করোনা মহামারি মোকাবেলায় বেসামাল অবস্থা সামনে নিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের করুণচিত্র। করোনা পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি, রিজেন্ট ও সাহাবউদ্দিন মেডিকেলসহ খ্যাত-অখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ও দুর্নীতির খবর ফাঁস এবং ওই সব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের মধ্যে সমালোচনার তীর সবসময় ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরে অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার দিকে। সব দিক থেকেই চাপে ছিলেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল তার বিদায় সময়ের ব্যাপার মাত্র। হয়েছেও তাই। ২১ জুলাই পদত্যাগ করেন অধ্যাপক আজাদ। ২৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমকে নতুন মহাপরিচালক নিযুক্ত করে সরকার। অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. আমিনুল হাসানকে সরিয়ে দিয়ে নতুন পরিচালক করা হয়েছে একই অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. ফরিদ হোসেন মিঞাকে।
করোনা মোকাবেলায় নানাবিধ দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার মুখে সরকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক ও একজন নতুন পরিচালক নিয়োগ করলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এটুকু পরিবর্তনে দেশের স্বাস্থ্যখাতের ভগ্নদশা কতটুকু কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দু'একজনের পরিবর্তনে দেশের স্বাস্থ্যখাতে জমাটবাঁধা দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যস্থাপনা দূর করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দুষছেন বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ। তারা বলছেন, শুধু গুটিকয় পদে পরিবর্তনই নয়, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন চাইলে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। নবনিযুক্ত মহাপরিচালকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বল তারা সতর্ক করে দেন।
স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি অধ্যাপক খুরশীদও মনে করেন তার সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। করোনা মোকাবেলাসহ দেশের ভগ্ন স্বাস্থ্যখাতকে সুস্থ-সবল করে তুলতে তিনি তার সাধ্যমতো করবেন বলে জানান। স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে নয়া স্বাস্থ্য ডিজি বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে সৎ না হলে দুর্নীতি কখনোই বন্ধ হবে না। এ ব্যাপারে শুধু সরকারের দিকে আঙ্গুল তোলাটা বোকামি বলে মনে করেন অধ্যাপক খুরশীদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত সততা গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা, সুব্যবস্থাপনা এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুসমন্বয়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তারা। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা থাকলে দুর্নীতির সুযোগ এমনিতেই কমে আসে। দেশের মানুষের আশা নতুন স্বাস্থ্য ডিজি করোনা মোকাবেলাসহ স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন।
এদিকে, চীনের সিনোভেক কোম্পানি উদ্ভাবিত করোনা টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা হবার কথা বাংলাদেশে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ টিকাটি পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ -আইসিডিডিআর'বিকে। বাংলাদেশে ২ হাজার ১০০ জনের ওপর টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হবার কথা রয়েছে। করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত দেশের সাতটি হাসপাতালে চলতি মাসেই টিকাটির পরীক্ষা হবার কথা।
কিন্ত অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে না- চীনা টিকার পরীক্ষা কখন শুরু হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, টিকার অনুমোদন শুধু বাংলাদেশে চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ দিলেই হবে না- এক্ষেত্রে সরকারেরও সিদ্ধান্তের ব্যাপার রয়েছে। করোনা সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে সরকার এ সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো তাদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাদের পরামর্শ জানতে চাইলে ১৯ সদস্যের কমিটি চীনা টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়ালের ফলাফল পর্যালোচনা করে মতামত দেবে।
জাতীয় কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি তাদের। কবে হবে তাও তিনি জানেন না। অধ্যাপক নজরুল বলেন চীনের টিকা এবং অক্সফোর্ডের টিকা দুটোই ভালো। তবে চীনের টিকা ট্রায়ালের জন্য এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছে চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ। আর তা তাড়াতাড়ি হলেই আমরা উপকৃত হবো। না হলে খুব দেরি হয়ে যাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, টিকার কতটা নিরাপদ, স্বাস্থ্যঝুঁকি কতখানি, সহজলভ্যতা- এ সব নিশ্চয় দেখবে সরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ একেবারেই কাম্য নয়। কারণ এর সঙ্গে গোটা জাতির স্বাস্থের বিষয়টি জড়িত।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।