কিভাবে যাবেন হালং বে
২০১৮ এর আগে ভিয়েতনামের হ্যানয় (Hanoi) থেকে হালং সিটি ১৬০ কিলো দূরে ছিল তবে ২০১৮ সালের পর হালং সিটি ও হানয় শহরকে সংযুক্ত করে তৈরি হওয়া এক্সপ্রেস ওয়ে ও ভান ডন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কারনে এখন হালং বে, হালং সিটি থেকে মাত্র ৫০ কিলো দূরে।
হ্যানয় শহর থেকে হালং (Ha Long) সিটিতে বাই রোডে বাসে বা কারে, ট্রেনে, নৌকায় বা শিপে, সী প্লেনে এমনকি হেলিকপ্টারেও যাওয়া যায়। বাসে যাওয়ার জন্য হেনয় থেকে হালং সিটিতে সাড়ে ৩ ঘন্টার বাস জার্নিতে পৌছানো যায়। হালং সিটির বাস স্টেশন থেকে হালং বে জেটিতে যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। সীপ্লেনে যাবার ক্ষেত্রে হালং বে এর সৌন্দর্য চোখে পরার মতো। প্লেনে খরচ বেশী হলেও সময় লাগে মাত্র ৪৫ মিনিট।
আবার সরাসরি গাড়িতেও যাওয়া যায়। সেই ক্ষেত্রে হ্যানয় থেকে হাইফং প্রদেশ হয়ে যেতে হবে হালং বে। তবে ট্যুর এজেন্সির মাধ্যমে গেলে ওরাই কম খরচে ভালোভাবে হালং বে-তে যাওয়া আসার সব ব্যবস্থা করে দিবে।
কিভাবে ঘুরবেন হালং বে
হালং বে এর চারপাশ চুনাপাথরের পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মূলত এই জায়গায় ক্রুজে ঘুরে দেখতে ভালো লাগে। বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার প্যাকেজ আছে, কি কি দেখবেন তার উপর ভিত্তি করে প্যাকজের দাম নির্ভর করে। সময় বেশী থাকলে কয়েকদিন থেকে দেখে যেতে পারেন হালং বে এর বিভিন্ন জায়গা। তবে কিছু জায়গা দেখতে প্রায় কাছাকাছি তাই প্যাকেজগুলো এমন ভাবে সাজানো হয় যাতে একই রকম জায়গা বাদ দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের জায়গা গুলো ঘোরা যায়। এখানে মূলত বেশ কিছু গুহা, আইল্যান্ড ও শহর থেকে দূরে বেশ কিছু গ্রামের দেখা মিলবে। গুহার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
মেজ কেভ (Maze Cave) : এই গুহার বিশেষ বৈশিষ্টের কারণে যে কেউ গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাবে। এই গুহার ভিতরের লাইট ইফেক্টের কারনে আরও বেশী রহস্যময় লাগে এই গুহা। মেজ কেভ নামের সার্থকতা এই কারণেই।
থিএন চানহ সান কেভ (Thiencanh Son Cave) : বন্য পরিবেশে গড়ে উঠা এই গুহা বেশ রহস্যজনক। এডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য ভালো লাগার মতো একটি জায়গা। ১০০ টি পাথরের সিঁড়ি পার হয়ে এই গুহার উপরে উঠতে হয়।
তিএন অং কেভ (Tienong Cave) : সম্প্রতি এই কেভ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, এর চারপাশের সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করার মতো।
সারপ্রাইজ কেভ (Surprise Cave) : হালং বে এর সবচেয়ে বড় গুহা। এখানে আসলে বিস্ময়ে কেটে যাবে পুরোটা সময়।
ত্রিনহ নু কেভ (Trinh Nu Cave) : এই গুহায় আসলে রহস্যের সাথে সাথে ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততার এক লৌকিক কাহিনী জানা যাবে আর এই কারনেই পর্যটকদের এখানে আসার ব্যাপারে বিশেষ আকর্ষণ থাকে।
আবার বেশ কিছু আইল্যান্ড ও ঘুরে দেখতে পারবেন। যেমন-
