গ্রীষ্মকালে চীনের তা সিং আন লিং অঞ্চলের কাঠের বাড়িগুলো দেখতে সুন্দর লাগে। প্রায়ই দেখা যায়, বাড়ির বাইরে প্রবীণরা বসে চা খাচ্ছেন এবং ভেতরে নারীরা রান্না করছেন বা হরিণের চামরার উপর পেইন্টিং করছেন। ইনার মঙ্গোলিয়ায় আও লু কু ইয়া নামের এ ওয়েন খ্য জাতিঅধুষ্যিত উপজেলায় আমরা এমন দৃশ্য দেখা যায়।
একসময় এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষ শিকার করত এবং আলাদাভাবে পাহাড়ে বাস করত। এ ওয়েন খ্য মানে পাহাড়ে বাসকারী মানুষ। এ ওয়েন খ্য চীনের সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অন্যতম এবং এ জাতির মোট লোকসংখ্যা ৪০ হাজারের কম। এ জাতির তিনটি শাখা আছে: সুও লুন, থং কু সি, ও সি লু। এর মধ্যে সি লু সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি শাখা। এ শাখার লোকজন আও লু কু ইয়া উপজেলায় বাস করেন। এরা দীর্ঘকাল ধরে তা সিং আন লিংয়ের আদিম বনে বাস করে আসছিলেন। এরা বনে শিকার করতেন। তারা চীনের সর্বশেষ শিকারী জাতি হিসেবে পরিচিত। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত এ জাতি উত্পাদনের আদিম রীতি ধরে রেখেছিল। তারা পশুর মাংস খায়, পশুর ত্বক দিয়ে পোশাক তৈরি করে এবং কাঠের খুঁটি ও ছাল দিয়ে বাড়ি তৈরি করে। আধুনিক সমাজ থেকে তারা বিছিন্ন অবস্থায় বসবাস করতেন।
৭৯ বছর বয়সী একজন এ ওয়েন খ্য জাতির প্রবীণ বলেন, 'আমরা আগে পাহাড়ের ভিতরে বাস করতাম। খাবারের অভাব ছিল। শীতকালে পোশাকও যথেষ্ট ছিল না।'
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম এ ওয়েন খ্য জাতির উপজেলা এবং শিকারীরা আধুনিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত হন। আধুনিক সভ্যতা ও পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশে এ ওয়েন খ্য জাতির শিকারপদ্ধতি আর যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে না। পাহাড় থেকে নেমে তাদেরকে নতুন উন্নয়নের পথ খুঁজে নিতে হয়। ২০০৩ সালে এ ওয়েন খ্য জাতির শিকারীরা কেন হ্য নামের একটি শহরে স্থানান্তরিত হয়। ৬২টি পরিবারের ২০০ জন সদস্য পাহাড়কে বিদায় দিয়ে এখানে আসে। এখানে তাদের জন্য আছে প্রাকৃতিক গ্যাসের চুলা ও হিটারের ব্যবস্থা।
এ ওয়েন খ্য জাতির মেয়ে ফান সুও নতুন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, সরকার তাদের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ করেছে, সুবিধাজনক পরিবহন-ব্যবস্থা তৈরি করেছে। তাদের বর্তমান বাসস্থান শহরের কাছাকাছি বলে তাদের চাকরি-বাকরির সুযোগও বেশি। যখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৩ বছর। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৫ বছর। তাদের মধ্যে ৮০ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১০০ জনের বেশি।
আগে এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষ পণ্য দিয়ে পণ্য বিনিময় করতেন। এখন তাদের কেউ কেউ ইন্টারনেটে দোকান খুলেছেন, অনলাইনে লেনদেন করেন। এমনকি, কোনো কোনো এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষ ভাল ব্যবসা করেন। নুও রি তাদের মধ্যে একজন। সিঙ্গাপুরে তিনি লেখাপড়া শেষ করে বড় শহরের চাকরি পরিত্যাগ করেন এবং ফিরে আসেন তার জন্মস্থানে। তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ৪ লাখ ইউয়ান মূল্যের একটি কৃষি-সমবায় এখন কোটি ইউয়ান পর্যায়ের একটি পশুপালন ও পর্যটন কোম্পানিতে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষ পর্যটন ব্যবসাও ভালো করছেন।
