বিদ্যাবার্তা ০৬০৮
  2020-06-08 18:03:00  cri

 


চীনের চরম দরিদ্র এলাকার দারিদ্র্যমুক্তির গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত

চীনের ইয়ুননান প্রদেশের নুচিয়াং গিরিখাতের বাসিন্দা ম্যাডাম মি চেন হুয়া প্রথমবারের মতো বর্ষাকালকে ভয় পাবেন না, কারণ ভিন্ন স্থানে নতুন বাড়িতে স্থানান্তর প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁর পরিবার পুরোপুরি আবাসিক সংকট থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন চীনের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে ঠিক একই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। চরম দরিদ্র এলাকার দারিদ্র্যমুক্তির জন্য সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার ফল এটি।

প্রতিবছরের জুন মাসে নুচিয়াং নদীর গিরিখাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সদ্য দারিদ্র্যমুক্ত মি চেন হুয়া কারখানায় চমত্কার হাতের কাজ করেন। নুচিয়াং গিরিখাতের প্রাকৃতিক দৃশ্য দারুণ সুন্দর; গিরিখাতের দুই তীরে মেঘ ও কুয়াশার ছায়ায় পর্বতের দৃশ্য যেন স্বর্গের মতো। তবে আশেপাশের বাসিন্দাদের জন্য এখানে টিকে থাকা অনেক কষ্টের ব্যাপার। কারণ, বর্ষাকালে যখন বৃষ্টিপাত হয়, তখন পাহাড়িদের জন্য তা বয়ে আনে বিপদ।

মি চেন হুয়া'র বাড়ি নুচিয়াং লিসু জাতির অধ্যুষিত এলাকার লুসুই শহরের জিচি গ্রামে। ২০১৫ সালে তিনি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামবাসীরা পাহাড়ের রাস্তায় ৬,৭ ঘন্টার হাঁটাপথ অতিক্রম করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আরেক বছরের বর্ষকালে রাতের সময় শব্দ শুনে তিনি জেগে ওঠেন। পিতামাতা ও মেয়েকে নিয়ে বাড়ির বাইরে দৌঁড়ে বের হয়ে যান। তিনি দেখতে পান পাহাড় থেকে বড় পাথর গড়িয়ে পরেছে তাদের কাঠের বাড়ির ওপর। বিধ্বস্ত হয়েছে বলতে গেলে গোটা বাড়ি। এ স্মৃতি স্মরণ করে ম্যাডাম মি অনেক কষ্ট পান। কিন্তু সেই কঠিন সময় এখন আর নেই। স্থানীয় সরকারের সহায়তায় তার মতো প্রায় এক লাখ গ্রামবাসী পাহাড় থেকে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তাদের বাড়িঘরের আশেপাশেই হাসপাতাল, স্কুল ও কারখানা নির্মিত হয়েছে। এতে তাদের জীবনমান হয়েছে উন্নত।

২০১৯ সালের শুরুতে মি চেন হুয়া নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হন এবং কারখানায় চাকরি পান। তার মাসিক বেতন ২০০০ ইউয়ান।

আসলে এমন দৃশ্য চীনের বিভিন্ন চরম দরিদ্র এলাকায় দেখা যায়। যেমন, সিছুয়ান প্রদেশের তালিয়াংশান ই জাতির ক্লিফ গ্রামের বাসিন্দারা পাহাড় থেকে নেমে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছে; ছিংহাই প্রদেশের থু জাতির বানইয়ান গ্রামের গ্রামবাসীরা এবং তিব্বতের বাইলাং জেলার দরিদ্র পরিবারের গ্রামবাসীরা শাকসবজি চাষ করে বার্ষিক আয় ৩০ হাজার ইউয়ানে উন্নীত করেছে।

চীনের তিনটি এলাকা ও তিনটি অঙ্গরাজ্য চরম দরিদ্র। তিনটি এলাকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তিব্বত, সিনচিয়াংয়ের হ্য থিয়ান,আকসু,কাশি,ছিংহাই প্রদেশ, কানসু প্রদেশ, সিছুয়ান প্রদেশ ও ইয়ুননান প্রদেশের তিব্বতী অধ্যুষিত এলাকা। তিনটি অঙ্গরাজ্য রয়েছে কানসু প্রদেশের লিনসিয়া, সিছুয়ান প্রদেশের লিয়াংশান এবং ইয়ুননান প্রদেশের নুচিয়াং।

এসব স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ কঠোর; আছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। প্রাচীনকাল থেকে চরম দরিদ্র অবস্থায় পড়ে আছে এসব এলাকার মানুষ। চীনের দারিদ্র্যমুক্তি কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল এসব অঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত করা। গত ৩ বছর ধরে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এসব অঞ্চলের দারিদ্র্যবিমোচন কাজের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। ২০১৭ সালে শানসি প্রদেশের থাইইউয়ান শহর চরম দরিদ্র্য এলাকার দারিদ্র্যমুক্ত কার্যক্রম পেশ করা হয়। ২০১৮ সালে 'ছেংতু শহরে আকাশ থাকলে মাটি নেই, পাহাড় থাকলে কৃষিক্ষেত নেই, মানুষ থাকলে রাস্তা নেই'—এমন কথার মাধ্যমে সে অঞ্চলের দারিদ্র্যের কঠিনতা বর্ণনা করেন সি। ২০১৯ সালে এতদঞ্চলে আরও ১৭ লাখ ২০ হাজার দরিদ্র মানুষ রয়েছে বলে সতর্ক করে দেন সি। ২০২০ সালে বেইজিংয়ে চরম দরিদ্র এলাকাগুলোকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করতে নির্দেশনা দেন সি চিন পিং।

