টানা কয়েকদিন ধরে সাংবাদিকরা বন্যা প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সাংবাদিকরা লক্ষ্য করেছেন যে, অনেক বাঁধরক্ষাকারীদের অনেকের নামে 'পানি' জাতীয় শব্দ রয়েছে। তাদের নামের মধ্য দিয়ে তুংথিং হ্রদে বসবাসকারীদের পানি ও বন্যা সম্পর্কিত ইতিহাস প্রতিফলিত হয়।
কোথায় বিপদ আছে, কোথায় যাবেন
গত রোববার দুপুরে, সাংবাদিক তুংথিং হ্রদের কাছের হুনান প্রদেশের চিনসি শহরে যান। সেখানে বন্যার কারণে একটি প্রাদেশিক পর্যায়ের সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাছের জেলা পর্যায়ের সড়কপথ পরিবর্তন করতে হয়।
চিনসি শহরের পাই ই থানায় সাংবাদিক দেখেন যে, বন্যা প্রতিরোধের লাইন বা বাঁধ ঠিক চোখের সামনেই। রাস্তার দু'পাশের অনেক ধানক্ষেত বন্যায় বিলীন হয়ে গেছে, জেলা পর্যায়ের সড়কও বিপদে পড়েছে।
পাই ই থানার সিপিসি'র শাখা সম্পাদক লিউ বো বন্যা প্রতিরোধকাজের কর্মকর্তা ও জনসাধারণের নেতৃত্ব দিয়ে বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণ করছেন। তারা বড় বড় ব্যাগে মাটি রাখেন, তারপর এসব ব্যাগ দিয়ে বাঁধ তৈরি করেন। প্রতিটি ব্যাগের ওজন ৪০ কেজির বেশি।
বন্যা প্রতিরোধের বাঁধ নির্মাণের পর সাংবাদিক লিউ বো-এর সাক্ষাৎকার নেন। তিনি তুংথিং হ্রদের কাছে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এখনও মনে আছেন, ছোটবেলায় তাঁর জন্মস্থানে বন্যা হতো। তাঁর বাবা কাঁধে দুটি ঝুড়ি বহন করতেন। একটি ঝুড়িতে লিউ বো, আরেকটি ঝুড়িতে লিউ বো'র ছোট ভাই। লিউ বো বলেন, ঝুড়িতে করে আমি ও আমার ছোট ভাইকে নিয়ে আমার বাবা দশ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাহাড়ে গিয়ে উঠতেন শুধু বন্যা এড়ানোর জন্য।
বাবা আমাকে লিউ বো-এর নাম দিয়েছেন, আমার ছোট ভাই-এর নাম লিউ ইয়ুং। আমাদের দু'জনের নামে পানির অর্থ প্রতিফলিত হয়। আমাদের তুংথিং হ্রদ এলাকায় অনেকের নাম পানির সঙ্গে সম্পর্কিত। এমন নাম রাখার মাধ্যমে বিশ্বাস করা হতো যে, বন্যা হলেও নিরাপদ থাকা যাবে, দুর্যোগ হলে ক্ষয়ক্ষতি হবে না।
বর্তমান দিনগুলোতে লিউ বো এবং পাই ই থানার শতাধিক কর্মকর্তা দিন রাত ধরে বন্যা প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে কাজ করে যাচ্ছেন। লিউ বো বলেন, ছোটবেলায় আমার বাবা প্রতি শীত্কালে বেলচা ও ঝুড়ি নিয়ে বাঁধ মেরামতে যেতেন। এখন এই বাঁধ লাখ লাখ মানুষের জীবন ও সম্পদকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। এর ভিত্তিই আমাদের বংশের লোকজনের বসতি। পাই ই থানায় এখন তিনটি জলাধার আছে। এটি রক্ষায় শতভাগ মনোযোগ দিতে হয়। সবচেয়ে বিপদের জায়গা কোথায়, আমি ও থানার সিপিসি'র সদস্যরা সেখানেই যাবো।
বন্যা প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইন হলো সবচেয়ে ভালো শ্রেণিকক্ষ
তুংথিং হ্রদের দক্ষিণ তীরে নানজুই নামে একটি থানা আছে। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে সাংবাদিক নানজুই থানার বাঁধে উঠে দেখেন, তুংথিং হ্রদের পানির উচ্চতা বাঁধের ওই পাশে জনগণের দু'তলা বাড়ির সমান! এ দৃশ্য সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর!
