জুন মাস, গম ফসলের সময়। চীনে বৃহত্তম খরা এলাকা সিনচিয়াংয়ের শেষ জেলাটিতে মানুষ খেতে পারছে কলের পরিষ্কার ও মিষ্টি পানি। চিয়া সি নামের এ জেলায় পানিতে অতিরিক্ত ফ্লুরিন এবং আর্সেনিক রয়েছে বিধায় তা খেতে তিক্ত ও লবণাক্ত। এ পানি পান করে অনেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতো।চিয়াসি জেলার মানুষের মতো, মরুভূমি ও বড় বড় পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত থালিমু উপত্যকার মানুষ দীর্ঘকাল ধরে পরিষ্কার পানীয় জলের অভাবে ভুগছিল। তিক্ত পানি খেয়ে অসুস্থ হতেন তারা এবং অসুস্থতার কারণে হতেন দরিদ্র। এ এক দুষ্ট চক্র। এ থেকে যেন তাদের রেহাই ছিল না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও সিনচিয়াং স্থানীয় সরকার বছরের পর বছর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে বড় মরুভূমি ও পাহাড়ের মধ্যে পরিষ্কার পানি আবিষ্কার করা সহজ কাজ নয়। অবশেষে, চলতি বছরের গ্রীষ্মকালে, চিয়াসি জেলাসহ অন্যান্য জেলার শেষ ১৫.৪ হাজার মানুষ পরিষ্কার পানি পেতে শুরু করেন। চীনের বৃহত্তম খরা এলাকা সিনচিয়াংয়ে সব পরিবার এখন যুক্ত হয়েছে কলের পানির সঙ্গে।
থালিমু উপত্যকায় এমন একটি কথা প্রচালিত ছিল: নান চাইলে দিব, কিন্তু পানি চাইলে প্রাণ থাকতে দিব না। পানি এতদঞ্চলের সবচেয়ে মূল্যবান একটি জিনিষ ছিল। মরুভূমির সীমান্তে বেঁচে থাকার জন্য, মানুষ মরুদ্যানে এক-একটি জলের আধার খনন করতো। এ আধারগুলোর আকার ছোট বা বড়। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে বরফ ও তুষার থেকে সৃষ্ট পানি এখান থেকে পান করতো মানুষ ও গৃহপালিত পশু।
এ পানি খেতে কী রকম ছিল? স্থানী মানুষ বলে, তিক্ত, গাছের পাতা খাওয়ার মতো।
মো ইউয়ু জেলার বাসিন্দা দু'জন জানান, পানি খেতে তিক্ত এবং পানি আনার প্রক্রিয়া কঠিন। পানি আনার পথে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হতো। প্রাপ্ত পানিও পরিষ্কার নয়; বরং নানান রঙের। কখনও কখনও কালো চায়ের মতো; কখনও কখনও সবুজ রঙের। মাঝেমাঝে পানিতে পাওয়া যেতে পোকা ও আবর্জনা। পানি খাওয়ার আগে ছেকে নিতে হতো। কখনও কখনও মানুষ ও পশু একই পিট থেকে পানি খেত। প্রায় প্রতি গ্রীষ্মকালে একাধিক শিশু নিয়ম করেই যেন এসব পিটে ডুবে মারা যেত।
দীর্ঘসময় ধরে অস্বাস্থ্যকর পানি খাওয়ার কারণে এখানকার মানুষ সহজে সংক্রামক রোগ ও অন্য পানিবাহিত স্থানীয় রোগে আক্রান্ত হতো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পানির গুণগত মানের উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরুর আগে সিনচিয়াংয়ের ১.১ কোটি গ্রামীণ মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার খাবার পানির সংকটে ভুগতো। এর মধ্যে ২৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষের খাবার পানির গুণগত মান খুবই খারাপ ছিল।
পু চা খ্য গ্রাম হ্য থিয়ান জেলায় অবস্থিত। ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থনে সিন চিয়াংয়ে পশুপালন ও গ্রামীণ অঞ্চলে শুরু হয় বড় আকারের পানির মান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। তিন বছর পর পু চা খ্য গ্রামে স্থাপিত হয় প্রথম গভীর নলকূপ। স্থানীয় মানুষের জন্য পানি খুঁজে পাওয়ার জন্য তুং সি ফু নিজের পেশা পরিবর্তন করেন। তিনি খনির বদলে পানি আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি কঠিন একটি কাজ পান। ইউয়ু তাই খ্য লি খ্য নামের একটি জায়গায় কূপ খননের কাজ। এখানে পরিষ্কার পানি মাটির ২০০ থেকে ২৬০ মিটার নীচে রয়েছে এবং ভূতাত্ত্বিক কারণে এখানে কূপ খনন সহজ নয়। তুং সি ফু ও তার দল সব অসুবিধা কাটিয়ে উঠে ২০ দিনের মধ্যে একটি কূপ খনন করেন।
