এশিয়ার বাজারে নেটফ্লিক্স
  2020-05-19 16:49:30  cri

সদ্যসমাপ্ত শ্রম দিবসের ছুটিতে যারা বাসায় বসে বসে চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক দেখতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে এই ছুটি নিঃসন্দেহে মুভি বা নাটক উপভোগের ভালো সময় ছিলো।

বিশ্বের স্ট্রিমিং মিডিয়া জায়ান্ট হিসেবে নেটফ্লিক্স ১ মে'র কাছাকাছি সময় পর্যায়ক্রমে ' Extracurricular', 'The Victims' Game' এবং 'হলিউড'সহ প্রশংসনীয় ওরিজিনাল সহযোগিতায় নির্মিত টিভি নাটক মুক্তি দেয়।

নেটফ্লিক্সের ২০টিরও বেশি বছরব্যাপী বড় হওয়ার ইতিহাস হলো নামহীন ছোট এক চরিত্র ধীরে ধীরে সাহসের সঙ্গে বেঁচে থাকা এবং শক্তিশালী হওয়ার গল্প। ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সের চলচ্চিত্র শিল্প ২০২০ অস্কার পুরস্কারের ২৪টি পুরস্কার দিয়ে মনোনয়ন লাভ করে। নেটফ্লিক্স এই অত্যন্ত ভালো সাফল্য দিয়ে হলিউডের যে কোনো একটি চলচ্চিত্র, টিভি নাটক ও মিডিয়ার কোম্পানি ছাড়িয়ে যায়। শুধু তা নয়, নেটফ্লিক্স আনুষ্ঠানিকভাবে দ্য মোশন পিকচার অ্যাসোসিএশন অব আমেরিকা বা এমপিএএতে যোগ দেয় এবং এটি এমপিএএ'র প্রথম নন-ফিল্ম কোম্পানি আর স্ট্রিমিং মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।

দুই ময়দানে যুদ্ধ চলছে। একদিকে আছে বেশি বেশি অস্কার ট্রফি ঘরে নেওয়ার লড়াই। অন্যদিকে শুরু হয়ে গেছে স্ট্রিমিং ওয়ার। এই দুই তুমুল যুদ্ধের দুর্দান্ত যোদ্ধা নেটফ্লিক্স। প্রশ্ন হলো—দুই ময়দানেই কি জয়ের মালা গলায় নিতে পারবে নেটফ্লিক্স?

স্রেফ 'হ্যাঁ' বা 'না' দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ যে হচ্ছে সেয়ানে সেয়ানে! এক তুড়িতে নেটফ্লিক্সকে খারিজ করে দেওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি নেটফ্লিক্সের প্রতিপক্ষদের খাটো করে দেখাও ঠিক যুক্তিযুক্ত হবে না।

গতবারের অস্কার আসরেই সোনালি ট্রফির খরা ঘুচিয়েছে নেটফ্লিক্স। রোমা ছবির কল্যাণে গত আসরে একাধিক অস্কার ট্রফি নেটফ্লিক্স জিতেছে। তার জন্য অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এই অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠানকে। প্রথমে তো কেউ নেটফ্লিক্সকে অস্কারের পাতে তোলার যোগ্যই মনে করেনি। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মূল মঞ্চে গিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসা সহজ কাজ নয়। এবার সেই অগ্রগতি ধরে রেখে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পালা। সেই এগোনোটা কতটুকু সম্ভব হবে, শঙ্কা তা নিয়েই।

কারণ, নেটফ্লিক্সকে 'অচ্ছুত' মনে করা বিদগ্ধ বিচারকের সংখ্যা এখনো নেহাত কম নয়। সাম্প্রতিক গোল্ডেন গ্লোব, বাফটার মতো বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, ভূরি ভূরি মনোনয়ন পেলেও ট্রফি জেতার বেলায় পিছিয়ে পড়ছে নেটফ্লিক্স। উদাহরণ হিসেবে দ্য আইরিশম্যান-এর কথাই ধরা যাক। রবার্ট ডি নিরো ও আল পাচিনো—এই দুটি নামই ছবিটি দেখার জন্য যেকোনো দর্শককে প্রলুব্ধ করতে যথেষ্ট। এর সঙ্গে আবার পরিচালনায় যোগ হয়েছে মার্টিন স্করসেজির নাম। এরই মধ্যে সমালোচকদের কাছ থেকে তুমুল প্রশংসা পাওয়া চলচ্চিত্রটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডসে পাঁচটি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। কিন্তু শেষে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্সকে।