নানজুই থানার প্রধান লিউ হুং অর্ধেক মাস ধরে এই বাঁধ রক্ষা করছেন। এর মধ্যে হ্রদের পানির উচ্চতা বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। অবস্থা অনেক বিপদজনক।
লিউ হুং বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে বাঁধের পাশে বড় হয়েছি, আমার নামে 'হুং' শব্দের অর্থ 'বন্যা'; কারণ আমার জন্মের বছর বন্যা হয়েছিল।
এই অর্ধেক মাসে, লিউ হুং বাঁধরক্ষাকারীদের সঙ্গে টহল দেন, বিপদ কাটানোর চেষ্টা করেন। যাতে নিরাপদে বন্যা মোকাবিলা করা যায়।
লিউ হুং বলেন, বন্যা প্রতিরোধ পদ্ধতি আমাদের হ্রদ এলাকার জনগণের বহু বছরের মূল্যবান অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হয়েছে। তিনি ও থানার অন্যান্য কর্মকর্তারা এ সময় জনসাধারণের সঙ্গে যৌথভাবে বাঁধ রক্ষা করেছেন, দিন রাত ধরে একসাথে থাকায় তিনি হ্রদ এলাকার জনগণের বন্যার সঙ্গে লড়াইয়ের দৃঢ় সংকল্প উপলব্ধি করেছেন।
লিউ হুং বলেন, যদিও বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তবে বন্যা প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইন হলো আমার মতো অন্যান্য কর্মকর্তার শিক্ষা নেওয়ার সবচেয়ে ভালো শ্রেণিকক্ষ।
'জলসেচ মানুষ'-এর চিন্তাধারার কখনই পরিবর্তন হবে না
তুংথিং হ্রদ অঞ্চলে হুনান প্রদেশের আন সিয়াং জেলা অবস্থিত। জুলাই মাস থেকে ইয়াংসি নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, বন্যা ও মুষলধারে বৃষ্টি এই তিনটি দুর্যোগ জেলার ওপর আঘাত হানে।
৩৪ বছর বয়সী ওয়াং হুং বো হলেন আন সিয়াং জেলার তা জিং কাং থানার বন্যা প্রতিরোধকারী কর্মকর্তা। তাঁর নাম 'হুং বো' –এর অর্থ বড় বন্যা। কারণ তাঁর জন্মের বছর ভয়াবহ বন্যা হয়, তাই তাঁর বাবা মা তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন।
বন্যাকালে ওয়াং-এর প্রতিদিনের জীবনযাত্রার গল্প শুনুন এবার।
ভোর তিনটায় বিছানা থেকে উঠতে হয়, গাড়ি চালিয়ে জেলায় যাওয়া, দু'এক ঘণ্টা সময় নিয়ে বন্যা প্রতিরোধ দলের ১৪০ জনেরও বেশি সদস্যের জন্য শাকসবজি কেনা, তারপর দলের রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়ে সবার জন্য রান্না করা। সকালে দলের সদস্যদের নেতৃত্ব দিয়ে বাঁধে নিয়ে যাওয়া, টহল দেওয়া, বিপদজনক অবস্থা থাকলে তা দূর করা। এভাবে কেটে যায় সারা দিন। এরপর রাতে লোকদের পরিবারে গিয়ে খোঁজখবর নেন তিনি।
খাঁ খাঁ রোদ হোক অথবা মুষলধারে বৃষ্টি হোক— এ কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ করা যায় না।
প্রতিদিন, প্রায় মধ্যরাতে তিনি শুতে যান। সবসময় ঘাম ও বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় প্রতিদিন অন্তত তিনবার পোশাক পরিবর্তন করতে হয়।
তিনি বলেন, ঘুম যথেষ্ট হয় না, সবসময় ঘুম পায়। খুব বেশি ঘুম পেলে আমি নিজের গালে চড় মারি। তিনি বলেন, আমি মনের জোরে জেগে থাকি। হ্রদ এলাকার সব মানুষ জানে যে, বাঁধ রক্ষা করা মানে মানুষের প্রাণ রক্ষা করা। আমি সিপিসি'র সদস্য, আমি গ্রামের কর্মকর্তা, যে কোনও সমস্যায় আমি সবার আগে ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়াবো।
আন সিয়াং জেলার আরেকজন বন্যা প্রতিরোধ কর্মকর্তা লিউ হুং লিউ, বন্যার সময় তিনিও নিজ পদে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ২০০৩ সালের পর থেকে এটাই হলো আমাদের জেলার সবচেয়ে গুরুতর বন্যা। আমরা ৮০ বারেরও বেশি পানির বিপদসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার সতর্কতা পেয়েছি।
লিউ হুং লিউ তুংথিং হ্রদের তীরে 'জলসেচ' পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা থানার জলসেচ স্টেশনের প্রধান, সারা জীবন পানি নিয়ে কাজ করেছেন। তাই ছেলেকে 'হুং লিউ' নাম দিয়েছেন, এর অর্থ বড় ঢেউ। ১৯ বছর বয়সে লিউ হুং লিউ কাজে যোগ দেন। তাঁর প্রথম চাকরি হলো বাঁধ রক্ষা।
১৯৯৮ সালে হুনান প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। সে কঠিন গ্রীষ্মে লিউ নিরাপত্তা রক্ষার কাজ করেছিলেন। সে বছর বন্যা প্রতিরোধকর্মীরা তথ্য বিনিময়ে রেডিও ব্যবহার করতেন, পানির উচ্চতা পরিমাপ করতে মানুষ আধা ঘণ্টা পর পর রুলার নিয়ে উচ্চতা মাপতেন। তিনি দেখেছেন, বন্যা বাঁধ উপচে লোকালয়ে এলে মানুষজন পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাঠের নৌকা, কাঠের দরজা বা কাঠের গামলায় চড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়!
লিউ বলেন, এখন বন্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত ও সুবিধাজনক হয়েছে। অনেক বিষয় পরিবর্তন হয়েছে, তবে আমাদের জমির কোনও পরিবর্তন হয় নি, নদনদীর পরিবর্তন হয় নি, জনগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই চিন্তাধারার পরিবর্তন কখনই হবে না।