আসলে ২০১৮ সাল থেকেই 'তিনটি এলাকা, তিনটি অঙ্গরাজ্য' দারিদ্র্যমুক্তির ৩ বছর মেয়াদী কার্যক্রম গ্রহণ করে চীন সরকার। এতে বিভিন্ন বিস্তারিত পদক্ষেপ ও সময়সূচী বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ এতদঞ্চলের দরিদ্র লোকসংখ্যা ২০১৭ সালের ৩০ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪.৩ লাখে নেমে আসে। অন্যভাবে বললে, দারিদ্র্যের হার ১৪.৬ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নেমে আসে।

এ সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংকের দারিদ্র্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চাই সি মান বলেন, দারিদ্র্যমুক্তি কার্যক্রমে সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে চীন সরকার।

চরম দরিদ্র এলাকার দারিদ্রমুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ

চীনের কানসু প্রদেশের লিনসিয়া হুই জাতির অধ্যুষিত এলাকার তুংসিয়াং উপজেলার গ্রামবাসী মাসাইলিমু সম্প্রতি ৫টি ছাগল বিক্রি করেন এবং মোট ৬০০০ ইউয়ান পান। এখন তার খামারে ৩০টি ছাগল রয়েছে, যা এক সময় তার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। মাসাইলিমুর পরিবার ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি ও হুয়াংথু মালভূমির মাঝখানে বাস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ২১০০ মিটার। তাই প্রতিদিন পাহাড় থেকে নেমে পানি আনতে হতো তাদের। পানি পরিবহনেই প্রতিপরিবারের একজন পুরুষের সারাদিন চলে যেত। পানি আনার জন্য গাঁধার ব্যবহার হলেও, প্রতিবার যাওয়া-আসায় অন্তত ২ ঘন্টা লাগতো। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। খাবারপানির ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় সরকার। এখন নতুন বাড়িতে পানির সমস্যা নেই।

২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট সি ইয়ুননান প্রদেশের কুংশান জেলার গ্রামবাসীদের চিঠির উত্তরে লেখেন, 'তুলুং জাতির দারিদ্র্যমুক্তিতে অভিনন্দন জানাই। দারিদ্র্যবিমোচন শুধু প্রথম পদক্ষেপ, পরের জীবন আরও সুন্দর হবে।'

আসলে বিভিন্ন দরিদ্র এলাকা থেকে সুখবর আসছে অব্যাহতভাবে। দারিদ্র্য এতদঞ্চলের গ্রামবাসীদের জীবনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সিছুয়ান প্রদেশের চাওচ্যুয়ে জেলার সানহ্য গ্রামের গ্রামবাসী জিহাওকে বড় মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে হয়। দারিদ্র্যের কারণে। আগে চীনের চরম দরিদ্র এলাকায় এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটতে দেখা যেত।

তবে বর্তমানে যুবকদের জীবনযাপনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। মেয়েও নিজের সুখী জীবন বাছাইয়ের অধিকার পেয়েছে। পিতা জিহাও বলেন, বাচ্চারা ভালোভাবে পড়াশোনা করেছে; তাদের নিজ নিজ প্রিয় কাজ করার অধিকার রয়েছে। গত বছর জিহাও'র পরিবার নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। পুরাতন ২০ বর্গমিটারের বাড়ি থেকে তারা ১০০ বর্গমিটারের বাড়িতে গেছেন। বাড়িতে রান্নাঘর ও টয়লেট রয়েছে। ব্যবসা আর পশুপালনের মাধ্যমে পরিবারের বার্ষিক আয়ও ১০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি হয়েছে।

অতীতে গ্রামের রাস্তা ছির সম্পূর্ণ মাটির। তবে বর্তমানে রাস্তা অনেক উন্নত হয়েছে। গ্রামে দরিদ্রদের জন্য ৯টি সহকারী আবাসিক এলাকাও গড়ে উঠেছে। দরিদ্র পরিবারের লোকেরা সবাই নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

অবশ্য চলতি বছর কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে দারিদ্র্যমুক্তির কাজ ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। তবে, কঠিন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখেও চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়নি। লক্ষ্য অর্জনে অতিরিক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। হতদরিদ্র 'তিনটি এলাকা ও তিনটি অঙ্গরাজ্যে'-র জন্য মোট ১৩৯৬০ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ দেওয়া হয়েচে। এদিকে, বিশেষ মুহূর্তেও মানুষের জীবনমানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া ও মানুষকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন বাস্তবায়ন করার ধারণায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। সবার যৌথ প্রয়াসে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশা করা যায়।

সুপ্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা অনুষ্ঠানের সময় শেষ হয়ে এলো। সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারেন বা মিস করেন, আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn,আমাদের যোগাযোগ ইমেল ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী সপ্তাহে একই সময় একই দিনে আবার কথা হবে। যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040