২০২০ চীনে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত ও সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলার চূড়ান্ত বছর। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের হ্য লং চিয়াং প্রদেশ দেখতে যাবো। গেল কয়েক বছরে ওখানে কী পরিবর্তন হয়েছে ও সেখানকার মানুষের জীবনযাপন কেমন, তা আমরা দেখবো।
থুং চিয়া শহর, হ্য লং চিয়াং প্রদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। একটি নদী অতিক্রম করলে দেখা যায় রাশিয়ার ইহুদি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। তার মানে থুং চিয়া শহর চীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরও বটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় বড় কোম্পানির নেতৃত্বে থুং চিয়াং শহরে উন্নয়ন হয় গোলাপ চাষ এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং স্থানীয় কৃষকদের দারিদ্র্যমুক্ত হতে সাহায্য করে।
প্রায় দুপুর সময়ে, থুং চিয়াং শহরের হ্য চ্য জাতি স্বায়ত্তশাসিত উপজেলার গ্রামবাসিন্দা থেং সি লিয়াং গোলাপ বাছাই করতে ব্যস্ত। এ গোলাপগুলো পরে কারখানায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। তার পাশে ২০০ মু গোলাপ ক্ষেতে অন্য কয়েকজনও কাজ করছেন। তিনি বলেন, (রে)
"এ বছর গোলাপের ফলন ভাল হয়েছে। বড় গোলাপ দিয়ে আমরা গোলাপ জ্যাম তৈরি করব এবং তুলনামূলক ছোট ফুল থেকে আমরা তেল উত্পন্ন করব। সবচেয়ে ছোট গোলাপ ফুল দিয়ে আমরা চা তৈরি করব। সবকিছুই কাজে লাগবে।"
প্রতিদিন ভোর ৪টায় কর্মীরা এখানে এসে ফুল বাছাই করতে শুরু করে এবং গড়ে ৭-৮ ঘন্টার মতো কাজ করে। দুপুরে প্রায় কাজ শেষ হয়। প্রত্যেকে ৩৫-৪০ কেজি ফুল বাছাই করতে পারে এবং এক কেজি করলে তাকে ৪ ইউয়ান দেয়া হয়। তার মানে প্রত্যেকে প্রতিদিন গড়ে ১৪০ ইউয়ান অর্জন করতে পারে।
থেং সি লিয়াং আরও বলেন, প্রতি জুন মাস গোলাপ ফুল তোলার সময় এবং গোলাপ চা খুব ভাল বিক্রি হয়। জুলাই মাসে গোলাপ জ্যামের ঋতু। গ্রামবাসিন্দারা এখানে গোলাপের সুঘ্রাণ নেওয়ার পাশাপাশি টাকা অর্জন করতে পারে। কী আনন্দের ব্যাপার!
থেং সি লিয়াং জানান, গোলাপ চা তৈরি করতে চাইলে তিনি মূলত গোলাপ শুকানোর কাজ করেন এবং জ্যাম তৈরি করতে চাইলে তিনি মধু দিয়ে আলোড়ন করেন। সব সহজ কাজ।
তিনি এখন লুই নং নামের একটি কৃষি সমবায়ে কাজ করছেন। এ সমবায়ের ১৬০০০ মু জমিতে গোলাপ ছাড়া চাষ করা হয় সয়াবিন এবং ভুট্টা। সমবায়ের সদস্য ৫০০ জনের বেশি এবং সবাই একই উপজেলার মানুষ। গ্রামবাসিন্দারা জমি বা টাকা দিয়ে সমবায়ে যোগ দিয়ে পারেন এবং প্রতিবছর ইকুইটি অনুযায়ী লভ্যাংশ পেতে পারেন।
সমবায়ের পরিচালক লিও চিন চিয়াং জানান, গোলাপ চাষের জন্য প্রচুর পরিশ্রম দরকার। নিড়ানি, ব্যবস্থাপনা, ফুল বাছাই—সব প্রক্রিয়ায় কর্মী দরকার। তাই বেশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
থেং সি লিয়াং তার জমি দিয়ে সমবায়ে যোগ দিয়েছেন। প্রতি বছরে তিনি ৩০ হাজার ইউয়ান লাভ পেতে পারেন। তা ছাড়া, সমবায়ে ৪ মাসের মতো কাজ করলে তিনি আরও ২০ হাজার ইউয়ান আয় করতে পারেন। জমি সমবায়ে দিয়ে তিনি অতিরিক্ত সময়ও পেয়েছেন এবং অন্য কাজ করতে পারছেন। তিনি বলেন, আগে জমিতে চাষ করলে বছরে মাত্র ৩০ হাজার ইউয়ান আয় হতো। এখন তার আয় অনেক বেড়েছে।
লিউ চিন চিয়াং বলেন, 'সমবায়+দরিদ্র পরিবার'—এ পদ্ধতির মাধ্যমে তারা উপজেলার ১০৪টি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে 'স্বার্থের সংযোগ ব্যবস্থা' গড়ে তুলেছেন। সমবায় প্রতিবছর প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে ২৫০০ ইউয়ান করে লভ্যাংশ দেয়।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বয়ে যাওয়া নদীর ওপর রেলসেতু অদূর ভবিষ্যতে চালু হবে এবং তখন পেঁয়াজ, আলু, টমেটো ও শসাসহ নানান শাকসবজি রাশিয়ায় রপ্তানি করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, শাকসবজির রপ্তানিব্যয় বেশি এবং সেগুলো তাজা রাখাও কঠিন একটি ব্যাপার। রেলপথ চালু হবার পর শাকসবজি সরাসরি রাশিয়া পাঠানো হবে এবং তারা ভবিষ্যতে শাকসবজি চাষ করবে। গ্রামবাসিন্দাদের আয় আরও বাড়বে।