নেটফ্লিক্সের অবস্থা দাঁড়িয়েছে সেই বাংলা প্রবাদের মতো—'যত গর্জে তত বর্ষে না'। গত অস্কার আসরে ১০টি বিভাগে মনোনয়ন পেলেও ট্রফি জুটেছিল তিনটি। এবার সব রেকর্ড ভেঙে প্রথমবারের মতো কোনো ভিডিওস্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে নেটফ্লিক্স ২৪টি মনোনয়ন পেয়েছে। দ্য আইরিশম্যান, ম্যারেজ স্টোরিসহ অস্কারে মনোনয়ন পাওয়া নেটফ্লিক্সের সব সৃষ্টিই মানের দিক থেকে এগিয়ে। নিন্দুকেরা যেমন বলতেন যে নেটফ্লিক্সে ভালো মানের ছবি হয় না, সেটি এখন আর তেমন সমর্থনযোগ্য নয়। এর জন্য গত কয়েক বছরে শত শত কোটি ডলার খরচ করেছে নেটফ্লিক্স। দ্য আইরিশম্যান তৈরিতে যেমন খরচ হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি ডলার। শুধু কনটেন্ট তৈরিতে গত বছর প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল নেটফ্লিক্স। ব্যয়ের খাতে এ বছরের লক্ষ্য ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি। যুক্ত করা হচ্ছে আলফানসো কুয়ারন, মার্টিন স্করসেজি, স্টিভেন স্পিলবার্গের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের। নেটফ্লিক্সের ছবির মান নিয়ে নিন্দা-মন্দের সুযোগ তাই খুব একটা মিলছে না।

এই পৃথিবীতে সহজ অঙ্ক সহজে মেলে না। তাই শুধু ভালো মানের ছবি বানিয়েই বসে থাকেনি নেটফ্লিক্স। সেই ছবির প্রচারে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থও ঢেলেছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত আসরের অস্কারে জিততে প্রচারের জন্যই ৩ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করেছিল নেটফ্লিক্স। ১০টি মনোনয়নেই যদি এমন খরচ করা হয়, ২৪-এ তবে কী হবে? ভেবে দেখতে পারেন।

পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে চওড়া হাসি দিতে এত চেষ্টার পরও তাই শঙ্কা কাটছে না নেটফ্লিক্সের। কারণ, ভিডিওস্ট্রিমিংকে গোনায় না ধরা নিন্দুকের সংখ্যাও খুব কম নয়।

নেটফ্লিক্সের সামনে এবার এসেছে 'স্ট্রিমিং ওয়ার'। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে এসে গেছে ডিজনি প্লাস, হুলু, অ্যাপল টিভি প্লাসসহ আরও কত–কী! যদিও কেউই সরাসরি এমন অদৃশ্য যুদ্ধের অস্তিত্ব স্বীকার করছে না, কিন্তু হাবভাবে সবাই বেশ যুদ্ধংদেহী। নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে ভয়ংকর হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে ডিজনি প্লাস। কনটেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে ঢের অভিজ্ঞ ডিজনি। আছে থিম পার্ক, গণমাধ্যমসহ নানামাত্রিক ব্যবসা। কনটেন্টের ভান্ডারও বিপুল। ফলে ভিডিওস্ট্রিমিং চালানোর জন্য অর্থ ও কনটেন্টের অভাব নেই ডিজনির। সাবস্ক্রিপশন ফির দিক থেকেও নেটফ্লিক্সের তুলনায় গত নভেম্বরে বাজারে আসা ডিজনি প্লাস কিছুটা সস্তা। আবার আসামাত্রই গ্রাহক সংগ্রহের লড়াইয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে ডিজনি প্লাস। শুধু এক দিনেই এর গ্রাহক ছাড়িয়েছে ১ কোটি। অথচ গেল বছরের শেষ তিন মাস মিলিয়ে নেটফ্লিক্স মাত্র ৪ লাখ ২০ হাজার নতুন গ্রাহক পেয়েছে। মার্কিন মুলুকে নেটফ্লিক্সের প্রবৃদ্ধির গতিও বেশ কম। তাই, ডিজনি প্লাসকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতেই হচ্ছে নেটফ্লিক্সকে।

অবশ্য আন্তর্জাতিকভাবে নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। সর্বশেষ প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বাকি বিশ্বে প্রায় ৮৪ লাখ নতুন গ্রাহক পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় গ্রাহকের সংখ্যাবৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। এক হিসাবে দেখা গেছে, নেটফ্লিক্সের নতুন বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে। প্রতিষ্ঠানটিও তাই নিজের চেয়ে পরের ঘরের জানালায় উঁকি দিতেই বেশি আগ্রহী। এই নীতিতেই পুরো বিশ্বে ১৬ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক জুটিয়েছে নেটফ্লিক্স।

