সার্স, দক্ষিণ চীনের হিমশীতল বিপর্যয়, ওয়েন ছুয়ান ভূমিকম্প ও ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চেয়ে এবার কোভিড-১৯ মহামারি পর্যটন শিল্পের ওপর আরও বড় আঘাত হেনেছে। পর্যটন শিল্পের পুনরুদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কঠোর প্রক্রিয়া হবে।
চাং চিয়া চিয়ে, চীনের হু নান প্রদেশের বিখ্যাত একটি দর্শনীয় স্থান। সিয়াও ইউয়ু চিয়াও এখানে গাইড হিসেবে কাজ করেন। তিনি সাংবাদিককে জানান, মহমারি হবার পর মে দিবস পর্যন্ত তিন মাসে তিনি ও তার স্বামীর মোট আয় ছিল মাত্র ১১ হাজার ইউয়ান। গেল বছরের একই সময়ে তারা প্রতি মাসে ২০ হাজার ইউয়ান উপার্জন করেছেন।
প্রতি বছরের বসন্তকালের শেষ ও গ্রীষ্মকালের শুরুর দিকে দক্ষিণ চীনে ভ্রমণের গোল্ডেন সময়। তবে সাংবাদিক দেখতে পান যে, চলতি বছরের মে দিবসের ছুটিতে দর্শনীয় স্থানে বেশি পর্যটক দেখা যায়নি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের লেবার দিবসের ছুটিতে দেশে মোট ১১.৫ কোটি পার্সন টাইমস ভ্রমণ হয়েছে এবং পর্যটন খাতের আয় হয়েছে ৪৭৫৬ কোটি ইউয়ান। গেল বছর এ ছিল যথাক্রমে ছিল ১৯.৫ কোটি পার্সন টাইমস এবং ১১৭৬৭ কোটি ইউয়ান।
ছাং চিয়া চিয়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্ববিখ্যাত একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে লেবার দিবস ছুটির সময়ে পর্যটকের সংখ্যা একটু বৃদ্ধি হলেও পর্যটকের সংখ্যা ও আয় গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ৪৫.৭৬ ও ৫৬.৯৭ শতাংশ কম হয়।
মহমারি সময়ের তুলনায় একটু বেড়েছে, তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। মহামারির আগে প্রতি বছরে ৬০ লাখের বেশি চীনা ও ১৩ লাখ বিদেশি পর্যটক চাংচিয়াচিয়ে ভ্রমণে আসতেন। তবে এখন দেশের পর্যটক কম এবং বিদেশি কোনো পর্যটক নেই।
এদিকে, পর্যটক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রদেশ-অতিক্রম যাতায়াত অসুবিধা এবং মহামারির সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে বাইরে যাবার ইচ্ছা কমসহ নানা কারণে দেশব্যাপী পর্যটন শিল্পের প্রায় একই অবস্থা।
কুয়াং সি প্রদেশের কুই লিনও একটি পর্যটন শহর। ছুটির সময় পর্যটকের সংখ্যা একটু বেড়েছে তবে অধিকাংশ মানুষ স্থানীয় বাসিন্দা এবং তারা নিজেদের গাড়ি চালিয়ে আসেন।
মধ্যচীনের একটি প্রদেশের সাংস্কৃতিক ও পর্যটন সম্পর্কে এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযাযী, সারা প্রদেশের ৪১৪টি দর্শনীয় স্থানে বসন্ত উত্সবের সময়ে আয় ও পর্যটকের সংখ্যা ৯০ শতাংশ হ্রাস পায়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পর্যটন শিল্পের মুনাফা ১২৪ শতাংশ কম।
কুয়াং চৌ চিন মা ট্রাভেল এজেন্সির সিইও জানান, একদিকে মহামারির কারণে পর্যটন কোম্পানির আয় কম হয়, অন্যদিকে দর্শনীয় স্থানের রক্ষা, মহামারি প্রতিরোধ এবং কর্মীর জন্য ব্যয় বাড়ে। কোনো আয় নেই, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে।
মহামারির কারণে বিদেশে ভ্রমণ ব্যবসার ওপরও বড় আঘাত এসেছে। চিয়াং সু প্রদেশের একটি আন্তর্জাতিক ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিবছর ১৯০ হাজার পর্যটকের জন্য বিদেশে ভ্রমণের সেবা সরবরাহ করে। তবে এবার তাদেরকে একদিকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশে হোটেল রিজার্ভেশন, বিমান টিকিটসহ ব্যয় পুনরুদ্ধার করতে পারছে না।