বল্গাহরিণ পালন এ ওয়েন খ্য জাতির একটি ঐতিহ্য। তারা এখনও এ কাজ করেন; তবে আগের চেয়ে এ কাজেও খানিকটা ভিন্নতা এসেছে। তারা আদিম বনে বল্গাহরিণ পালন করেন এবং এটি এখানকার একটি দর্শনীয় স্থানও বটে। পর্যটনের শীর্ষ সময়ে তারা প্রতিদিন টিকিট ও বল্গাহরিণসম্পর্কিত হস্তশিল্প বিক্রির মাধ্যমে ১০০০ ইউয়ান করে আয় করতে পারেন। পাহাড়ের বাইরে আসার পর এ ওয়েন খ্য মানুষ এক সময় চিন্তিত ছিলেন। তারা ভাবতেন, হয়ত বল্গাহরিণ পালন বন্ধ হবে। তবে সরকার তাদের এ শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ সমর্থন দেয়। কেন হ্য সরকার ১০ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করে বল্গাহরিণ পালনকে একটি পর্যটনবিষয়ক শিল্পে পরিণত করে। এখন এ ওয়েন খ্য জাতির নাম দেশব্যাপী ছড়িয়েছে এবং এখানকার পর্যটকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। অনেক এ ওয়েন খ্য যুবক বনে ফিরে বল্গাহরিণ পালন শুরু করেছেন। বল্গাহরিণের সংখ্যা ১০০ থেকে বেড়ে ১০০০ হয়েছে এবং বল্গাহরিণ পালনস্থল ৬টি থেকে বেড়ে ১৪টিতে উন্নীত হয়েছে। যারা বল্গাহরিণ পালন করেন সরকার তাদের জন্য তাবু বা ক্যাম্পার গাড়ি সরবরাহ করে এবং তারা সহজে যাতায়াত করতে পারেন। গাড়িতে চালু হয়েছে সৌরশক্তি বোর্ড এবং তারা এ শক্তি দিয়ে টিভি ও ফ্রিজ ব্যবহার করতে পারেন। তাদের দৈনন্দিন জিনিষ ও খাবারও নিয়মিতভাবে তাদের কাছে পাঠানো হয়। এ ওয়েন খ্য জাতির অনেক মানুষ এখন পরিবারিক হোটেল ও বল্গাহরিণ পালন ব্যবসা করেন এবং তাদের মাথাপিছু নিট আয় ২০০৫ সালের ১২৭৭ ইউয়ান থেকে ২০ হাজারে উন্নীত হয়েছে।
জুলাই মাসে এ ওয়েন খ্য জাতির মেয়ে লি জি সিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি জাতীয় পরীক্ষায় ভাল করে। সে বেইজিংয়ে চীনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে চায়। সে বলে, কৃষিবিদ্যা শিখলে ভবিষ্যতে বল্গাহরিণ পালন ব্যবসা করতে পারবে এবং সাংবাদিকতা শিখলে সাংবাদিক হতে পারবে এবং তার জন্মস্থানকে আরও বেশি মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারবে।
বিগত কয়েক বছরে ইনার মঙ্গোলিয়ার স্থানীয় সরকার লংখ্যালঘু জাতির শিক্ষার্থীদেরকে বিশেষ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। এ ওয়েন খ্যসহ সংখ্যালঘু জাতির সংস্কৃতি সংরক্ষণে চালু হয়েছে এ ওয়েন খ্য ভাষাসহ নানান বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কর্মসূচি। ২০১৯ সালে এ ওয়েন খ্য জাতির স্বায়ত্তশাসিত এলাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং ৯৯.৭ শতাংশ পেশাদার হাইস্কুলে ভর্তি হয়। চলতি বছর এখানে আরও ৫১৮ জন ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি হবে।
ত্য খ্য লি ছোটবেলা থেকে মার কাছে এ ওয়েন খ্য জাতির পোশাক তৈরি এবং ছাল দিয়ে হস্তশিল্প তৈরি করা শিখেছেন। এখন তিনি একটি স্টুডিও খুলেছেন এবং তার উদ্যোগে আরও বেশি যুবক-যুবতী এ কাজে অংশগ্রহণ করছে। ত্য খ্য লি সাংবাদিককে জানান, এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষের নিজেদের লিখিত ভাষা নেই। তাই নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তাদেরকে চিত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। তিনি বল্গাহরিণের পশম দিয়ে জাতির ঐতিহ্যিক চিত্র বা প্যাটার্ন খোদাই করেন এবং তিনি এগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে চান।
এ ওয়েন খ্য মানুষ সূর্যের উপাসনা করে। তারা পশম ও পাথর দিয়ে সূর্য আকারের অলঙ্কার তৈরি করে এবং ব্যবহার করে। সূর্য আকারের ফুলও এ ওয়েন খ্য জাতির গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক। এ ওয়েন খ্য জাতির যুবক-যুবতীরা সূর্য আকারের ফুলকে নতুন জীবনীশক্তি হিসেবে গণ্য করে। আই মা চি নামের একজন মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার শিখেছে এবং স্নাতক হবার পর সে একটি অনলাইন দোকান খুলে বসে। তার মায়ের হাতে তৈরি সূর্যের আকারের নানান হস্তশিল্প খুব জনপ্রিয়। প্রতিবছর তারা দেশব্যাপী ১০ হাজারের বেশি অর্ডার পেয়ে থাকে।
আধুনিক সমাজের সঙ্গে মেশার পরও এ ওয়েন খ্য জাতির মানুষ নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে যায়নি। জাতীয় সংস্কৃতি তাদের সবচেয়ে ভাল একটি নামকার্ডে পরিণত হয়েছে।(শিশির/আলিম/রুবি)