থ্রী পিছ আইল্যান্ড (Three Peach Island) : স্ফটিকের মতো সাদা স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটার সাথে সাথে কায়াকিং করার ও মজা পাবেন।
কক ছেও আইসলেট (CocCheo Islet) : এই ছোট্ট দ্বীপের বিশেষ আকৃতির জন্য এই জায়গা শুটিং স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।
তুং সাউ পার্ল ফার্ম (Tung Sau Pearl Farm) : মুক্তোর সন্ধানে যেতে পারেন এখানে। নিজেরাই ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবেন মুক্ত চাষের উপায়। এছাড়াও এখানে কায়াকিং করারও সুযোগ আছে।
ফিঙ্গার আইসলেট (Finger Island) : আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে বেড়ে উঠাআঙ্গুলের মতো গঠন এই আইল্যান্ডের, আর তার জন্যই এই নাম। এই দ্বীপের আসে পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ সুন্দর। ছবি তোলার জন্য এই জায়গা বেশ পছন্দের পর্যটকদের কাছে।
টিটোপ বীচ (Titop Beach) : অর্ধ চন্দ্রাকার এই দ্বীপ পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
হো বা হাম আইসলেট (Ho Ba Ham Islet) : এই দ্বীপের আসে পাশের দৃশ্য মন ভালো করে দেওয়ার মতো। এখানেকায়াকিং, স্নোরকেলিং ও সাঁতার কাটার সুযোগ আছে।
এছাড়াও আছে ক্যাট বা আইল্যান্ড (Cat Ba Island), কং স্কাল আইল্যান্ড (Kong Skull Island), দাউ বে আইল্যান্ড (Dau Be Island), চং ডো আইল্যান্ড (Cong Do Island)। ক্রুজের অন্তর্ভুক্ত থাকলে ঘুরে আসতে এই দ্বীপগুলো থেকে।
এছাড়াও গ্রামীণ জীবনের রূপ দেখতে ঘুরে আসতে পারেন শহর থেকে দূরের কিছু গ্রাম থেকে। যেমন-
ভিয়েত হাই ভিলেজ (Viet Hai Village) : হালং বে এর ভিড় এড়িয়ে নিরিবিলি থাকার জন্য ও শান্তির খোঁজে চলে আসতে পারেন এখানে। এই গ্রাম তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের কারনে বেশ পরিচিত।
চুয়া ভান ফিশিং ফ্লোটিং ভিলেজ (Cua Van) : বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে এই গ্রাম। শতবর্ষ ধরে চলে আসা স্থানীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ জীবনের আবহ পাওয়া যাবে এখানে।
ভুং ভিং ফিশিং ফ্লোটিং মার্কেট (Floating Market) : পানির উপর ভাসমান মার্কেটে মাছের কেনাবেচা আর সবুজ পানি দিয়ে ঘেরা চুনাপাথরের এই দ্বীপে ঘুরে আসতে পছন্দ করে অনেকেই। এই গ্রাম আসলে মাছ কেনাবেচার জন্য বিখ্যাত।
এছাড়াও হালং বে এর প্রায় সব জায়গাতেই সাইকেলিং করতে পারবেন। এখানে আছে ট্রেকিং করার সুযোগ। তুয়ান ছাউ আইল্যান্ড এর কাছে ফিশিং ভিলেজ, ক্যাট বা আইল্যান্ড অথবা হন গাই শহরে ট্রেকিং বা হাইকিং করার মতো বেশ কিছু জায়গা আছে।
