চীনাদের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত: 'মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।' চীন একটি জনবহুল দেশ। লোকসংখ্যা ১৪০ কোটিরও বেশি। তাই মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করা চীন সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ সম্পর্কে চীনা প্রেসিডেন্ট বার বার বলেছেন, 'চীনাদের ভাতের বাটি সবসময় নিজেদের হাতেই রাখতে হবে'। এর মানে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সম্প্রতি উত্তর চীনের চিলিন প্রদেশ পরিদর্শন করেন প্রেসিডেন্ট সি। প্রাচীনকাল থেকে চিলিন প্রদেশ চীনের খাদ্যশস্য উত্পাদনের প্রধান এলাকা। তাই স্থানীয় খাদ্যশস্য উত্পাদন-ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
চিলিন প্রদেশের মাটির রঙ কালো। এখানকার মাটি অনেক উর্বর। এখন চীনের বিভিন্ন এলাকায় আধুনিক কৃষির উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কৃষিক্ষেতের মান উন্নত হয়েছে এবং এর ফলে ফলসের উত্পাদনও বেড়েছে। শুধু খাদ্যশস্যের উত্পাদন বেড়েছে তা নয়, খাবারের মানও বেড়েছে। চীনের বিভিন্ন এলাকায় খাদ্যশস্যের মান উন্নয়নে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। ভুট্টা, সয়াবিন ও ধানসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্যের উত্পাদন ক্রমাগত বাড়ছে।
হেইলুংচিয়াং প্রদেশের হাইলুন শহরের এক কমিউনিটিতে সয়াবিন ক্ষেতের বার্ষিক উত্পাদনের পরিমাণ ২০০ কেজি। তবে এখানে উত্পাদিত সয়াবিনে প্রোটিনের পরিমাণ ৪০ শতাংশেরও বেশি। এ বিশেষ জাতের সয়াবিন চীনের বিজ্ঞান একাডেমির শাখা গবেষণাগারে উত্পন্ন হয়েছে। এ জাতের সয়াবিনের উত্পাদন যেমন বেশি হয়, তেমনটি এ সয়াবিনে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। বিরূপ আবহাওয়াতেও এই জাতের সয়াবিনের গাছ টিকে থাকতে পারে।
ধান চীনাদের প্রধান খাদ্যশস্যের অন্যতম। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে তৃতীয় প্রজন্মের হাইব্রিড ধান, উত্পাদনের পরিমাণ দিক দিয়ে, নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে; ৬৬৭ বর্গমিটার ধানক্ষেতে উত্পাদন পরিমাণ ১০৪৬ কেজিতে দাঁড়ায়। ২০২০ সালে সারা চীনে সুপার হাইব্রিড ধান চাষ করা হয়, যা ব্যাপকভাবে চীনের ধান উত্পাদনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিভিন্ন খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়াতে বীজ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন চীনা গবেষকরা। পাশাপাশি, কৃষকদের নতুন চাষের পদ্ধতিও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। চিলিন প্রদেশের বাইছেং শহরের থুংইয়ু জেলার বিয়ানচাও উপজেলার কৃষক থান চিন হ্য ভুট্টা চাষের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিকাল বিজ্ঞান একাডেমির অধ্যাপক ছুই জিন হু'র সহায়তায় কৃষক থাং ভুট্টা চাষের নতুন পদ্ধতি শিখেছেন।
গত বছর অধ্যাপক ছুই বিয়ানচাও উপজেলার কাছে ৬০ হাজার বর্গমিটার পরীক্ষামূলক কৃষিক্ষেত উন্নত মানের ভুট্টার বীজ রোপণ করেন। পরীক্ষামূলক কৃষিক্ষেতে ভুট্টার উত্পাদনের পরিমাণ সাধারণ কৃষিক্ষেতের তুলনায় ৮০.৯ শতাংশ বেশি হয়। নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় উন্নত মানের বীজ দিয়ে বেশি ফসল ফলান কৃষক থাং।
খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়াতে উন্নত বীজ ও উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াও প্রয়োজন উর্বর মাটি। চিলিন প্রদেশের মঙ্গোলিয়ান জাতিঅধ্যুষিত জেলার লিয়ানহুয়াশান গ্রামে এক কৃষক কমিউনিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তি লিউ শি চিয়াং বলেন, অতীতকালে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো ছিল না। খরা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অনুন্নত চাষ-পদ্ধতির কারণে কালো মাটি দুর্বল হতে থাকে এবং খাদ্যশস্যের উত্পাদনও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
