জুলাই মাস থেকে চীনের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার দুর্যোগ দেখা দেয়। ইয়াংসি নদী, হুয়াহ্য নদী এবং হুয়াইহ্য নদীসহ বিভিন্ন এলাকায় নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। চীনের ছেংছিং, চিয়াংসি, আনহুই, হুপেই, হুনান, চিয়াংসু ও চেচিয়াং প্রদেশে গুরুতর বন্যা ও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
চীনের ইয়াংসি নদীর উত্স ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির থাংকুলা শৃঙ্গে। এ নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৬৩৮৭ কিলোমিটার; এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী। এ নদী চীনের পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং মোট ৮টি প্রদেশ অতিক্রম করেছে। এ নদীর প্রবাহিত এলাকার আয়তন ১৮ লাখ বর্গকিলোমিটার। এর শাখা নদী হল চিয়ালিং নদী, উ নদী, হান নদী এবং কান নদী।
হুয়াংহ্য নদী বিশ্বের দীর্ঘতম নদীগুলোর অন্যতম। এর মোট দৈর্ঘ্য ৫৪৬৪ কিলোমিটার। এ নদী চীনাদের 'মাতা নদী' হিসেবে পরিচিত। এ নদীর রঙ হলুদ, তাই হুয়াংহ্য বলে ডাকা হয়। প্রাচীনকাল থেকে হুয়াংহ্য নদীর বালির কারণে প্রবাহিত এলাকায় সহজে বন্যা দেখা দেয়।
১১ জুলাই চীনের চিয়াংসি প্রদেশের বোইয়াং জেলায় স্থানীয় রকেট বাহিনীর সৈন্যরা স্থানীয় গ্রামবাসীদের বন্যা প্রতিরোধে সহায়তা দেয়। কারণ, চিয়াংসি প্রদেশের বোইয়াং হ্রদের অনেক এলাকায় পানির পরিমাণ ইতিহাসের রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়। স্থানীয় রকেট বাহিনীর সৈন্যরা কয়েকটি গ্রামে পৌঁছে বাঁধের অনিরাপদ স্থান মেরামত করে। অনেক এলাকায় সৈন্যরা কাঁধ ও হাত দিয়ে বন্যা-প্রতিরোধক উপকরণ বহন করেন।
চিয়াংসি প্রদেশের কু জেলার তু উপজেলায় স্থানীয় হ্রদের উচ্চতা জেলার অন্যান্য হ্রদের তুলনায় ৩ মিটার বেশি উঁচু। যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় শতাধিক সৈন্য টানা ৮ ঘন্টা সংগ্রাম করে বাঁধের পুননির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন এবং জেলার জলাবদ্ধতা ঠেকিয়ে দেন।
তা ছাড়া, চীনের চিয়াংসি প্রদেশের চিউচিয়াং শহর ও আনহুই প্রদেশের থুংলিং শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা প্রতিরোধে কয়েক হাজার সৈন্য পাঠানো হয়। চিউচিয়াং শহরের ১০টি জেলায় ২৩০০ জনেরও বেশি সৈন্য পাঠানো হয় এবং চিয়াংসি প্রদেশের বোইয়াং জেলায় দেড় হাজার সৈন্যকে ৬টি দলে ভাগ করে পাঠানো হয়। তারা বাঁধ নির্মাণ, বাঁধের গুহার মেরামত ও সুসংবদ্ধ কাজের দায়িত্ব পালন করেন। একদিনের মধ্যে ৪০০০ মিটার লম্বা বাঁধ নির্মাণ করেন এবং বাঁধের ১৪টি গুহা মেরামত করেন।
১২ জুলাই থেকে চীনের বন্যা-সতর্কতা ৩ থেকে ২-এ উন্নীত করা হয়। ঝড়বৃষ্টির কারণে ইয়াংসি নদীর মাঝারি ও নিম্নপর্যায়ের শাখা নদী এবং আশেপাশের অনেক হ্রদের পানির পরিমাণ সতর্কতা-রেখা ছাড়িয়ে যায়, যা ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার প্রায় সমান। এ পরিপ্রেক্ষিতে চীনের চিয়াংসি, আনহুই, হুপেই, হুনান এবং ছোংছিং এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মোট ৬০ কোটি ইউয়ান দেয় চীনের কেন্দ্রীয় সরকার।
বন্যার দুর্যোগ প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি বার বার বন্যা প্রতিরোধ কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন। ২৮ জুন তিনি জোর দিয়ে বলেন, জনগণের জীবনের নিরাপত্তাকে সবার আগে রাখতে হবে। ১২ জুলাই তিনি আবার জোর দিয়ে বলেন, জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আসলে দু'বার নির্দেশনার মূল বিষয় 'জনগণকে গুরুত্ব দেওয়া আর জীবনের ওপর মনোযোগ দেওয়া'।
