গ্রীষ্মকালে চীনের বিখ্যাত হলুদ নদী তীরের শানসি প্রদেশের ইয়ু লিন শহরের জিয়া জেলায় বছরের সবচেয়ে সুন্দর সময় শুরু হয়।
৬৫ বছর বয়সী লি তুং ফাং-এর গৃহপ্রাঙ্গণে আপেল গাছ ও নাশপাতি গাছ সাবলীলভাবে বড় হচ্ছে। গত বছর তাঁর পরিবার দারিদ্র্যমুক্ত হয়। এখন তিনি গাছের ছায়ায় বসেন, বাসার ছয়টি নতুন ঘর দেখেন এবং নিজ দাদার রচিত গান 'পূর্ব দিকের আকাশ লাল হয়ে যায়' গান। এ গানটি তিনি দারুণ পছন্দ করেন।
জিয়া জেলা হলো বিখ্যাত হোয়াংহ্য বা হলুদ নদীর অববাহিকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে লালিত অন্যতম কঠিন স্থান। এ জায়গাটি চীনের মহান নেতা মাও সে তুংয়ের প্রশংসা করে লেখা গান 'পূর্ব দিকের আকাশ লাল হয়ে যায়' রচনার স্থান। চীনের গৃহযুদ্ধের সময় মাও সে তুং এখানে যুদ্ধ করতেন ও অবস্থান করতেন।
লি তুং ফাং হলেন 'পূর্ব দিকের আকাশ লাল হয়ে যায়' গানটির কথা রচনাকারী লি ইউ ইউয়ানের নাতবৌ। তাঁর বাসার কাছাকাছি পুরানো বাড়িতে লি ইউ ইউয়ান এই গান রচনা করেছিলেন।
এই পুরানো বাড়িঘর একদিকে চীনের বিপ্লবের সাক্ষী, অন্যদিকে লি তুং ফাং পরিবারের উন্নয়নের সাক্ষী।
আগের জীবনের কথা উল্লেখ করে লি তুং ফাং বলেন, আগে আমার স্বামীর পাকস্থলী ক্যান্সার ও ইউরেমিয়া রোগ ছিল। ১১ বছর ধরে চিকিত্সা করতে করতে আমার পরিবারের বিরাট ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের বাচ্চাও খুব ছোট ছিল। তখন জীবন ছিল অনেক কষ্টের।
২০১৪ সালে লি তুং ফাং-এর পরিবার দরিদ্র পরিবার হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এই লি তুং ফাং-এর স্বামী লি জিন ছুনের চিকিত্সা ফি বেশিরভাগ বহন করেছে সরকার। তাদের ছেলেমেয়ের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি নিজেই এখন বিভিন্ন কাজ করে টাকাপয়সা উপার্জন করেন। ৩ বছর আগে তাঁর পরিবার সব ঋণ থেকে মুক্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে লি তুং ফাং-এর পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
বর্তমান জীবন সম্পর্কে লি তুং ফাং হেসে হেসে সাংবাদিককে বলেন, এখন আমাদের জীবন বেশ ভালো, দেশের দারিদ্র্যমুক্তকরণ নীতিতে আমরা লাভবান হয়েছি। ছেলেমেয়েদের চাকরি আছে; আমরা তাদের জন্য আর দুশ্চিন্তা করি না। আমি নিজেই কুল গাছ চাষ করি, এর মাধ্যমে টাকাও আসে। আমাদের জীবন আগের চেয়ে এখন অনেক সুন্দর হয়েছে।
এখন ৫০ কিলোমিটার দূরে, জিয়া জেলার সিয়ে জিয়া গৌ গ্রামের প্রধান সিয়ে ওয়ান শেং চলতি বছর গ্রামের আয় হিসাব করছেন।
দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম শুরু হলে জিয়া জেলায় ৮টি দারিদ্র্যবিমোচন খামার নির্মাণ করা হয়। এতে ৬০ হাজারেরও বেশি কৃষক যোগ দেয় ও তাদের আয় বৃদ্ধি পায়। সিয়ে জিয়া গৌ গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন খামারে, ছাগল লালন প্রকল্প, কৃষি যন্ত্র কমিউনিটি, ফল ও শাকসবজির বাগানসহ ৮টি প্রকল্প তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে সিয়ে জিয়া গৌ স্থানীয় 'শিল্পের গ্রাম' হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। চলতি বছর গ্রামের মোট আয় ১০ লাখ ইউয়ানেরও বেশি হয়।
গ্রামের প্রধান সিয়ে ওয়ান শেং বলেন, আগে আমাদের গ্রামের তরুণ-যুবকরা গ্রামে থাকতে চাইত না। কারণ গ্রামের অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। এখন শতাধিক তরুণ-যুবক গ্রামে ফিরে এসেছে। তারা এখন আমাদের গ্রামের উন্নয়নের প্রধান শক্তি। সিয়ে ওয়ান শেং আরও বলেন, কিছু যুবক শহরে বাড়িঘর কিনলেও গ্রামে চাকরি ও উন্নয়নের সুযোগ আরও বেশি। তাই তারা দিনে গ্রামে এসে কাজ করেন; এরপর রাতে শহরে নিজের বাসায় ফিরে যান।
এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের বৈশিষ্ট্যময় শিল্পের মাধ্যমে আরও বেশি স্থানীয় মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত ও ধনী হচ্ছে।
