কুও বলেন, চলতি বছর আমাদের সুন্দর গ্রামের নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সাদা দেয়াল, পুরো গ্রামে পিচঢালা রাস্তা, রাস্তার দুই পাশে রঙিন ফুল। তবে দুই বছর আগে গ্রামের অবস্থা এত সুন্দর ছিল না।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কুও গ্রামের কর্মী হিসেবে ইয়ুং শেং গ্রামে দারিদ্র্যমোচন কাজে যোগ দেন। তিনি বলেন, তখন গ্রামের সব পথ ছিল মাটির। যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় কৃষকের কৃষিজাত দ্রব্য সময়মতো গ্রামের বাইরে পরিবহন করা যেত না। দেখতে দেখতে সেসব কৃষিজাত পণ্য জমিতে পচে নষ্ট হয়ে যেত।
কৃষকরা ভালো শিক্ষিত ছিল না। আয়ের উত্স ছিল সহজ ও অস্থিতিশীল। কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল বেশি, মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। এ ছাড়া, গ্রামের চিকিত্সাকক্ষে কোনো চিকিত্সক ছিল না, কোনো যন্ত্র ও ওষুধ ছিল না। কৃষকের কোনো চিকিত্সার নিশ্চয়তা ছিল না। গ্রামে কোনো দারিদ্র্যবিমোচনের প্রকল্পও ছিল না। এই কুও ইয়ুং শেং গ্রামে পৌঁছার প্রথম দিকের অবস্থা।
কুও বলেন, আমি চাই কৃষকরা আমাকে গ্রহণ করুক। জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে চাইলে শুধু আন্তরিক থাকাই যথেষ্ট নয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গ্রামকে সেবা দেওয়ার জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জনগণকে সেবা করার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। আমাকে শুরুর দিকেই এসব বিষয় শিখতে হয়েছিল।
অভিজ্ঞ কর্মী, গ্রামের কৃষক, কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ, সবাই তাঁর শিক্ষক হতে পারেন। সময় পেলে তিনি সবার কাছ থেকেই শিখেন। দরিদ্র গ্রামকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাইলে স্পষ্টভাবে প্রত্যেক পরিবারের অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রত্যেক পরিবারের অবস্থা জানার জন্য তিনি প্রত্যেক পরিবারে যান, দরিদ্র মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের দারিদ্র্য হওয়ার কারণ খুঁজে বের করেন, তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা, জীবনের অবস্থা, পরিবারের নানা সমস্যার কথা জেনে নেন।
এর ভিত্তিতে, কুও 'এক মানুষের জন্য একটি নীতির' সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যে মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব, তিনি তার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। যে পেশাদার কাজ শিখতে চায়, তিনি তাদের জন্য পেশাদার প্রশিক্ষণের ক্লাস আয়োজন করেন। রোগের কারণে দরিদ্র হওয়া মানুষের কাছে কুও দেশের চিকিত্সা সহায়তা নীতি ব্যাখ্যা করেন, তাদের সময়মতো হাসপাতালে চিকিত্সা সাহায্য দেন। যারা দরিদ্রতার কারণে স্কুলে যেতে পারে না, তাদের জন্য দেশের শিক্ষা খাতের সহায়তা নীতি ব্যাখ্যা করেন এবং সাহায্য দেন। যারা প্রতিবন্ধী, তাদের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবন্ধী ভর্তুকি আবেদন করেন।
প্রতিদিনের কাজে তিনি সবসময় এমন দরিদ্র মানুষ পান, যারা বস্তুগত দরিদ্রতা ছাড়া অন্যান্য দরিদ্রতায় জর্জরিত। যেমন, মানসিক দরিদ্রতা, চিন্তাধারার দরিদ্রতা ও জীবন পরিবর্তনের সংকল্প বা দৃঢ়তার অভাবের কারণে দরিদ্রতা।
