চলতি বছর, ২০২০, চীনে সার্বিকভাবে সচ্ছল সমাজ গড়ে তোলা হবে। অন্যভাবে বললে দেশকে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এটা শেষ বছর। এ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কীভাবে কঠোর এ যুদ্ধে জয় লাভ করা যায় ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা যায়? বেইজিংয়ে বর্তমানে চলমান দুই অধিবেশনের প্রতিনিধি ও সদস্যরা এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রস্তাব পেশ করেছেন। তারা মনে করেন, এখন আস্থাবান হয়ে বাস্তব কাজ করা প্রয়োজন।
দুই অধিবেশন উদ্বোধনের প্রাক্কালে, সি ছুয়ান প্রদেশের লিয়াং শান অঞ্চলের আধুলিয়েএ গ্রামের সকল বাসিন্দাকে চাওচুয়ে জেলায় স্থানান্তর করা হয়। তাদের গ্রামকে ডাকা হয় 'ক্লিফ গ্রাম'। পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এ গ্রাম। বাইরে যেতে ব্যবহার করতে হয় পাহাড়ে ঝুলানো একটি খাড়া সিঁড়ি। আর কোনো বিকল্প উপায় নেই। তবে, নতুন বাড়িতে নতুন জীবন শুরু করে গ্রামবাসীরা খুবই আনন্দিত। একজন গ্রামবাসিন্দা বলেন, 'আমরা কষ্টকর জীবনকে বিদায় জানিয়েছি। আমার বাচ্চার আর পাহাড়ে উঠার দরকার নেই। আমার বাবা বলেন, নতুন বাড়িঘর যেন স্বর্ণ ও রূপার বাড়ির মতো সুন্দর।'
সি ছুয়ান প্রদেশে স্থানাস্তরের মাধ্যমে বৃহত্তম দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প চাও চুয়ে জেলায় পুনর্বাসনস্থলে দরিদ্র পরিবার ৩৯১৪টি এবং মোট লোকসংখ্যা ১৮০০০ জন। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে, চীনের ৯৫ লাখ মানুষ ক্লিফ গ্রামের বাসিন্দাদের মতো স্থানান্তরের মাধ্যমে কঠোর প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মুক্তি পান এবং দারিদ্র্যমুক্ত হন।
যারা নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছেন তাদেরকে অর্থ উপার্জনের পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া প্রয়োজন। কুই চৌ প্রদেশের এনপিসি প্রতিনিধি সি লি পিং, যিনি মিয়াও জাতির ঐতিহ্যিক সূচিকর্ম কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তার কোম্পানি মানুষদেরকে সূচিকর্ম শিখিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দারিদ্রমুক্ত হতে সাহায্য করে। তিনি বলেন,
'আমি পুনর্বাসনস্থলে ১০০টি ছোট কারখানা স্থাপন করেছি। এখানে স্থানীয় নারীদেরকে সূচিকর্ম শিখিয়ে দেওয়া হয়। গেল বছর এ প্রকল্পে আমরা মোট ৬ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করেছি এবং স্থানীয় ৪০০০টি পরিবারের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি। এখন কুই চৌতে ৫ লাখের বেশি নারী এ প্রযুক্তি শিখে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন।'
সিপিপিসিসির সদস্য, চীনা শ্রম ও সামাজিক নিশ্চয়তা গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর উপ-পরিচালক মো রং মনে করেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি দারিদ্র্যবিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তিনি বলেন,
'আমাদের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম আগের চেয়ে আরও উন্নত হয়েছে। আগে আমরা অনেকটা 'রক্তদান' পদ্ধতির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ করতাম। যেমন, দরিদ্র মানুষকে টাকা ও প্রয়োজনীয় জিনিস দান করা। এবার আমার মতে কর্মসংস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতি দশ জনের মধ্যে ৬-৭ জন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। একটি পরিবারে অন্তত একজন কাজ পেলে সে পরিবারটি দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারে।'
গ্রামীণ অঞ্চল সবসময় দারিদ্র্যবিমোচনের একটি মূল যুদ্ধক্ষেত্র। চলতি বছরের সরকারি কার্যবিবরণীতে বলা হয়, দারিদ্র্যবিমোচন ও গ্রাম পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে, গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে, এবং কৃষকদের জীবনমান উন্নত করা হবে। এনপিসির প্রতিনিধি, আন হুই প্রদেশের কৃষি বিজ্ঞান একাডেমির উপ-পরিচালক চাও ওয়ান পিং বলেন,
'চীনের কৃষিপণ্য বিভিন্ন গ্রামে উত্পাদন করা হয়। কৃষকের জন্য, বিশেষ করে দরিদ্র অঞ্চলের কৃষকের জন্য নিজেদের জন্য বাজার তৈরি করা অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে ই-কমার্সসহ ইন্টারনেট প্লাটফর্ম ভূমিকা পালন করতে পারে। দরিদ্র অঞ্চলের কৃষিপণ্য আধুনিক লজিস্টিক, মার্কেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এভাবে কৃষিপণ্য কৃষকদের আয়ের উত্সে পরিণত হয়।'
সংস্কৃতির মাধ্যমে দারিদ্রবিমোচনও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সিপিপিসিসির সদস্য, সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত এলাকার অপেরা থিয়েটারের অভিনেতা সিগেইটি ২০১৮ সাল থেকে সিনচিয়াংয়ের আকসু অঞ্চলের সুইয়াইদি গ্রামে কাজ করছেন। তার উদ্যোগে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি কৃষক সাংস্কৃতিক দল। এ দলে ২০ জনের বেশি গ্রামবাসিন্দা অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, দারিদ্র্যবিমোচনে সংস্কৃতিও ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন,
'গ্রামে আমি আলিমকাং নামের একজন যুবকের সঙ্গে পরিচিত হই। উনি ছুতার কাজ করতে পারেন এবং লম্বা ও সুদর্শন। আমি তাকে সাংস্কৃতিক দলে নিয়োগ করি। দলটিকে আমি উরুমুছির একটি সাংস্কৃতিক স্কুলে পাঠাই। ওখানে তারা এক মাস বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নেয়। ফিরে আসার পর দেখা গেল সবাই খুব ভাল গান ও নাচ করতে পারে। বিশেষ করে আলিমকাং। তার স্ত্রী আমাকে বলেন, এখন আলিমকাং নতুন একজন মানুষ। স্ত্রীকে গৃহকাজে সাহায্য করে, বাচ্চার যত্ন নেয়। তিনি ছুতারের কাজও পান। তার স্ত্রী একটি দর্জির দোকান খুলে বসেন। তাদের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে।'
গেল ৭ বছরে, বিভিন্ন পক্ষের প্রচেষ্টায় চীনের বর্তমান মানদন্ড অনুযায়ী, গ্রামে চীনের দরিদ্র লোকসংখ্যা ২০১২ সালের ৯৮৯৯০ হাজার থেকে ২০১৯ সালের ৫৫১০ হাজারে নেমে আসে। দরিদ্রের হার ১০.২ শতাংশ থেকে ০.৬ শতাংশে কমে যায়। দরিদ্র জেলার সংখ্যা ৮৩২টি থেকে ৫২টিতে নেমে আসে। এর ফলে সময়মতো চীনে দেশব্যাপী দারিদ্র্যমুক্তির ভিত্তি তৈরি করে।
সিপিপিসিসির সদস্য কং চুয়ে ছু চেন, তিব্বতের শান নান শহরের চারি উপজেলার প্রধান। চারি উপজেলা গেল বছরে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। তিনি বলেন,
'তিন বছরের কঠোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের জেলা ২০১৮ সালের শেষ দিকে দারিদ্র্যমুক্ত হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে, তিব্বত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলাকে দারিদ্র্যমুক্ত ঘোষণা করে। এখন পরিবারগুলোর গড় বার্ষিক আয় ১২১৫০ ইউয়ান। আমাদের গ্রামের মেয়েরা এখন বাঁশ বোনে এবং ছেলেরা পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি, অনেক মানুষ রান্না করে, কেউ চা বিক্রি করে, কেউ পারিবারিক হোটেলসহ নানান ব্যবসা করে।'
দারিদ্র্যমুক্ত হবার পর আবার কোনো কারণে দরিদ্র হয়ে পড়া ঠেকানোও গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছরের সরকারি কার্যবিবরণীতে বলা হয়, যারা আবার দরিদ্র হয়ে গেছে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণ এবং সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। এ প্রসঙ্গে সিপিপিসিসির সদস্য, কুই চৌ গণ রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের ভাইস চেয়ারম্যান ছাং কুয়াং ছি কোনো কোনো জায়গায় যৌথভাবে দারিদ্র্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন,
'কিছু প্রদেশে দারিদ্র্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে এবং ব্যবস্থার উদ্দেশ্য, কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে, যা চীনে সার্বিকভাবে এ ব্যবস্থা চালু হবার ভিত্তি তৈরি করবে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। যারা দারিদ্র্যমুক্ত হবে তাদের জীবনমান অ্যাহতভাবে উন্নত করার কাজও অব্যাহত রাখা হবে।'
বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, বিশ্বে দারিদ্র্যবিমোচনে চীনের অবদান অনস্বীকার্য। এনপিসি ও সিপিপিসিসির সদস্যরা মনে করেন, চীনের দারিদ্র্যবিমোচন কাজ কেবল দেশের দরিদ্র লোকের জীবন পরিবর্তন করছে, তা নয়; বরং বিশ্বের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। চীনের লক্ষ্যযুক্ত দারিদ্র্যবিমোচনের ধারণা ও অনুশীলন বিশ্বের দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য চীনা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে। (শিশির/আলিম/রুবি)