জিয়া জেলা হলো চীনের লাল কুল চাষের শ্রেষ্ঠ এলাকা। লাল কুলকে স্থানীয় কৃষক দারিদ্র্যমুক্ত এবং ধনী হওয়ার 'শ্রেষ্ঠ ফলন' হিসেবে আখ্যায়িত করে। শ্রেষ্ঠ কুল উত্পাদনের জন্য জিয়া জেলা কুল বাগানের প্রযুক্তিগত রূপান্তর জোরদার করে। গত বছর পুরো জেলার লাল কুল উত্পাদন থেকে আয় ছিল ১.৫ বিলিয়ন ইউয়ান, যা পুরো জেলার জিডিপির ২৫ শতাংশ।
রাতে, জিয়া জেলার একটি রেস্তোরাঁয়, সেবক অতিথির জন্য জেলার কুল থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কুল মদ, কুল মিষ্টি ইত্যাদি। এসব কুল জেলার ওয়াং নিং শান গ্রামের চাষ।
ওয়াং নিং শান গ্রামটি হলো স্থানীয় বিখ্যাত 'কুল গ্রাম'। গ্রামে আধুনিক উত্পাদন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি বছর উত্পাদিত কুলের পরিমাণ ৫ হাজার টন।
গ্রামের প্রধান দু জুন ফেং বলেন, বর্তমানে গ্রামের কুল খুব তাড়াতাড়ি বাইরে বিক্রি করা যায়। কৃষকরা প্রতি বছর ৩০ লাখ ইউয়ানেরও বেশি আয় করেন। ২০১৯ সালে পুরো গ্রামের মাথাপিছু আয় ১১ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়; দরিদ্র পরিবারের আয়ও ৯.৩ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়।
২০১৯ সালে জিয়া গ্রামের কৃষকদের আয় প্রথমবারের মত ১০ হাজার ইউয়ান পার হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়া জেলা আনুষ্ঠানিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় কৃষক লিউ বলেন, এখন আমাদের জেলায় বিভিন্ন কৃষিজাত শিল্পের সুষ্ঠু উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদের জীবনও ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে।
সিনচিয়াং-এর গ্রামীণ চিকিত্সকের গল্প
গ্রীষ্মকালে চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একজন গ্রামীণ চিকিত্সক ম্যাটইমু সাংবাদিককে তাঁর গ্রামীণ জীবনের গল্প বলেন।
সিনচিয়াং-এর ক্যকইয়া গ্রামে ম্যাটইমু চিকিত্সক হিসেবে ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন। ১৯৮০ সালে ম্যাটইমু উচ্চ বিদ্যালয় পাস করেন। তখন তিনি স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় লেখাপড়ার খরচ বহন করা যায় নি; তাই তিনি গ্রামে ফিরে গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি একদিকে ক্ষেতে কৃষিকাজ করতেন, অন্যদিকে কৃষকদের চিকিত্সা সেবা দিতেন। ২০১১ সালে গ্রামে স্বাস্থ্যকক্ষ তৈরি হওয়ার পর তিনি বড় বড় হাসপাতালের চিকিত্সকদের মতো অফিসে বসে সবাইকে চিকিত্সা সেবা দেওয়ার সুযোগ পান।
৪০ বছর দীর্ঘ সময়। এ দীর্ঘ সময়ে ম্যাটইমু গ্রামের উন্নয়ন স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি বলেন, এখন তাঁর অবসর নেওয়ার সময় হয়েছে। গ্রামে আরও বড় বড় পরিবর্তন হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখন কৃষকরা অসুস্থ হলে সহজে চিকিত্সা সেবা পান। অতীতে, যখন ম্যাটইমু গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন, তখন তিনি একদিকে কৃষকদের টিকা দিতেন, অন্যদিকে কৃষক হিসেবে নিজের ক্ষেতে কাজ করতেন। তখন সিনচিয়াং-এর গ্রামে স্বাস্থ্যকক্ষ ছিল না, ডাক্তারও ছিল না। কৃষকরা অসুস্থ হলে, কষ্ট সহ্য করতে পারলে সহ্য করত; যদি সহ্য করতে না পারত, তাহলে হাসপাতালে যেত। সবার স্বাস্থ্যচেতনা ছিল না। দূষিত পানি ও খাবার খেত। এসব কারণে কৃষকের স্বাস্থ্য খারাপ থাকত।
এখন গ্রামে ৬০ বর্গমিটারের স্বাস্থ্যকক্ষ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া আরও আছে টিকা গ্রহণের কক্ষ, পর্যবেক্ষণের কক্ষ, ওষুধের কক্ষ এবং ডাক্তারের কক্ষ। বিভিন্ন যন্ত্র ও সরঞ্জামও আছে, যেমন রেফ্রিজারেটর, রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র, তাপ মাপার যন্ত্র, চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ চিকিত্সার যন্ত্র ইত্যাদি। কৃষকরা অসুস্থ হলে অনেক দূরের হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হয় না এবং কষ্ট করে রোগ সহ্য করতেও হয় না।
