বেইজিং চীন-জাপান মৈত্রী হাসপাতালের রাষ্ট্রীয় জরুরি চিকিৎসক ত্রাণদলের প্রধান ওয়াং ইয়ান সেন ১ ফেব্রুয়ারি চীনের উ হান শহরে পৌঁছান সেখানে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজে যোগ দেন। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি প্রথমে কুয়াংকু অস্থায়ী হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছিলেন, পরে আবার থুংজি হাসপাতালের চুংফা নতুন শহর এলাকার চিকিৎসা দলে যোগ দেন। তিনি নিজের ছেলেকে একটি মনোমুগ্ধকর চিঠি লিখেছিলেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা সেই চিঠিটি তুলে ধরছি।
চিঠিতে তিনি বলেছেন:
প্রিয় ছোট বিন, চিঠির মাধ্যমে তুমি তোমার বাবাকে দেখো। তোমার মাকে বলো, এই চিঠি পড়ে শোনাতে। আমি বাবা। আজ তোমার জন্মগ্রহণের ১০০তম দিন। তুমি শক্তিশালী মানুষ হওয়ার দিকে আরো একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছো। তুমি এখন হামাগুড়ি দিচ্ছো। তুমি এখন বাবাকে খুঁজে বেড়াও। তবে বাবা এখন অন্য একটি শহরে নতুন কাজ করছে। এই শহরের নাম উ হান। যদিও এই শহরে করোনাভাইরাসের কালো ছায়া রয়েছে; তবে এই শহর বীরের শহর। তোমার বাবা চীন-জাপান মৈত্রী হাসপাতালের ১৫০ জনেরও বেশি কর্মীর সঙ্গে এখানে এসেছে। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই: ভাইরাস পরাজিত করা ও জয়ী হওয়া। উ হানের জয়, হু পেই প্রদেশের জয়, গোটা চীনা জাতির জয়।
ডাক্তার ওয়াং ছেলেকে বোঝাতে চান, কেন তার বাবা বাসায় নেই। এ কথাগুলো ভালোবাসা থেকে উৎসারিত। উ হানে করোনাভাইরাসের অবস্থা গুরুতর ছিল, প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকত। একজন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং চিকিৎসক হিসেবে, তিনি সে দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারেন না। সারা দেশের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরের চিকিৎসকরা হুপেই প্রদেশ ও উ হানের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করেছেন। এটি ছিল উ হানের চূড়ান্ত প্রতিরোধ লাইন। যদি তারা উ হানে এবং হু পেই প্রদেশে না যান, সাহায্য না করেন, তাহলে উ হান, হুপেই তথা সারা দেশ করোনাভাইরাসের মহা ঝুঁকিতে পড়বে।
ডাক্তার ওয়াং ছেলেকে বলেন: তোমার বাবা কেন দ্বিধা না করে উ হানে গিয়েছে? কারণ বাবা চিকিৎসক সহকর্মীদের সঙ্গে তোমার মতো আরো অনেক শিশুকে রক্ষা করতে চান, সবাইকে বাঁচাতে চান।
চীন-জাপান মৈত্রী হাসপাতালের রাষ্ট্রীয় জরুরি মেডিকেল ত্রাণ দলকে 'রাষ্ট্রীয় দল' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ দলটি একটি বীর চিকিৎসকের দল। দলের চিকিৎসকরা সবাই বাসার ছেলেমেয়ের কথা মনে করেন, তবে তারা সবাই কোনও দ্বিধা না করেই উ হানে যান। আসলে বিজয়ী হতে চাইলে কিছু উৎসর্গ করতে হয়। সাময়িক বিচ্ছেদ আসলে দীর্ঘস্থায়ী মিলনের জন্যই..।
ওয়াং ইয়ান সেন ছেলেকে চিঠিতে লিখেছেন, তিনি আসলে ছেলেকে একটি উপহার, একটি খেলনা অথবা একটি পোশাক কিনে দিতে চেয়েছিলেন। তবে উ হানে তাঁর চিকিৎসার অভিজ্ঞতার পর তিনি উপলব্ধি করেছেন, এসব খেলনার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান উপহার ছেলেকে দেওয়া যায়। তা হলো- 'দায়িত্ববোধ'। ডাক্তার ওয়াং সার্স ও করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজে অংশ নিয়েছিলেন। দুই অভিজ্ঞতার অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সার্সের সময় তাঁর অনুভূতি ছিল সক্রিয় ও সাহসী। এবার তিনি অনেক দয়িত্বানুভূতি বোধ করেন। দায়িত্ব পালনের জন্য তারা করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের যুদ্ধের মাঠে নেমেছেন। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে চীনারা সার্স ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছে, এবারও চীনারা নিশ্চয়ই জয়ী হবে।
ওয়াং ইয়ান সেন চিঠিতে আরো লিখেছেন: আমার প্রিয় ছেলে, তোমার জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ দিন হয়েছে। তোমার নিজের দায়িত্বও আছে। তোমার দায়িত্ব হলো সুস্বাস্থ্য নিয়ে বড় হওয়া। তোমার বাবা ও ভাইরাস প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে সব চিকিৎসকের নিরাপদে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা। মনে করো, বাবা তোমার দিকে ছুটে যাচ্ছে।
এরপর ২২ এপ্রিল, ওয়াং ইয়ান সেন নিরাপদে বাসায় ফিরে যান। তিনি আনন্দের সঙ্গে দেখেন, তাঁর ছেলে তাঁর কথা মনে রেখেছে, তাঁকে চিনতে পেরেছে!