কুও বলেন, বস্তুগত ও মানসিক-- এই দুটি দিক দিয়েই দরিদ্র মানুষকে সাহায্য দিতে হয়। একদিকে, তাদেরকে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার আস্থা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে, তাদেরকে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পদ্ধতি শেখাতে হবে; যাতে তারা নিজের হাতেই দারিদ্র্য দূর করতে পারে।
প্রত্যেকবার দরিদ্র পরিবারে যাওয়ার সময়, তিনি ধৈর্যের সঙ্গে দরিদ্র মানুষের কাছে দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের তাত্পর্য ও বিস্তারিত নীতি ব্যাখ্যা করেন, তাদের নিজেদের চেষ্টায় দারিদ্র্যমুক্তকরণে উত্সাহ দেন।
এ ছাড়া কুও 'ইয়ুং শেং গ্রামের নতুন ধরনের পেশাদার কৃষকের প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা' প্রণয়ন করেন। তিনি বিদ্যুত্কর্মী, হস্তশিল্প, অর্গানিক শাকসবজির চাষ, ফুল-ফল চাষসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রশিক্ষণ ক্লাসের ব্যবস্থা করেন। এতে ৭১২জন নতুন ধরনের পেশাদার কৃষক প্রশিক্ষিত হন।
২০১৮ সালে গ্রামের নিবন্ধিত দরিদ্র মানুষ হৌ চেন ফা কুও-এর সাহায্যে সফলভাবে একটি হস্তশিল্প সহযোগিতা কমিটি স্থাপন করেন। কুও দরিদ্র হৌকে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও মেলায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেন। এর মাধ্যমে হৌ নিজের হস্তশিল্পকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেন। ২০১৯ সালে কুও গ্রামে অনলাইন লাইভের মাধ্যমে গ্রামের বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রির চেষ্টা শুরু করেন। দরিদ্র মানুষ হৌ–এর মাধ্যমে নিজের হস্তশিল্পও বিক্রি করেন।
চলতি বছর করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ইয়ুং শেং গ্রাম অবরুদ্ধ হয়। গ্রামের বিভিন্ন সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে দারিদ্র্যবিমোচনের অন্যতম পণ্য—ডিম বিক্রি করা একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কুও একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই প্ল্যাটফর্মের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে ইয়ুং শেং গ্রামের ডিমের সুবিধা অবহিত করেন। এর ফলে ইয়ুং শেং গ্রামের ডিম অনলাইনে বিক্রি শুরু হয়।
কয়েক বছর চেষ্টার পর, এখন ইয়ুং শেং গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন শিল্পের উন্নয়নও সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে। কৃষকের আয় বেড়েছে, কৃষক আরো ভালোভাবে শিক্ষিত হয়েছে, গ্রামের পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।
এখন ইয়ুং শেং গ্রামের চেহারার আকাশ পাতাল পরিবর্তন দেখা যায়। গ্রামে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা নাচ-গানের আয়োজনও করা হয়। মাঝে মাঝে পেশাদার শিল্পী দলও গ্রামে এসে গান পরিবেশন করেন। প্রতি বছর গ্রামে 'শিল্পী উত্সবের' আয়োজনও করা হয়।
কুও বলেন, এখন শহরের অনেক বন্ধু মনে করে গ্রামে আমার জীবন অনেক ভালো। আমার গ্রামে ৮৩২টি পরিবারের ৩২৪১জন সদস্য আছে। এখন তারা সবাই আমার বন্ধু। কুও-এর বয়স ২৮ বছর, তাঁর এখনও বিয়ে হয় নি; বান্ধবীও নেই তাঁর। তিনি খুব লাজুকভাবে বলেন, প্রতিদিন কৃষকদের সঙ্গে খাই, কাজ করি, আমার কোনো সময় ও সুযোগ নেই। বান্ধবী কীভাবে খুঁজবো? একদম সময় নেই।
দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ শেষ হোক, তারপর আমি বিয়ের কথা বিবেচনা করবো।