২০০৪ সালে সিন চিয়াংয়ে পানির কারখানা, পানির স্টেশন ও কূপ নিয়ে গঠিত হয় একটি নেটওয়ার্ক। মোট ৭০ হাজার কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হয় এবং ৯৫ লাখ ৪০ হাজার মানুষের খাবার পানি সমস্যার সমাধান করা হয়। তখন থেকে সিনচিয়াংয়ে পানিবাহিত সংক্রামক রোগে আক্রান্তের হার বিপুলভাবে কমেছে এবং পশুপালক ও কৃষকদের স্বাস্থ্য অনেক উন্নত হয়েছে।
তবে দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ে পানি মান উন্নয়নের কাজ শেষ হয়নি। ২০১৬ সালের গ্রীষ্মকালে, বেইজিং থেকে আসা বিশেষজ্ঞ সিন চিয়াং হ্য থিয়ান জেলায় পানির গুণগত মান নিয়ে গবেষণা করেন। স্থানীয় মানুষকে শুধু পরিষ্কার নয়, বরং স্বাস্থ্যকর পানি খাওয়াতে হবে। বেইজিংয়ের সাহায্যে সিনচিয়াংয়ের পানি কারখানার রূপান্তর ও আপগ্রেডেশান শুরু হয়। কলের পানি বেইজিংয়ের পানির মানের সমান হয়। পিট থেকে ভূগর্ভস্থ পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানি থেকে বেইজিং মানের কলের পানি—হ্য থিয়ানের মানুষের খাওয়ার পানি দু'বার আপগ্রেড করা হয়। পাশাপাশি সিনচিয়াংয়ের বড় ও ছোট গ্রামে স্থাপন করা হয় আধুনিক পানি পরিশোধন কারখানা। এখন মরুভূমির পাহাড়ি অঞ্চল ও মালভূমির মধ্য দিয়ে পরিষ্কার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। শেষে এসেছে চিয়াসি জেলায়।
চিয়াসি জেলার গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, 'এখানে ভালো পানি খোঁজার চেষ্টা আমরা কখনও পরিত্যাগ করিনি। এখানে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হয় এবং এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মান ভাল নয়। কূপ খনন করা হলেও দ্রুত অকেজো হয়ে যায়। বিশেষ ভূতাত্ত্বিক অবস্থার কারণে চিয়াসি জেলায় পরিষ্কার পানি সরবরাহ কঠিন একটি কাজ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থনে অন্য শহর থেকে আপনি চিয়াসি জেলায় আনা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ ১৭৪.৯ কোটি ইউয়ান এবং ৩টি জেলা অতিক্রম করে ১৮২৭ কিলোমিটার পাইপ তৈরি করা হয়েছে।'
চিয়াসি জেলায় এ প্রকল্প শেষ হবার সাথে সাথে সারা সিনচিয়াংয়ে বাস্তবায়ন হয় খাবার পানির নিরাপত্তা। তার মানে দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের কোটি কোটি মানুষ পানি ও মরুভূমি, তিক্ত ও মিষ্টির এ লড়াইয়ে চূড়ান্ত জয় লাভ করে।
মো ইউয়ে জেলার একটি গ্রামে ৭০ বছর বয়সী একজন প্রবীণ স্মরণ করে বলেন, তিনি জীবনে তিন ধরনের পানি খেয়েছেন। ৪০ বছরের মতো পিট থেকে পানি খেয়েছেন, ২০ বছরের মতো ভূগর্ভস্থ পানি খেয়েছেন এবং এখন তিনি বাড়িতে কলের পানি খাচ্ছেন। এ পানি তিন স্বাদের: তিক্ত, লবণাক্ত ও মিষ্টি।
তার কথা থেকে আমরা দেখি সিনচিয়াংয়ে পানির মান উন্নয়ন প্রকল্পের তিনটি পর্যায়। খাশি শহরে, একটি চা-দোকানের মালিক খুব আনন্দিত। তিনি বলেন, 'এখন পানির মান অনেক উন্নত এবং খেতে মিষ্টি। আমরা এখন মিষ্টি এ পানি দিয়ে চা তৈরি করি; পর্যটকরা তা খুব পছন্দ করেন।'
সিনচিয়াংয়ে মানুষের জীবনও এ পানির মতো দিন দিন মিষ্টি হচ্ছে। (শিশির/আলিম/রুবি)