বসন্ত উত্সবে ছাংচিয়াং চিয়ের ৬৯৮৮টি গ্রুপের ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করে, যার আর্থিক মূল্য ১৫ কোটি ইউয়ানের বেশী। এর মধ্যে ব্যয়ের তিন ভাগের এক ভাগ ট্রাভেল এজেন্সিকে বহন করতে হয়।
দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকার সময় কর্মীদের বেতন দিতে হয়, পাশাপাশি দর্শনীয় স্থানের সংরক্ষণের খরচও বেশি। চাং১২ চিয়া চিয়ের উদাহরণ দিয়ে বললে, প্রতিদিন ক্যাবল কার বিদ্যুত খরচ ৩০-৪০ হাজার ইউয়ান। তার মানে প্রতিদিন অন্তত ৫০০০ পর্যটক আসলে কোম্পানির খরচ কভার হয়।
দর্শনীয় স্থান ছাড়া সংশ্লিষ্ট শিল্প যেমন হোটেল, ক্রুজ শিল্পও বড় আঘাত পেয়েছে। তৃণমূল কর্মীরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানি তাদের অর্ধেক দোকান বন্ধ করেছে এবং কর্মীদের প্রতিমাসে মাত্র ১০০০-২০০০ ইউয়ান করে মৌলিক বেতন দিচ্ছে। ১ মে-র ছুটিতে চাংচিয়াচিয়ের ৯৮০০ জন গাইড মাত্র ৮০০টি অর্ডার পায় এবং সারা শহরের ২০০টি ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে মাত্র অর্ধেক কাজ পুনরুদ্ধার করে। অনেক গাইড অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করে এবং মহামারির কারণে তারা চাকরি হারান।
কোম্পানির সংকট হচ্ছে আর্থিক সংকট। যেমন, একটি বেসরকারি কোম্পানি ৬০ কোটি ইউয়ান দিয়ে একটি বরফ ও তুষার দর্শনীয় স্থান তৈরি করে এবং উন্মুক্ত হবার মাত্র ১ মাস পরে মহামারি শুরু হয়। তুষার রাখার জন্য প্রতিদিন ৭০০০-৮০০০ ইউয়ান বিদ্যুত ফি দিতে হয়; পাশাপাশি ব্যাংককে সুদ দিতে হয়। এ কোম্পানি এখন কষ্টের মধ্যে পড়েছে।
পর্যটন শিল্পের মন্দাবস্থা স্থানীয় সরকারের ওপর প্রভাব ফেলেছে। কোনো কোনো জেলার জন্য পর্যটন তাদের প্রধান আয়ের উত্স। ২০১৯ সালে চীনের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি ছিল। চীনের প্রায় ২০টি প্রদেশের স্তম্ভ শিল্পের অন্যতম পর্যটন। কোনো কোনো শহরে অর্ধেক সরকারি অর্থ পর্যটন শিল্প থেকে আসে। বর্তমান এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার বড় চাপে পড়ে গেছে।
তা ছাড়া, সেখানে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, সেখানেও বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে।
দরিদ্র গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর হলেও এখন পর্যটক আসতে পারে না। ক্যাটারিং, পারিবারিক হোটেল, গাইডসহ নানা কাজে জড়িত মানুষের আয় কম। একজন দরিদ্র পরিবারের মানুষ সাংবাদিককে জানান, গত বছর তিনি দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন। তবে মহামারির কারণে এখন তিনি প্রতি মাসে মাত্র ৫০০ ইউয়ান আয় করতে পারছেন। আগে তার মাসিক বেতন ৪০০০ ইউয়ান ছিল। এখন গ্রাম কমিটির সাহায্যে তিনি পশুপালনের কাজ করেন। তিনি আশা করেন, দ্রুত পর্যটন শিল্প আগের অবস্থায় ফিরবে এবং তিনিও আগের মতো হোটেলে কাজ করতে পারবেন।
জানা গেছে হুনান, কুয়াং সি, কুয়াং তুং, ইউননানসহ নানা স্থানীয় সরকার পর্যটন শিল্প উদ্ধারে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন, পর্যটনবিষয়ক কোম্পানির জন্য কম সুদের ঋণ দেওয়া, ট্র্যাভেল এজেন্সির আমানত ফিরিয়ে দেওয়া, ভাড়া মওকুফ করা, ইত্যাদি। তবে পর্যটন মহলের ব্যক্তিরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার আগ পর্যন্ত দীর্ঘসময় ধরে পর্যটন শিল্প চাঙ্গা হবে না।
পর্যটন একটি সংবেদনশীল তবে অদম্য শিল্প। প্রাকৃতিক দৃশ্য কখনও বিলীন হবে না, তাই সুযোগ পেলে দ্রুত ঘুরেও দাঁড়াবে। এটাই আশার কথা। (শিশির/আলিম/রুবি)