মূলত, হালং বীচে ক্রুজে ঘুরলে বেশ কিছু মজার ও ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতা হবে যা আর অন্য কোনও ভাবে আপনি পাবেন না। যেমন- ক্রুজে হালং বে ঘুরলে ইচ্ছে থাকলে স্কুইড ধরার মতো এক ধরনের ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। আবার বাইরের ডেকে বসে সিনেমা দেখারও সুযোগ আছে। এছাড়াও কিছু বিলাসবহুল ক্রুজে স্পা ও শরীরচর্চার ও সুযোগ আছে। কিছু কিছু ক্রুজে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার মতো মিশন ও আছে যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পর্যটকরা অংশগ্রহণ করতে পারে। আবার সকালে থাই চাই (Thai Chi) করার মাধ্যমে মন শান্ত রাখার এক সুন্দর অভিজ্ঞতাও হবে ক্রুজের মাধ্যমে। হানিমুন কাপলদের জন্য আলাদা রুম ও বিশেষ আয়োজনের ও ব্যবস্থা আছে। তাই থাকা খাওয়ার খরচসহ সব ব্যাপারে ক্রুজের কোন প্যাকেজ নিলে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
চাহিদা ও সাধ্য অনুযায়ী থাকার জন্য ৩ স্টার, ৪ স্টার ও ৫ স্টার রেটেড বেশ কিছু হোটেল আছে।এছাড়াও এখানে হোটেলের চেয়ে ক্রুজে থাকার এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। ক্রুজে আইল্যান্ড ঘোরার সাথে সাথে হালং বে-র অন্যান্য আকর্ষণীয় জায়গা গুলো দেখা সুবিধাজনক হওয়ায় অনেকেই ক্রুজে থাকতে বেশি পছন্দ করে। নিজেদের পছন্দ ও বাজেট হিসেবে কয়েকদিনের জন্য যেকোনো ক্রুজ বেছে নিতে পারেন।
হালং বে ভ্রমণ খরচ
ক্রুজে দুই রাত তিন দিন থাকা ও খাওয়া সহ জনপ্রতি ১৭,০০০- ২৫,০০০ টাকার মতো খরচ হবে। মূলত কয়দিন ক্রুজে থাকবেন ও কোথায় কোথায় ঘুরবেন তার উপর খরচ নির্ভর করে। আর হানয় শহর থেকে হালং বে র জেটিতে যাওয়ার খরচ আলাদা।
কিছু ভ্রমণ টিপস
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাস হালং বে তে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
এখানে অবশ্যই ভালো গ্রিপসহ জুতা নিয়ে যেতে হবে।
এখানে গরমের দিনেও রাতে বেশ ঠাণ্ডা লাগে তাই রাতে থাকলে শীতের এক দুইটা কাপড় নিয়ে যাওয়া ভালো।
এখানে সাঁতার কাটার জন্য বেশ কিছু ছোট ছোট আইল্যান্ড আছে। তাই সাঁতার কাটার ইচ্ছে থাকলে সাথে সুইমিং কস্টিউম নিয়ে যেতে হবে।
হালং বে ঘুরার জন্য ক্রুজে থাকা বেশী সুবিধাজনক তাতে হোটেলে যাতায়াতের সময় ও বাঁচবে আর ভালো ভাবে হালং বে ঘুরেও দেখা যাবে।
ক্রুজ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না অনেকক্ষেত্রেই এই সময় প্রতারনার শিকার হতে হয়।
একটু দাম বেশি দিয়ে হলেও ভালো কোনও ক্রুজ প্যাকেজ বেছে নিবেন কারন তাতে আপনার টাকা একটু খরচ বেশী খরচ হলেও ভ্রমণের আনন্দ তার চেয়ে অনেক বেশী হবে।
ট্যুর অপারেটর বা ক্রুজ কোম্পানির সাথে ট্যুরের আগেই সব বিষয়ে বিশেষ করে কোন কোন জায়গায় ঘোরাবে, কিভাবে থাকবেন, খাবার, রাইডের আলাদা চার্জ এইসব বিষয় জেনে নিবেন।
ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনলাইনে বিভিন্ন ক্রুজিং কোম্পানির ওয়েব সাইট দেখে আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন।
যাদের রান্নার ব্যাপারে আগ্রহ আছে তারা ক্রুজে অন্তর্ভুক্ত কুকিং ক্লাসেও যুক্ত হতে পারেন ভিয়েতনামের স্থানীয় রান্না শেখার জন্য।
এখানে গাল্ফ অফ তনকিনে সূর্যাস্ত দেখার অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য মিস করবেন না।
এখানে বিভিন্ন এগ্রিকালচারাল ট্যুরও হয়ে থাকে এই ট্যুরে অংশগ্রহণ করলে খুব কাছ থেকে ভিয়েতনামের কৃষকদের সবজি ও ফল চাষের বিভিন্ন বিষয় জানতে ও প্রত্যক্ষ ভাবে দেখতে পারবেন।