গত সপ্তাহে চীনের নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পরিদর্শন করেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তিনি স্থানীয় গ্রাম, কমিউনিটি, বন্যা প্রতিরোধক প্রকল্প ও কৃষির শৈল্পিক বাগানসহ নানা স্থানের খোঁজখবর নেন। সে সময় তিনি কোভিড-১৯ প্রতিরোধকাজের স্বাভাবিকতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম বেগবান, দারিদ্র্যবিমোচনের সাফল্য সুসংহতকরণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জাতিগত ঐক্য জোরদারসহ নানা বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন।
উ চুং শহরের হোং সি পাও উপজেলার হোং তে গ্রাম পরিদর্শন করেন তিনি। হোং তে গ্রামে বর্তমানে ১৬৯৯টি পরিবারের ৭০১৩ সদস্য বাস করছেন। এ গ্রাম গত বছর সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়। হোং তে গ্রামে সি চিন পিং গ্রামবাসী লিউ খ্য রুই'র পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলেন। ৪৭ বছর বয়সী লিউ খ্য রুই ৫ বছর আগে গাড়ি-দুর্ঘটনায় ডান পা হারান। তার পুরো পরিবার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। ২০১৭ সালে তার পরিবার দারিদ্র্যমুক্ত হয়। সি চিন পিং লিউ খ্য রুই দম্পতির খোজঁখবর নেন। তিনি বলেন, এ গ্রামের সকল বাসিন্দা নিজেদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে আরও সুন্দর জীবন গড়ে তুলবে বলে তিনি আশা করেন।
পরে সি চিন পিং ইয়েলো রিভারের উ চুং শহরের অংশ পরিদর্শন করেন। নিং সিয়াংয়ের ইয়োলো নদীর অংশ পুরো নদীর ১৪ ভাগের এক ভাগ। এর দৈর্ঘ্য ৩৯৭ কিলোমিটার। ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার এখানে মানসম্পন্ন বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করে। বর্তমানে ১৪.২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও মানসম্পন্ন বাঁধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাসে কান সু প্রদেশে ইয়োলো রিভারের লান চৌ অংশ পরিদর্শনের পর সি বলেছিলেন, ইয়োলো রিভার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানসম্পন্ন উন্নয়ন সাধনের জন্য সমন্বিতভাবে ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন। এবার সন্ধ্যার সময় তিনি চিন সিং উপজেলার চিন হুয়া ইউয়ান কমিউনিটি পরিদর্শন করেন। এখানে হুই, মান, মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতিসহ নানান জাতির মানুষের বাস। এ কমিউনিটি 'জাতীয় ঐক্য ও অগ্রগতির দৃষ্টান্ত' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ কমিউনিটিতে ৭০ বছর বয়সী ওয়াং লান হুয়া নামক একজন মহিলা অবসরের পর "লান হুয়া সেচ্ছাসেবকের বাড়ি" প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থার মাধ্যমে জনগণের মতভেদ দূর করার পাশাপাশি বৃদ্ধবৃদ্ধাদের যত্ন নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তার সঙ্গে কথাবার্তার সময় বলেন, "সমাজতন্ত্র সবার চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেচ্ছাসেবকদের উচিত নিজেদের ভূমিকা পালন করা। আপনাদের চেষ্টা ও অবদানের জন্য ধন্যবাদ!"
গত কয়েক বছরে তিনি বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাপনের উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগও দিয়েছেন। চীনের নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ৫টি সংখ্যালঘু জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অন্যতম। এখানে হান, হুই, উইগুর, তুংসিয়াং, কাজাখ, সালা ও পাওআনসহ বিভিন্ন জাতির লোকের বাস। স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাপনের ব্যাপারে ব্যাপক মনোযোগ দেন প্রেসিডেন্ট সি।
এবার নিংসিয়া পরিদর্শনকালে সি জোর দিয়ে বলেন যে, বিভিন্ন জাতির লোকেরা যেন একটি বড় পরিবারের সদস্য; দারিদ্র্যবিমোচন, সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলা ও আধুনিকায়নে কোনো জাতি পেছনে থাকতে পারে না। তাই বিভিন্ন জাতির লোকদের হাতে হাত মিলিয়ে সচ্ছল সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যা চীনা জাতির শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য আর চীনের বৈশিষ্ট্যময় সামাজিক ব্যবস্থার প্রাধান্যের প্রতিফলন হবে।
প্রেসিডেন্ট সি'র একটি কথা ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রচলিত। আর তা হল: বিভিন্ন জাতির লোকেরা যেন ডালিমের বীজের মতো ঘনিষ্ঠ ও ঐক্যবদ্ধ। সংখ্যালঘু জাতির অধ্যুষিত এলাকায় পরিদর্শন ও গবেষণাকালে সি সবসময় এ কথা বলেন। ডালিমের প্রসঙ্গে সিনচিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চরের উল্লেখ করতে হবে। গত শতাব্দীর ৫০ দশকে সিনচিয়াংয়ের একজন কুরবান নামক চাচা গাঁধায় বসে বেইজিংয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান মান সে তুংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এ গল্প ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। তা থেকে বোঝা যায় প্রাচীন কাল থেকেই চীনের বিভিন্ন জাতি ঐক্যবদ্ধ। ছোটবেলা থেকে কুরবান চাচা'র গল্প শুনেছেন প্রেসিডেন্ট সি। তাই ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি কুরবান চাচা'র বংশধরকে চিঠি লেখেন। তাতে বলা হয়: কুরবান চাচা'র মতো স্থানীয় গ্রামবাসীরা অন্যান্য জাতির লোকদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে সহাবস্থান করে, ডালিমের বীজের মতো ঘনিষ্ঠভাবে থাকে। একই বছরের দুই অধিবেশনে যখন সিনচিয়াং প্রতিনিধি দলের পর্যালোচনায় অংশ নেন, তখন সি আরেকবার জাতীয় ঐক্যের কথা উল্লেখ্য করেন এবং ডালিমের উদাহরণ দেন।