এ
বার আমরা হ্য লং চিয়াং প্রদেশের ফু ইউয়ান শহর দেখতে যাব
ফু ইউয়ান চীনের সর্বপুবে অবস্থিত। একে চীনের পূর্ব মেরু বলেও ডাকা হয়। এ শহরটি রাশিয়ার কাছাকাছি এবং কয়েক বছর আগে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় সীমান্ত অবাধ বাণিজ্য এলাকা। তাদের বিশেষ আরও একটি উদ্যোগ হল 'দারিদ্র্যবিমোচন শেয়ার হিসাব'। ভোক্তারা এখানে একবার কেনাকাটা করলে তার একটি অংশ 'দারিদ্র্যবিমোচন শেয়ার হিসাব'-এ যাবে। এ অর্থ স্থানীয় দারিদ্র্যবিমোচন কাজে ব্যবহার করা হবে।
হেই লং চিয়াং প্রদেশের ফু ইউয়ান সীমান্ত বাণিজ্য বাজারে ওয়াং থিং নামের একজন মেয়ে ক্রেতার কাছে রাশিয়া থেকে আমাদিকৃত পণ্যের পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি বলেন, শ্যাম্পু, আইসক্রিম ও মাস্কসহ নানান পণ্য খুব জনপ্রিয়। শুরুতে তিনি নিজে এ পণ্য ক্রয় করে ব্যবহার করেন এবং পরে তিনি এ পণ্য বিক্রয় শুরু করেন। বিশেষ করে মেয়েরা অঙ্গরাগ পছন্দ করে এবং এসব পণ্য শুল্কমুক্ত।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে চালু হয় সীমান্ত বাণিজ্য এলাকা এবং ওয়াং থিং এখানে আসা প্রথম ব্যবসায়ীদের একজন। ৫ বছরে তার জীবন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বলেন, শুরুতে তিনি শুধু কয়েক ধরনের পণ্য বিক্রয় করতেন এবং প্রথম দু'এক বছরে কোনো লাভ হয়নি বললেই চলে। পরে তিনি রাশিয়া থেকে নতুন ধরনের পণ্য নিয়ে আসেন এবং বিগত দু'বছর ধরে তার লাভ বেড়েছে। গত বছর তার নিট মুনাফা ছিল ৫ লাখ ইউয়ান। তিনি প্রায় সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন।
ফু ইউয়ান বাণিজ্য ও বন্দর ব্যুরোর উপ-প্রধান নিয়ে চি কান বলেন, সীমান্ত বাণিজ্য এলাকা প্রতিষ্ঠার পর তার আকার দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৩০ জন ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন এবং তারা ২০ হাজারের বেশি ধরনের পণ্য বিক্রয় করেন। এ পর্যন্ত বিনিময়ের পরিমাণ ৩১ কোটি ইউয়ানের বেশি।
ফু ইউয়ান শহরে দরিদ্র মানুষের অধিকাংশই প্রতিবন্ধী বা শ্রমশক্তি হারানোর কারণে দরিদ্র হয়েছেন। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারিদ্র্যবিমোচন শেয়ার হিসাব। সীমান্তা বাণিজ্য, গ্রামীণ পর্যটনসহ নানান প্রকল্প থেকে অর্জিত টাকা এ হিসাবে যোগ দেয়া হয় এবং পরে আবার তা দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এর মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য এলাকা ইতোমধ্যেই এ হিসাবে ৩০ লাখ ইউয়ানের বেশি অর্থ দিয়েছে এবং ফু ইউয়ান শহরের প্রত্যেক দরিদ্র মানুষ প্রতি বছর এর থেকে ১০০০ ইউয়ান করে পেয়ে থাকে। যেমন, ছু নামের একজন নারী এ প্রকল্প থেকে উপকৃত হন। তার কোনো জমি নেই, তিনি নিজে একজন প্রতিবন্ধী এবং অন্য রোগেও আক্রান্ত। ২০১৬ সালে তার স্বামী মারা যায় এবং দশ হাজার ইউয়ানের ঋণ ছেড়ে যায়। ঠিক ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারিদ্র্যবিমোচন শেয়ার হিসাব এবং তিনি এর থেকে ১০০০ ইউয়ান করে পাচ্ছেন। বেশি না-হলেও তার জন্য খুব প্রয়োজনীয় এ টাকা। তিনি বলেন, 'তখন আমার স্বামী মেরা গেছেন এবং চিকিত্সার ব্যয় অনেক বেশি। জীবনযাপনের চাপ তীব্র।' ছু শিট জেলি নামের একটি খাবার ভাল করতে পারেন। গেল কয়েক বছরে, দারিদ্র্যবিমোচন কর্মদলের সাহায্যে তিনি শিট জেলি তৈরি করে বিক্রয় করছেন এবং এ ব্যবসার মাধ্যমে ২০১৯ সালে তার নিট আয় হয় ৮০০০ ইউয়ান। এখন প্রতিবছর তিনি ২০ হাজার ইউয়ান আয় করতে পারেন এবং নতুন বাসায় বাস করেন। তার ঋণও শোধ করা হয়েছে। তার জীবনযাপনের মানও দিন দিন ভাল হয়ে উঠেছে। ৭০ বছর বয়সী ছুর জন্য সচ্ছল জীবন মানে কোনো চিন্তা নেই এবং কিছুর অভাব নেই। ঠিক এখন তার জীবনের মতো। (শিশির/আলিম/রুবি)