আরও খুশির ব্যাপার হলে, ২০১৮ সাল থেকে কৃষকরা বিনা খরচে শারীরিক পরীক্ষা করতে পারছেন। গ্রামীণ হাসপাতালে পরীক্ষার পর, যার রোগ আছে, তাকে হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিত্সা দেওয়া হয়। চিকিত্সক ম্যাটইমু বলেন, এখন প্রতিদিন ১০/১৫জন আমার কক্ষে এসে ওষুধ নেন, শহর ও গ্রামাঞ্চলের চিকিত্সা বীমা থাকায় ওষুধ নিতে এবং চিকিত্সা সেবা নিতে নিজেকে খরচ করতে হয় না।
ম্যাটইমুর চোখে গ্রামের আরেকটি পরিবর্তন হলো, কৃষকদের থাকা-খাওয়া ও জীবনযাত্রায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে। তিনি আগে থেকেই গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি বেতন পেতেন। তা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে তাঁকে খাবার হিসেবে শুধু ভুট্টাই খেতে হতো। উত্সবের সময় ময়দা ও খাশির মাংশ খেতে পারতেন। সবাই মাটির তৈরি বাড়িতে থাকতেন। ম্যাটইমু বলেন, এখন আপনি দেখুন, সবার জীবন একেবারে বদলে গেছে। সবাই আধুনিক স্টাইলের খুব সুন্দর পোশাক পরছে এবং অনেকে গাড়িও কিনেছে।
চিকিত্সা কক্ষের কাছেই রয়েছে গ্রামের রাত্রিকালীন বাজার। এখন সবার আয় বেড়েছে, তাই গ্রীষ্মকালে অনেকেই বাইরে এসে রাতের বেলা বাজার থেকে কিছু কিনে খেতে পছন্দ করে।
ম্যাটইমুর চোখে আরেকটি পরিবর্তন হলো, কৃষকদের চিন্তাধারার দ্রুত পরিবর্তন। ম্যাটইমু কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন নি। তবে তাঁর দুই ছেলেমেয়ে বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে; তাঁর মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে এখন বিশেষ শিক্ষা সংস্থায় কাজ করছে। আর তাঁর ছেলে এখন সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। স্নাতক পাস করে তাঁর ছেলে শাংহাই শহরে চাকরি খুঁজতে চায়। এমন কাজ আগে ম্যাটইমু কল্পনাও করতে পারতেন না।
সারা জীবন গ্রামের মানুষের চিকিত্সা সেবা দেওয়ায় সবাই ম্যাটইমুকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। আর তার নিজের সন্তানরা এখন প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় ম্যাটইমু অনেক গর্ব বোধ করেন। তিনি বলেন, আগে, গ্রামে অনেক শিশু স্কুলে যেতে পারত না, কারণ সবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না; লেখাপড়ার ফি বহন করতে পারত না তারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন অবস্থা আর দেখা যায় না।
ম্যাটইমু বলেন, সিনচিয়াং-এর গ্রামে আগে স্কুল থেকে অল্প বয়সে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এখন সিনচিয়াং-এর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। সরকার বিনা খরচে শিশুদের শিক্ষা দেয়। কৃষকরা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে যে, শিশুরা স্কুলে যাবে কি যাবে-না, তা অভিভাবকের সিদ্ধান্ত নয়; শিশুদের অবশ্যই স্কুলে যেতে হবে, লেখাপড়া করতে হবে। জ্ঞান অর্জন করলে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে।
নিজের ছেলে ভবিষ্যতে শাংহাইয়ে চাকরি করতে চায়। ম্যাটইমু বলেন, তিনি নিশ্চয় ছেলেকে অনেক মিস করবেন। তবে তিনি মনে করেন, এখন আধুনিক প্রযুক্তি আছে, তিনি ভিডিওর মাধ্যমে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তিনি ছেলের নিজের ইচ্ছাকে সম্মান করেন, যত দূরে যেতে চায়, তত দূরে যেতে পারো, সমস্যা নেই। ম্যাটইমুর ছেলের মতো, গ্রামের অনেক তরুণ-যুবক অন্য শহরে গিয়ে চাকরি করে। তাদের বাবা-মাও ছেলেমেয়েদের চিন্তাকে সমর্থন করেন।
আগে সিনচিয়াং-এর কিছু কিছু এলাকার সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ ছিল খুব কম। তবে এখন স্কুলে লেখাপড়া করা ও বাইরে চাকরি করা মানুষের সংখ্যা আরও বেড়েছে। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বেশি থাকায় কৃষি নির্ভর গ্রামটি আরও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে।