হালকা কুয়াশা ভেদ করে ভোরের আলো দেখা যায়। চীনের হাইনান প্রদেশের পাই শা লি জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলায় 'উ লি লু' চা কোম্পানির জৈব চা বাগানে পর্যটকরা ছুটে আসছেন। কোম্পানির ২০ জনেরও বেশি কর্মী বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসে এখানে কাজ করছেন। কোম্পানির প্রধান ফু সিয়াও ফাং চা বাগানের সব কাজ বণ্টন করে আবারও রান্না ঘরে এসে অতিথিদের জন্য নাস্তা তৈরি করা শুরু করেছেন।
একদিকে অভ্যর্থনার কাজ করা ও অন্যদিকে চা বাগানের কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি। ফু সিয়াও ফাং টানা কয়েক দিন ধরে বিশ্রাম নেন নি। মে দিবস বা শ্রম দিবসে চীনে ৫ দিন ছুটি হয়েছিল। চা বাগানে ৭ শতাধিক পর্যটক চা তুলতে এবং সেখানে চাষ করা লেবু তুলতে এসেছেন। চা বাগানে থাকার জায়গাও আছে। পর্যটকরা চা বাগানের অধীনে হোটেলে থাকতে পারেন, রাতে চা বাগানে বসে ঝকঝকে আকাশের তারা উপভোগ করতে পারেন, অন্ধকারে জোনাকি পোকার ওড়াওড়ি দেখতে পারেন, ভোরে বিছানায় শুয়ে পাখির গান শুনে জেগে ওঠার আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। সুন্দর প্রকৃতিতে আরাম করে কিছু সময় কাটাতে পারায় চা বাগান অনেক পর্যটক আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
চা বাগানের প্রধান ফু সিয়াও ফাং বলেন, মানুষের জীবন যেন চা-এর মত, বার বার রূপান্তরিত হয়। অর্থাত্ কঠিনতাকে বার বার পরাজিত করার পর সুগন্ধযুক্ত অর্জন হয়! চা তৈরির জন্য পাতা সংগ্রহ, শুকানো, চূর্ণ করাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। নিজে চায়ের ব্যবসা করা কিন্তু ঘরে চা তৈরি করার মতো সহজ কোনও ব্যাপার না।
২০০৮ সালে লি জাতির যুবক ফু সিয়াও ফাং বড় শহর থেকে গ্রামে ফিরে নিজেই ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করেন। তিনি সেখানের পাই শা কৃষিখামারে বড় একটি জৈব (organic) চা বাগান গড়ে তোলেন। তিনি ৫টি কৃষক পরিবারকে নিয়ে অর্গানিক চা চাষ করার চেষ্টা করেন। বহু বছর আগে পাই শান জেলায় উল্কা-খণ্ডের আঘাতে একটি কূপ বা গভীর গর্ত তৈরি হয়। তাদের চা বাগান ঠিক এই কূপের ২.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২.৫ কিলোমিটার চীনের স্থানীয় দৈর্ঘ্য পরিমাপের এককে ৫ লি হয়। তাই ফু সিয়াও ফাং তার চা বাগানকে '৫ লি পথ' অর্থাত্ চীনা ভাষার 'উ লি লু' নাম দেন। শূন্য থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি মাইল আসলে সহজ পথ নয়।
অর্গানিক চা চাষের জন্য তারা হার্বিসাইড (herbicide) ব্যবহার করেন না, নিজের হাত দিয়ে ঘাস বা আগাছা তোলেন। চা চাষ করলে ফু সিয়াও ফা বছর ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় হাত দিয়ে চা পাতা সিদ্ধ করেন। যখন তিনি ড্রাইভাইরের লাইসেন্স আবেদনের জন্য আঙুলের ছাপ দিতে যান, তখন আবিষ্কার করলেন যে, তাঁর আঙুলের ছাপ চা সিদ্ধ করার সময় ধীরে ধীরে মিশে গেছে; তাই আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায় না! তিনি চা-এর স্বাদ পরীক্ষা করার জন্য অনেক বেশি চা পান করতেন, এ কারণে তাঁর পাকস্থলীতে রোগ হয়। বছরের পর বছরের চেষ্টা ও অনুসন্ধানের পর, তাদের 'উ লি লু' নামে চা চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ'র অর্গানিক সার্টিফিকেট লাভ করে। তাদের উচ্চ মানের চা দেশের বিভিন্ন স্থানেও বিক্রি হয়।
এই চা বাগানের কারণে সে অঞ্চলের লোকজন লাভবান হয়েছে। চা বাগানের পাশে ছোট নদীর ওই পাশে, ফাং সিয়াং গ্রামের কৃষক লি ইয়াও ফু আগে শুধুই জমিতে কৃষিকাজ করে জীবন কাটতেন। গ্রীষ্মকালে বন্যার কারণে কোনো ফসল পাওয়া যেত না, জীবন খুব কঠিন ছিল।
ফু সিয়াও ফাং তাকে সাহায্য করতে চান। তিনি কৃষক লিকে বলেন, এভাবে জমি চাষ করা যায় না, আমার চা বাগানে এসে কাজ করেন। শুরুর দিকে, কৃষক লি চা বাগানে ভালোভাবে কাজ করতে জানতেন না, সবার আগে বাসায় চলে যান, তবে এখন তিনি এই চা বাগানকে ভালোবেসেছেন, এই কাজ ভালোবেসেছেন। প্রতি মাসে তিনি তিন হাজার ইউয়ানেরও বেশি বেতন পান।
ফু সিয়াও ফাং চা বাগান পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করতে চান। তাঁর চা বাগানের মাধ্যমে ৩৬২টি দরিদ্র পরিবার দারিদ্রমুক্ত হয়েছে। তাঁর চা বাগান এখন হাইনান প্রদেশের দারিদ্র্যবিমোচনের দৃষ্টান্তমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর চা বাগানে সবার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, উপযোগী কাজ দেয়া হয়। এভাবে সবাই কাজ করার মাধ্যমে নিজের উন্নয়ন করতে পারেন, কাজের সামর্থ্য বাড়াতে পারেন।
চলতি বছর, করোনাভাইরাসের প্রভাবে 'উ লি লু' চা বাগানের চা স্টোরের বিক্রি অনেক কমেছে। তাই তারা অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। তারা বিশেষ কর্মদলকে নিয়োগ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চা-এর পরিচয় করে দেন। চা বাগানের কর্মীরাও কাজের ফাঁকে নিজের মোবাইলফোন দিয়ে চা বাগানের সৌন্দর্য রেকর্ড করে ওয়েসবাইটে পোস্ট করেন। তাদের তোলা ছবি এবং ভিডিও যেন এই চা বাগানের সবচেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন। চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর ভিউ দশ লাখেরও বেশি!