এমন চিন্তাভাবনা সবসময় সি'র মনে থাকে। চলতি বছরের শুরুতে যখন কোভিড-১৯ মহামারী চীনে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সি'ও একই কথা বলেছিলেন: জনগণকে সবসময় প্রথম স্থানে রাখতে হবে।
বন্যা প্রতিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর এ দায়িত্বও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কঠোর বন্যা প্রতিরোধক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সি বিভিন্ন এলাকার সরকারি অফিস ও কর্মকর্তাদের বলেন, জনগণকে সবসময় প্রথম স্থানে রাখতে হবে, তাদের জীবন রক্ষায় চেষ্টা করতে হবে। বন্যার পূর্বাভাস, বাঁধের পরীক্ষা ও মেরামত, জরুরি অবস্থার মোকাবিলা এবং বন্যা প্রবাহিত এলাকা বা দুর্গত এলাকায় বাসিন্দাদের স্থানান্তর ও উদ্ধারকাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, 'যেখানে বিপদ, যেখানে চ্যালেঞ্জ বেশি; যেখানে জনগণ সাহায্য প্রয়োজন, সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের যেতে হবে।' জনগণকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তাদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে সিপিসি'র সদস্যদের দায়িত্ব। সাথে সাথে তিনি জরুরি দুর্যোগ মোকাবিলা বিভাগ, জলসেচ বিভাগ ও গণমুক্তি ফৌজসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের সমন্বয় জোরদারে নির্দেশনা দেন, যাতে সবার যৌথ প্রয়াসে বন্যা প্রতিরোধক কাজ সফল হয়। যেমন, ইয়াংসি নদীর প্রবাহিত এলাকায় বহু জলবাঁধের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের মাধ্যমে তিন গিরিখাতের নিম্ন এলাকার শাখা নদীর বন্যা প্রতিরোধ করা হয় এবং হুয়াংহ্য নদীর আশপাশের বালি অপসারণ ও কমানোর মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধক করা হয়।
২০২০ চীনা জনগণের জন্য অসাধারণ একটি বর্ষ। কোভিড-১৯ মহামারী ঠেকানোর কাজ এবং বন্যা প্রতিরোধক কার্যক্রম—উভয়ই চীনা জনগণের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। মহামারী ঠেকাতে গিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং লোকজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়নস্ত্রণে মনোযোগ দেন সি এবং বন্যার প্রতিরোধে দুর্গত এলাকার জনগণের জীবন ও স্থানান্তরের ওপর গুরুত্ব দেন সি।
তাঁর পর্যবেক্ষণে মহামারী ও বন্যা প্রতিরোধ করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের জীবনমানও নিশ্চিত করতে হবে; বন্যা বা মহামারীর কারণে জনগণ যেন আবার দরিদ্র্যসীমার নিচে চলে না-যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেটি চলতি বছরের দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রার সাথেও জড়িত।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি সিপিসি'র সদস্যদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। সিপিসি'র বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্যোগ প্রতিরোধে নেতৃত্বের ভুমিকা পালন করা এবং দায়িত্ব পালন করার তাগিদ দেন তিনি। বড় ও কঠিন কাজের মাধ্যমে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি বারবার বলে আসছেন।
বাঁধ রক্ষা করা যেন নিজের বাড়ি রক্ষা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ। সিপিসি'র একজন তৃণমূলের কর্মকর্তা এমন কথা বলেছেন। এ কথাও সি'র ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। কারণ, এ কথা থেকে সিপিসি'র মৌলিক লক্ষ্যমাত্রা বুঝা যায়। সিপিসি'র কর্মকর্তারা বন্যার সাথে সংগ্রাম করলে এবং জনগণকে নিয়ে বন্যা প্রতিরোধ করলে অবশ্যই বন্যা ঠেকানো সম্ভব। কোটি কোটি মানুষের যৌথ প্রয়াসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে সুন্দর জীবন গড়ে তোলা সম্ভব।
সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn
তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)