ভালোবাসা, মানুষের দুর্বলতা, মানুষের বর্ম—সাংবাদিক দম্পতি উ হানে যৌথভাবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের গল্প
চাং ভেং জুন, লি জিং হুই, দু'জনই চায়না মিডিয়া গ্রুপের সাংবাদিক। করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ার পর তারা উ হানে ৯২ দিন ধরে আছেন। তারা ৫০ বার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকায় প্রবেশ করেছেন এবং ৩ শতাধিক খবর প্রচার করেছেন। তারা চীনের করোনাভাইরাস প্রতিরোধের গল্প প্রচার করেছেন। এসব কাজ তাদের ভালোবাসার গল্পের সাক্ষী।
২৫ জানুয়ারি হলো চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার নতুন বছরের প্রথম দিন। এদিনটি ছিল উ হান শহর লকডাউন হওয়ার তৃতীয় দিন। ওই রাতে স্বামী চাং ভেং জুন উ হানে পৌঁছান। পরদিন, তিনি একটি লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উ হানের হুও শেন শান বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের কাজ বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। লাইভ শেষে তিনি বলেন, এবার উ হানে এসেছি, আমি আত্মীয়স্বজনকে জানাই নি। তবে, আজ আমি লাইভ অনুষ্ঠান করছি। আপনারা হয়তো আমাদের দেখেছেন। অনুরোধ করছি, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমরা ভালোভাবে প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছি।
২৫ জানুয়ারি। এদিন, চাং ভেং জুনের স্ত্রী লি জিং হুই সকালের প্রথম ফ্লাইটে লানচৌ থেকে বেইজিংয়ে পৌঁছান। তারপর তিনি বেইজিং থেকে ট্রেনে করে উ হানে গিয়ে হাজির হন। দ্রুতগতির ট্রেনে বসে তিনি বাবা মাকে ফোন করেন। ফোনে তিনি জিজ্ঞেস করেন, যদি আমি উ হানে যাই, তাহলে তোমরা আপত্তি করবে কি না? তাঁর বাবা বলেন, সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করতে হলে সেখানে যাওয়া উচিত। ভালোভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নাও, আমি ও তোমার মা বিশ্বাস করি, তুমি নিশ্চয়ই পারবে।
এভাবে স্বামী ও স্ত্রী করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের ফ্রন্ট লাইনে--'যুদ্ধের মাঠ' উ হানে গিয়ে হাজির হন। তাদের চোখে তখন অন্য ধরনের রোমান্টিক অনুভূতি! কারণ তাদের মধ্যে শুধু একজন উ হানে গেলে, অন্যজন নিশ্চয় অনেক দুশ্চিন্তা করতো!
তারা সাক্ষাৎকারের জন্য সবসময় গুরুতর রোগীদের ওয়ার্ডে যান। তাই, নিরাপত্তার জন্য স্বামী চাং ভেং জুন ও স্ত্রী লি জিং হুই আলাদা থাকেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি, চাং ভেং জুনের সাক্ষাৎকার নেওয়া ডাক্তারের জ্বর হয়, তিনি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকারী হিসেবে শারীরিক পরীক্ষা দেন। লি জিং হুই স্বামীর সঙ্গে হাসপাতালে যান। তখন দু'জন উ হানে পৌঁছার পর প্রথম ছবি তুলতে পারেন। তাদের কাছে, সবচেয়ে উষ্ণ ভালোবাসার কথাটি ছিলো: উ হানের করোনাভাইরাস কবলিত এলাকায়, আমরা পরস্পরকে বলেছি, যদি তুমি অসুস্থ হও, তাহলে আমি তোমার যত্ন নিবো।
সৌভাগ্যের বিষয় হলো, পরীক্ষার পর দেখা যায়, চাং ভেং জুনের সাক্ষাৎকার নেওয়া ডাক্তার সাধারণ ঠান্ডা জ্বরে আক্রান্ত। লি জিং হুই বলেন, এটা ছিল এই বসন্তকালে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো খবর। সে মুহূর্তে আমি সত্যিকার অর্থেই উপলব্ধি করতে পারি যে, উ হানে আমরা প্রাণঘাতী ভাইরাসের কবলে পড়তে পারি, তথা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি!