সদ্যই গত বছরের শেষ প্রান্তিকের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ প্রকাশ করেছে নেটফ্লিক্স। তাতে দেখা যাচ্ছে, কিছুটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই পড়েছে এই ভিডিওস্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠান। প্রবৃদ্ধির চাকা শ্লথ হয়ে পড়ছে। যেহেতু গ্রাহকদের বিজ্ঞাপনের জ্বালা দেয় না নেটফ্লিক্স, তাই এর মাথায় আছে বিপুল অঙ্কের দেনা। বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার তাড়া খুব বেশি। কিন্তু সেই অনুযায়ী অগ্রগতি ততটা নেই। এদিকে ডিজনি প্লাসসহ অন্যান্য আগ্রাসী প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারণে বিক্রিবাট্টাও কিছুটা কমে এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে গ্রাহক সংগ্রহের লক্ষ্যও কমিয়ে এনেছে নেটফ্লিক্স। গত বছরের একই সময় যা ছিল ৯৬ লাখ, এ বছর তা হয়েছে ৭০ লাখ। ওদিকে বিপণন খাতে ব্যয় বাড়াতে হয়েছে ২০ শতাংশ। বিশ্লেষকেরা বলছেন চিন্তার কিছু নেই। নেটফ্লিক্সের কনটেন্টের বিশাল ভান্ডারের সঙ্গে লড়াই করা ঢের কঠিন। বিশেষ করে মার্কিন মুলুকের পাশাপাশি পুরো বিশ্বে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হতে ডিজনি-এইচবিওকে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে। আর যদি অস্কার আসরে নেটফ্লিক্সের কপালে ধুন্ধুমার কিছু জুটে যায়, তবে তো কথাই নেই।

যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েও নিজেদের আগের কৌশল থেকে সরছে না নেটফ্লিক্স। স্নায়ুর চাপ সামলাতে কনটেন্ট তৈরিতে আরও বেশি বেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সময়েই বোঝা যাবে—কার ঘরে যাবে অস্কার, কে জিতবে স্ট্রিমিং ওয়ার!

মহামারীর কারণে ঘরে কোয়ারেন্টাইনের ফলে নেটফ্লিক্সের উন্নয়ন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে।

নেটফ্লিক্সের প্রথম প্রান্তির আথিক প্রতিবেদন অনুয়াযি, এর গ্রাহকদের সংখ্যা ১ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার বৃদ্ধি পায় এবং এই সংখ্যা নতুন রেকর্ড সৃস্টি করে। ২০১৫ সাল থেকে বিশাল সম্ভাবনাসম্পন্ন এশীয় বাজার উন্নয়ন করা হলো নেটফ্লিক্সের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। জাপান হলো এর প্রথম গন্তব্যস্থান। দক্ষিণ কোরিয়া হলো দ্বিতীয় গন্তব্যস্থান। তা ছাড়া, নেটফ্লিক্স ভারত, ফিলিপিন্স,মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন বাজারে বরাদ্দ করা শুরু করে।

নেটফ্লিক্স কিভাবে উপভোগের ভিন্ন অভ্যাসসম্পন্ন এশীয় দর্শকদের আকর্ষণ করে?দক্ষিণ কোরিয়া হলো খুব সফল একটি উদাহরণ।

আসলে দক্ষিণ কোরিয়ার ডোমেস্টিক বিনোদনের শিল্প অতি পরিপক্ক। নেটফ্লিক্সের প্রবেশ করা সহজ ব্যাপার নয়। সর্বপ্রথমে নেটফ্লিক্স মেধাসত্ত্বের সহযোগিতা এবং যৌথভাবে নির্মাণসহ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করলো। ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সের উদ্যোগে দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে প্রথম সফল শিল্পকর্ম 'Kingdom' জন্ম হয়। এই সফল শিল্পকর্ম থেকে আমরা নেটফ্লিক্সের স্থানীয়করণের সৃষ্টির কয়েকটি চিন্তাধারা দেখতে পারি।

প্রথমত স্থানীয় বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীর অভিনয়। স্বদেশের জনগণের কাছে সুপরিচিত অভিনেতা ও অভিনেত্রী বেছে নেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত শিল্পকর্মের বিষয় বা কাহিনী স্বদেশ জনগণের কাছে সুপরিচিত। তৃতীয় আন্তর্জাতিকীকরণের সম্প্রচারের সম্ভবনা বিবেচনা করে দেখা। স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিষয় ছাড়াও,নেটফ্লিক্স বিষয়ের আন্তর্জাতিকীকরণের ওপর মনোযোগ দেয়।

লিলি/তৌহিদ/শুয়ে

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040