তিনি বারবার ডালিমের বীজের কথা জোর দিয়ে বলেন, কারণ এ উদাহরণ চীনা জাতির অভিন্ন চেতনা, চীনা জাতির সহনশীল উন্নয়ন আর অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটির চিন্তাধারার প্রতীক। চীনে বহু জাতির সহাবস্থান হচ্ছে একটি ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার, যা চীনের উন্নয়নের বড় প্রাধান্য।
ওয়া জাতির সুখী জীবন
বিভিন্ন জাতির লোকদের সুখী জীবন প্রেসিডেন্ট সি'র কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রতি উত্সবের সময় তিনি সংখ্যালঘু জাতির বাসিন্দাদের জীবনের খোঁজখবর নেন এবং নিয়মিতভাবে ভিন্ন জাতির রীতিনীতি অনুসারে তাঁদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যখন ইয়ুননান প্রদেশের থেংছুং শহরের ছিংশুই জেলার সিমোলা গ্রাম পরিদর্শন করেন, তখন তিনি বলেন, সবার যৌথ প্রয়াসে এখানকার দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং নতুন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ওয়া জাতির ভাষায় সিমোলার অর্থ সুখী জায়গা। সি হাসিমুখে গ্রামবাসীদের বলেন, সার্বিক সচ্ছল সমাজ গড়ে তুলতে গ্রামাঞ্চলের পুনরুত্থান বাস্তবায়ন করতে হবে। ওয়া জাতির বাসিন্দাদের জীবন আরও সুখী হবে বলে কামনা করেন সি। স্থানীয় রীতিনীতি অনুসারে তিনি কাঠের ড্রাম বাজান এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের সুখী জীবন কামনা করেন।
ইনার মঙ্গোলিয়ায় সি'র ভ্রমণ
২০১৪ সালের বসন্ত উত্সবের আগে ইনার মঙ্গোলিয়ায় পরিদর্শন করেন প্রেসিডেন্ট সি। তিনি সিলিনহোট শহরের এক জেলায় স্থানীয় নাদাম উত্সবে অংশ নেন; স্থানীয় পশুপালকদের সাথে দঙ্গল ও ঘোড়া চড়া প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন এবং মঙ্গোলিয়ান জাতির সুর ও নৃত্য দেখেন। তখন সি মঙ্গোলিয়ান জাতির রীতিনীতি অনুসারে রুপার বাটিতে দুধ দিয়ে শুভকামনা জানান। মঙ্গোলিয়ান জাতির নৃত্য ও সংগীত শুনে ও দেখে অনেক মুগ্ধ হন সি। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির সভ্যতা জাতির আত্মার প্রতিফলন। তাই ভিন্ন জাতির রীতিনীতি মিশে চীনা সভ্যতা অনেক সমৃদ্ধ ও চমত্কার হয়েছে।
হুনান প্রদেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির লোকদের সাথে দেখা
২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে পাহাড় অতিক্রম করে হুনান সিয়াংসি অঙ্গরাজ্যের সংখ্যালঘু জাতির লোকদের সাথে দেখা করেন সি। স্থানীয় মিয়াও জাতির এক গ্রাম চরম দরিদ্র গ্রামের অন্যতম। তাদের জীবন দেখে সি বলেন, 'আমি সবার জীবনযাপনের অবস্থা দেখতে চাই। এখানকার দরিদ্র লোকদের জীবন উন্নত হলে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।'
২০১৯ সাল পর্যন্ত চীনের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির দারিদ্র্যমুক্তির অনেক সুখবর পাওয়া গেছে। গত ৭ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির অধ্যুষিত এলাকায় ২.৫ কোটিরও বেশি লোক দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং দারিদ্র্য ২১ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
সংখ্যালঘু জাতির লোকদের আর্থিক অবস্থা মনোযোগ দেওয়ার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বিষয় সংরক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেন সি। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে যখন দুই অধিবেশন চলছিল, তখন সংখ্যালঘু জাতির প্রতিনিধি ও সদস্যদের সাথে দেখা করে সি জিজ্ঞেস করেন: এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে কোন কোন সংখ্যালঘু জাতির ভাষা দেখা যায়? পরে ভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ওয়েবসাইটও চালু হয়।
চীনা প্রেসিডেন্ট সি'র দৃষ্টিতে সংখ্যালঘু জাতির সংস্কৃতি ও ভাষার সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া চীনা সভ্যতা সংরক্ষণের কার্যকর পদক্ষেপ। বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির সুষম সংমিশ্রণ ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য চীনা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ বিষয়। তাই সঠিক চিন্তাধারায় সংখ্যালঘু জাতির সংস্কৃতি রক্ষা করা চীনা জাতির আত্মবিশ্বাস গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য রয়েছে।
সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn
তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)