২৬ জুলাই থেকে আরও ১০০ দিন পর অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা। যদিও বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে, তথাপি বিশ্বের প্রথম আমদানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মেলা হিসেবে নভেম্বর মাসে তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা শাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে নিশ্চিত হয়েছে।
মহামারীর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে গুরুতর মন্দাবস্থা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদও বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা সময়মতো আয়োজন অর্থবহ একটি ঘটনা। চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা বিভাগের উপ-প্রধান সুন ছাং হাই বলেন, অনেক প্রথম শ্রেণীর কোম্পানি এবার মেলা নিয়ে আশাবাদী। এবার বিশ্বের টপ ৫০০ ও শীর্ষ কোম্পানির গড় প্রদর্শনী-এলাকার আয়তন দ্বিতীয় মেলার তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। এতে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর এ মেলা ও চীনা বাজারের প্রতি স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ।
তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক মেলার প্রদর্শনীস্থলের আয়তন ৩.৬ লাখ বর্গমিটার, যা দ্বিতীয় মেলার চেয়ে ৬০ হাজার বর্গমিটার বেশি। এর মধ্যে ভোক্তাপণ্য, চিকিত্সা এবং পরিষেবা বাণিজ্য—এই তিনটি প্রদর্শনী এলাকার সব বুক হয়ে গেছে। জার্মানির কার্ল ক্রুজ ওয়েল্ডিং কোম্পানির ইতিহাস ১০০ বছরের বেশী। এ কোম্পানির এশিয়া প্রযুক্তি ও বিক্রয় বিষয়ক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, জার্মানির বাইরে চীন বৃহত্তম বাজার। গত বছর তারা দ্বিতীয় মেলায় অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের খুব ভাল লেগেছে। তাই তৃতীয় মেলায় তারা নিজেদের প্রদর্শনীস্থলের আয়তন ৬০ বর্গমিটার থেকে ১০০ বর্গমিটারে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেন।
তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় বর্তমান বিশ্বের হট ইস্যু ও শিল্প উন্নয়নের প্রবণতা অনুযায়ী, নতুন করে স্থাপন করা হবে গণস্বাস্থ্য ও মহামারী প্রতিরোধ, শক্তি সঞ্চয় এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, স্মার্ট ভ্রমণ ও ক্রীড়া সামগ্রী এবং ইভেন্ট ইত্যাদি এলাকা।
ইসিএমও, ভেন্টিলেটার, প্রতিরোধক সামগ্রী, টেস্ট কিটসহ নানা সরঞ্জাম এবার গণস্বাস্থ্য ও মহামারী প্রতিরোধ এলাকায় দেখা যাবে। এ এলাকার আয়তন ১০ হাজার বর্গমিটারের বেশি। বিশ্বে মহামারী প্রতিরোধবিষয়ক নতুন তথ্যাদির প্রদর্শন ছাড়া গণস্বাস্থ্য ও মহামারী প্রতিরোধ শিল্পের প্রবণতাও নিয়ে আলোচনাও করা হবে। এবার মেলায় দেখা যাবে নতুন পণ্য, প্রযুক্তি ও সেবা। কোনো কোনো পণ্য চীনে, এমনকি বিশ্বে প্রথমবারের মতো দেখা যাবে।
মহামারীর এসময়ে মেলার আয়োজন ও প্রস্তুতিকাজ স্বাভাবিকভাবেই আগের চেয়ে বেশি কঠিন ও জটিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলার জন্য চালু হয় ক্লাউড নিবন্ধন, ক্লাউড স্বাক্ষর ও ক্লাউড রোডশোসহ নানা পদ্ধতি। বিশ্বের কোম্পানিগুলো পরস্পরের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারে। গেল কয়েক বছরে বিশ্বের সহস্রাধিক কোম্পানি অনলাইন রোডশোতে অংশ নেয় এবং প্রদর্শকদের নামতালিকা নির্দিষ্ট সময়ের আগে সংগ্রহ করা হয়।
কোনো কোনো কোম্পানি টানা তিন বছর ধরে মেলায় অংশ নিচ্ছে এবং কোনো কোনো কোম্পানি নতুন বন্ধু হিসেবে আসছে। যেমন, ইউনিক্লো এবার প্রথমবারের মতো অংশ নেবে এবং দেড় হাজার বর্গমিটারের একটি প্রদর্শনী হলের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কারটিয়ের, পাইগেট, ভ্যাকেরন কনস্ট্যান্টিনসহ বিলাসবহুল ব্র্যান্ডও তৃতীয় মেলায় আসবে। ল'অরিয়াল কোম্পানির চীনা সিইও বলেন, তৃতীয় মেলায় তারা কেবল নতুন পণ্য নিয়ে আসবেন না, সৌন্দর্যবিষয়ক নতুন প্রযুক্তিও দেখাবেন এবং গ্রীণ অ্যাপ্লিকেশনও তাদের নতুন একটি ব্যবসা।
চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা শুধু ৬ দিনের একটি মেলা, তা নয়। মেলা শেষ হবার পর বিদেশের পণ্যগুলো বৈশ্বিক পণ্যবাণিজ্য বন্দরের মাধ্যমে হাজার হাজার চীনা পরিবারে প্রবেশ করতে পারবে। শাংহাই ছাড়া চীনের হার্বিন, সিআন, কুই ইয়াং, ছেংতু, খুন মিং ও নিংপোসহ নানা শহরেও পাওয়া যাবে এসব পণ্য।
২৬ জুলাই, তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলার অংশগ্রহণকারী জোট প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠা করে গণস্বাস্থ্য ও মহামারী প্রতিরোধ কমিটি। আরও বেশি অংশগ্রহণকারী কোম্পানি একসাথে মহামারী প্রতিরোধে কাজ করবে।
হোস্ট হিসেবে শাংহাইয়ের স্থানীয় সরকারও অংশগ্রহণকারী কোম্পানগুলোকে আরও ভাল সেবা দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। মহামারীর অবস্থা অনুযায়ী, শাংহাই বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের 'ফাস্ট পাস' দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা করছে। পাশাপাশি, অনলাইন ফোরাম ও অলাইন প্রদর্শনসহ নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে।
শাংহাই সরকারের উপ-মহাসবিচ শাং ইউ ইং বলেন, মহামারীর এই সময়ে তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা আয়োজন করা, আমদানি বাড়ানো, ও উন্মুক্তকরণে অবিচল থাকা, বড় দেশ হিসেবে চীনের দায়িত্ববোধের প্রতিফলন। বাণিজ্যের মাধ্যমে বিনিয়োগও আসে। শিসিডো, ড্যানোনসহ বড় কোম্পানিগুলো যথাক্রমে শাংহাইয়ে গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে। প্যানাসনিক গ্রুপ যথাক্রমে চেচিয়াং ও কুয়াং তুংয়ে দুটি নতুন কারখানা চালু করেছে। চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চীনে তাদের বিনিয়োগ ও কার্যক্রম বাড়াতে উত্সাহ দেয়। ভ্যারিয়ান চিকিত্সাবিষয়ক একটি কোম্পানি। কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট সাংবাদিককে জানান, এখন চীনে তারা কেবল পণ্য নয়, গোটা উত্পাদনলাইন নিয়ে আসবেন এবং মহামারী চলাকালে তারা চীনে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবেন। গত বছর দ্বিতীয় মেলায় প্রদর্শিত একটি নতুন পণ্য চলতি বছরের মার্চ মাসে আনুষ্ঠিনকভাবে উত্পাদন করা হয় এবং বেইজিং কোম্পানির বিশ্ব পণ্য গবেষণা ও উত্পাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
মহামারীর কারণে আরও বেশি কোম্পানি এবার মেলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং প্রদর্শনের কৌশল পরিবর্তন করেছে। যেমন, তৃতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা শুরুর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের এক ধরনের গরুর মাংস শাংহাই বাজারে নিয়ে আসে। এ মাংস মেলায় প্রদর্শন করা হবে। তবে শাংহাইয়ের মানুষ এখনই এ মাংসের স্বাদ নিতে পারছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মনে করেন, এ পদ্ধতির মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য আরও কম ব্যয় ও কার্যকরভাবে চীনা বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।
শাংহাই হংছিয়াও বাণিজ্যিক এলাকার বন্ডেড লজিস্টিক সেন্টারে ইতালিয়ান ওয়াইন, বেলজিয়ামের আইসক্রিম, গ্রীক জলপাই তেলসহ বিভিন্ন পণ্য মেলার আগেই চীনে প্রবেশ করেছে। আগে মেলার জন্য ক্ষুদ্র পরিমাণ পণ্য চীনে পাঠানো হতো এবং মেলা শেষ হবার পর স্বদেশে আবার পাঠানো হতো। তবে এবার বিপুল পরিমাণে পণ্য বন্ডেড লজিস্টিক সেন্টারে এসেছে এবং মেলা শেষ হবার পর এগুলো সাধারণ পণ্য হিসেবে বিক্রি হবে।
বিশ্ব বাণিজ্য ফোরামের গ্রেটার চীন এলাকার প্রধান প্রতিনিধি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ একটি নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব আর্থ-বাণিজ্য উন্নয়নের অনিশ্চয়তা এবং বিশ্ব শিল্প চেন, সরবরাহ চেনের অস্থিতিশীলতা বাড়ছে। আরও উন্মুক্তকরণ ও সহযোগিতা প্রসারিত করতে সকল দেশের প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কোম্পানি চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় অংশগ্রহণ করবে এবং তা বিশ্বের সরবরাহ চেনের স্টেবিলাইজার হিসেবে ভূমিকা পালন করবে ও বিশ্ব অর্থনীতি পুরুদ্ধারের জন্য সহায়ক হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। (শিশির/আলিম/রুবি)