাষ শুরু হয়। এ সবজিগুলো পর্যায়ক্রমে বাজারে যায়। বিশেষ করে বেগুন মে মাস থেকে বছরের শেষ দিক পর্যন্ত চাষ হতে পারে বলে গ্রামবাসিন্দারা সারা বছর ধরেই বলতে গেলে বেগুন চাষ করে। এতে তাদের আয় বেড়েছে। বর্তমানে ই সুও গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং গ্রামের বাসিন্দাদের বার্ষিক নিষ্পত্তিযোগ্য আয় ২০১৪ সালের ৪৬০০ ইউয়ান থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০১৯ সালের ১০ হাজার ইউয়ানে।
কুই চৌ অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক বিষয়ক বিভাগ থেকে জানা গেছে, বিগত কয়েক বছরে মোট ৯১১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিককে বাছাই করে গ্রামের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং তারা দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমের ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছেন।
২০১৬ সালে, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সিয়াও চেং ছিয়াং গ্রামের সিপিসি সম্পাদক হন। তিনি আবিষ্কার করেন যে, গ্রামের কাজ সুষ্ঠুভাবে চলছে না এবং তার মূল কারণ হল ক্যাডারদের প্রতি স্থানীয় মানুষের অসন্তুষ্টি। গ্রামবাসিন্দারা বলেন, যখন তাদের সাহায্য দরকার তখন গ্রামের সরকারি অফিসে কাউকে পাওয়া যায় না। এর পর স্থানীয় মানুষের মতামত অনুযায়ী এবং উপরের স্তরের সিপিসি কমিটির অনুমোদন পেয়ে, তিন জনকে ক্যাডার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এখন নতুন নির্বাচিত গ্রাম-প্রধানদের গড় বয়স ৩৮ বছর। তারা প্রাণবন্ত একটি করে দল গঠন করেন। সিয়াও চেং ছিয়াং বলেন, তিনি একজন সৈনিক ছিলেন এবং সৈনিকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল নিয়ম মেনে চলা। দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমে সফল হতে চাইলে সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাই বাহিনীর ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, সিয়াও গ্রামের নেতাদের জন্য নিয়ম তৈরি করেন তিনি। সময়মতো আফিসে যেতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে অফিস বন্ধ করা যাবে না। প্রতি সোমাবর ও শুক্রবার নিয়মিত মিটিং করতে হবে এবং মিটিংয়ে সবাই একসাথে নীতি, প্রযুক্তি ও বাজারের সংশ্লিষ্ট জ্ঞান শিখবেন। পাশাপাশি ক্যাডার মূল্যায়ন ফর্ম তৈরি করা হয়। গ্রামবাসিন্দারা ক্যাডারদের মূল্যায়ন করেন। যারা উচ্চ স্কোর পান তাদেরকে পুরস্কার দেওয়া হয় এবং যারা নিম্ন স্কোর পান তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়। এখন গ্রামে জনসাধারণ ও ক্যাডারদের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভাল এবং ২০১৮ সাল থেকে ক্যাডারদের প্রতি গ্রামবাসিন্দাদের সন্তোষের হার ৯০ শতাংশের বেশি।
২০১২ সালে, বাহিনীতে ৮ বছর থাকার পর অবসর নেন ছেন পিন। তিনি জন্মস্থান পি চিয়ে শহরের ওয়ে নিং ই, হুই ও মিয়াও জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলায় ফিরেছেন। ২০১৬ সালে তিনি কমিউনিটির সিপিসি সম্পাদক হন। স্থানীয় মানুষের মনে ছেন পিন ব্যস্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক-প্রধান।
পানীয় জল, রাস্তা নির্মাণ, জরাজীর্ণ বাড়িঘর পুর্ননির্মাণসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিনি বার বার সংলিষ্ট বিভাগে যান। তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় মুরগির খামার এবং সবজি বেস। মুরগির খামারে প্রতিদিন ২ লাখ ৩০ হাজার ডিম উত্পন্ন হয়। ১২০০ মু সবজি ক্ষেতে ১০০ জনের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তিনি প্রতিটি পরিবারে গিয়ে ড্রপআউট হওয়া শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও চালান। এখন সারা অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ছাত্রের সংখ্যা ২০১২ সালের ৩ জন থেকে উন্নীত হয়েছে ৪০ জনে। এখন সেখানে আর কোনো ড্রপআউট শিশু নেই।
২০১২ সালে, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক উ ছাং লিন আসেন জং চাও গ্রামে এবং তার নেতৃত্বে ৩০টি পরিবার স্ট্রবেরি চাষ শুরু করে। ওই বছর স্ট্রবেরি বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার কেজি এবং আয় ৬ লাখ ইউয়ানের বেশি। পরে তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি দর্শনীয় বাগান। সবজি ও ফুল চাষের সঙ্গে গ্রাম-পর্যটন যুক্ত হয়। পর্যটকরা এখানে এসে যেমন নিজে স্ট্রবেরি বাছাই করতে পারেন, তেমনি গ্রামীণ দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
অন্যদিকে, ৩৮ বছর বয়সী ওয়াং থিয়ান ছিয়াং ২০০৩ সালে গ্রামে ফিরে আসেন। বাহিনীতে তিনি তিন বারের মতো শেষ্ঠ সৈনিক পুরস্কার পেয়েছেন এবং এখন তার নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ সচ্ছল জীবনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি নিজের সব জমানো টাকা বের করে চা চাষ শুরু করেন। তার চা বাগানের আয়তন ৪০০ মু এবং বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ১০ লাখ ইউয়ানের বেশি। তিনি বলেন, গ্রামে অনেক দরিদ্র পরিবার আছে এবং তাদেরকে সাহায্য করতে চান। তিনি চা চাষ ও তৈরির প্রযুক্তি অন্যদেরকে শিখিয়ে দেন এবং তার সাহায্যে ৩০টি দরিদ্র পরিবারের মানুষ চা চাষ করেন এবং দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন। (শিশির/আলিম/রুবি)