উ হানে লি জিং হুই বিপুল পরিমাণ কাজ করেছেন। মাঝে মাঝে একদিনে তিনি ছয়টি লাইভ শো করতেন! দুপুরের খাবার খাওয়ার সময়ও পেতেন না। তিনি রাস্তার কর্নার থেকে অল্প ইন্সট্যান্ট নুডল্স খেয়ে আবারও কাজ শুরু করতেন। উ হানে পৌঁছার মাত্র দশ দিনের মাথায় লি জিং হুই অনেক শুকিয়ে যান। তার স্বামী এ জন্য খুব দুঃখ পেতেন।
মার্চ মাসে চাং ভেং জুন হাসপাতালের বিচ্ছিন্ন এলাকায় সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়, দূষিত প্রতিরোধক চশমা তার চোখে আঘাত করে। নার্স তাড়াতাড়ি স্যালাইন দিয়ে তাঁর চোখ পরিষ্কার করেন। সেই মুহূর্তে তিনি ভেবেছিলেন, সর্বনাশ! এবার আমার এত সৌভাগ্য হবে না! সেদিন রাতে তার চোখ ফুলে লাল হয়ে যায়। টানা অনেক দিন তিনি স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সাহস করেন নি।
সাংবাদিক স্বামীর জন্য চোখ পরিষ্কার করার ভিডিও দেখে সাংবাদিক স্ত্রী লি জিং হুই কাঁদতে থাকেন। স্বামী তাকে বলেন, পরিষ্কার করার পর সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে এরপর অনেক দিন স্বামী তার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না। তিনি জানেন, স্বামী তার উদ্বেগ দেখাতে চান না। স্বামী চান স্ত্রী ভালো থাকুক ও মনোযোগ দিয়ে কাজ করুক।
সে সময়, লি জিং হুই অব্যাহতভাবে লাইভ করতেন। লাইভে তিনি অনেক চিকিৎসককে বিভিন্ন সামগ্রীও দিতেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বলেন, তিনি হলেন ভালোবাসা ডেলিভারি দেওয়া বোন। লি জিং হুই মনে কিছুটা কষ্ট পান। কারণ, এ সময়ে তিনি স্বামীর যত্ন নিতে পারতেন না। তার স্বামী বার বার উ হানের হাসপাতালের বিচ্ছিন্ন ওয়ার্ডে যান, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীকে একটি মাস্কও দিতে পারেন না।
সৌভাগ্যের বিষয় হলো, পরীক্ষার পর দেখা যায়, চাং ভেং জুন আক্রান্ত হন নি।
অবশেষে উ হানে বসন্তকাল এসেছে, ফুল ফুটেছে, করোনাভাইরাসও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। চাং ভেং জুন উ হানের পুনরুজ্জীবন নিজ চোখে দেখেছেন। একজন ডাক্তার গুরুতর রোগীর ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে আসছেন, তিনি গান গাইছেন। কারণ তাঁর রোগীরা ভালো হয়ে উঠছে। চাং ভেং জুন এর আগে একজন গর্ভবতী নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন; এখন সেই নারীর সন্তান নিরাপদে জন্মগ্রহণ করেছে। মা ও সন্তান দু'জনই ভালো আছে। চিকিৎসকরাও ভালো আছে।
চাং ভেং জুন বলেন, এ মুহূর্তে, আমার চোখ লাল হয়েছে ও ফুলে উঠেছে। তবে আমি স্পষ্টভাবে এই বিশ্বের সৌন্দর্য দেখতে পারছি। সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার ও সুন্দর হলো মানুষের হৃদয়!
উ হানে পৌঁছার প্রথম দিকে, লি জিং হুই সবসময় বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর থেকে উ হানে আসা সহায়তাকারী চিকিৎসকদের খবর প্রচার করতেন। প্রতিবার তিনি রেকর্ড করতেন, আজ কয়টি চিকিৎসকদল উ হানে এসেছে, দলের সদস্য কতজন...। তিনি আশা করতেন, যখন উ হান শহর আবারও বসন্তকালকে আলিঙ্গন করবে, যখন উ হান শহর করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হবে, তিনি নিজে এসব বীর চিকিৎসকদের বিদায় জানাতে পারবেন। এখন লি জিং হুই-এর এই স্বপ্ন, বাস্তবায়িত হয়েছে।
উ হান শহর আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। জনগণের মুখে আবার সুখের হাসি দেখা যাচ্ছে। এই সাংবাদিক দম্পতিও তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তাদের ভালোবাসাকে আরো দৃঢ় করে তুলেছে।
ভালোবাসা কারও দুর্বলতা হতে পারে, ভালোবাসা কারও সুরক্ষাকারী বর্মও হতে পারে!