৩ বছর আগে কমিউনিটিতে কৃষিক্ষেত সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শরত্কালের ফসল তোলার পর ভুট্টার ডালপালা মাটিতে ফেলে রাখা হয় এবং বসন্তকালে যন্ত্রপাতি দিয়ে নতুন বীজ বপন করা হয়। এভাবে কৃষিক্ষেত সংরক্ষিত থাকে এবং মাটির উর্বরতাও বাড়ে। ফলে ৩ বছর পর ভুট্টার উত্পাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
এখানকার কালো মাটি চীনের বিভিন্ন এলাকার মাটির মধ্যে সবচেয়ে উর্বর। উত্তরপূর্ব চীনে এমন মাটি পাওয়া যায়। স্থানীয় কৃষিক্ষেতের সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট পাঁচসালা পরিকল্পনাও চালু হয়েছে। ২০২৫ সালে শ্রেষ্ঠ কৃষিক্ষেতের পরিমাণ ১ কোটি হেক্টরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তা ছাড়া, উচ্চ মানের কৃষিক্ষেত প্রকল্প বিভিন্ন এলাকায় চালু করা হয়। এ ধরনের প্রকল্পের আওতায় চিলিন প্রদেশের তাআন শহরের একটি খামারে ধানক্ষেত সুশৃঙ্খলভাবে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা হয়। বিভিন্ন ভাগে পানির সরবরাহ ও পানির পরিমাপ মাপতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। এর ফলে জলের অপব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি কৃষিক্ষেতে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহও নিশ্চিত হয়েছে।
খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়ানোর সাথে সাথে খাদ্যশস্যের মানও উন্নত করা দরকার। হেইলুংচিয়াং প্রদেশের ছিংআন জেলায় এক কৃষক কমিউনিটির ২.৪ হেক্টর ধানক্ষেত রয়েছে। এই ধানক্ষেত দুই অংশে ভাগ করে ভিন্ন ধরনের ধান চাষ করা হয়। গত বছরের শেষ দিকে এ কমিউনিটির অনলাইন দোকানে বিক্রির পরিমাণ বিচার-বিশ্লেষণ করে, ভোক্তাদের প্রিয় ধানের প্রজাতি বেছে নেওয়া হয়েছে চাষের জন্য। ভোক্তাদের সবুজ ও অর্গানিক ধানের চাহিদার মেটাতে ধানক্ষেতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করেছে কৃষকরা। এ সম্পর্কে কমিউনিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিয়ান চেন হুয়া বলেন, অতীতকালে রাসায়নিক সার দিয়ে ধানক্ষেত চাষ করা হতো। এখন অর্গানিক সার ব্যবহার করা হয়। এতে মাটির মান অনেক উন্নত হয়েছে এবং উত্পাদনও কিছুটা বেড়েছে।
চীনের সিছুয়ান প্রদেশের মেইশান শহরের তুংপো এলাকায় আধুনিক কৃষি পরীক্ষামূলক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে পোকামাকড় প্রতিরোধ করার সাথে সাথে রাসায়নিক সার প্রয়োগের পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখানকার ধান বেশ জনপ্রিয় হয়েছে এবং স্বাদও অনেক ভালো।
আসলে 'বাটিতে ভাত থাকলে' জীবনযাপনের মান উন্নয়ন করা সম্ভব। এখন চীনের কৃষি খাত গুণগত মান উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যশস্যের উত্পাদন যথেষ্ঠ হলেই কেবল চীনা মানুষের জীবনযাপনের মান নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রেসিডেন্ট সি চিলিন পরিদর্শনকালে জোর দিয়ে বলেন, খাদ্যশস্যের উত্পাদনে মনোযোগ দিতে হবে, কৃষির উন্নয়নের পদ্ধতি রূপান্তর করে হবে, যাতে কৃষকরা শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি দিয়ে শ্রেষ্ঠ খাদ্যশস্য চাষ করতে পারেন।
সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn
তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)