ফু সিয়াও ফাং বলেন, আমরা অনলাইনে সরাসরি প্রচার করতে চাই। কৃষকরা লাইভ ভিডিওতে চা বাগানের সুন্দর প্রকৃতি এবং আমাদের চা-এর গুণগতমান তুলে ধরতে পারেন।
চলতি বছর অনলাইনে 'উ লি লু' চা বাগানের চা-এর বিক্রি আগের বছরের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেড়েছে। ফু সিয়াও ফাং এ অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন, ই-কমার্সকে আরো জোরদার করা উচিত। কৃষকরা এতে গভীরভাবে যোগ দিতে পারেন, স্থানীয় গ্রামের কৃষিজাত দ্রব্য বাইরে বিক্রি করতে পারেন।
ফু সিয়াও ফাং বলেন, মানুষের জীবন তো এক মাইলের পর আরেকটি মাইল। সংগ্রামের পথের কোনও গন্তব্য নেই। সামানে আরো অনেক মাইল পথ আমাদের পার হতে হবে। আমি আমাদের গ্রামের সবাইকে নিয়ে আরও সামনে এগিয়ে যাবো।
গ্রামীণ চিকিত্সক প্রতিনিধি লিউ ছিং মিং: আশা করেন প্রতিটি গ্রামে চিকিত্সক থাকবে
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত, গ্রামীণ চিকিত্সক লিউ ছিং মিন এক দিনও ছুটি পান নি। তিনি বলেন, 'আমি গ্রামে ৪১ বছর ধরে চিকিত্সা করেছি, চলতি বছরের চ্যালেঞ্জ অভূতপূর্ব।
লিউ ছিং মিন চীনের সান তুং প্রদেশের জি নিং শহরের সি সুই জেলার ওয়েই ছুয়ান জুয়াং গ্রামের একজন গ্রামীণ চিকিত্সক। তিনিও চীনের জাতীয় গণকংগ্রেসের একজন প্রতিনিধি। ৪০ বছর ধরে গ্রামে এবং আশেপাশের গ্রামের কৃষকরা অসুস্থ হয়ে, তার কাছে সাহায্য চান। চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। তাঁর কাজ আরো কঠিন হয়ে ওঠে। দূরবর্তী এলাকার চিকিত্সার অবস্থা ভালো না, তাই স্থানীয় গ্রামীণ চিকিত্সক ভাইরাস প্রতিরোধে আরো বেশি কাজ শুরু করেন।
এই কয়েক মাস ধরে লিউ ছিং মিন বার বার গ্রামবাসীদের মাস্ক পড়ার সঠিক পদ্ধতি শিখিয়েছেন। দৈনন্দিন কাজ ছাড়া লিউ ছিং মিন থানার প্রতিটি চেক স্টেশন এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করা এবং পরিবেশ জীবাণুমুক্তকরণের কাজে নির্দেশনা দেন। তিনি ভাইরাস প্রতিরোধে নিজস্ব অবদান রাখতে চেষ্টা করেন।
ভালো খবর হলো, লিউ ছিং মিন এ যুদ্ধে একা নন।
স্থানীয় ভাইরাস প্রতিরোধের ফ্রন্ট লাইনে, একটি বিশেষ দল আছে। দলের সবাই সবুজ রং-এর ক্যাপ পরেন। তারা বিনা খরচে সবাইকে মাস্ক দেন, শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করেন, সেই সঙ্গে তারা জনসাধারণকে গণস্বাস্থ্যের বিভিন্ন জ্ঞান দেন। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, তারা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য ৫০ হাজার ইউয়ান প্রদান করেছেন।
এই বিশেষ দলের নাম 'গ্রামের চিকিত্সক'। ২০ জনেরও বেশি স্থানীয় চিকিত্সক ২০১৯ সালে এই দলটি গঠন করেন। এর প্রতিষ্ঠাতা লিউ ছিং মিন। তিনি বলেন, এই সমিতি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বয়স্কদের চিকিত্সা সেবা দেওয়া। তিনি বলেন, এখন করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধের জন্য আমাদের এই সমিতি আরো বেশি দায়িত্ব পালন করছে।
লিউ ছিং মিন এবং তাঁর 'গ্রামীণ চিকিত্সক' সমিতি, জেলার ৫ শতাধিক গ্রামের সহস্রাধিক গ্রামীণ চিকিত্সক করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজে অংশ নিয়েছেন। তারা গ্রামের গণস্বাস্থ্য সেবা, মৌলিক চিকিত্সা সেবার প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
লিউ ছিং মিন বলেন, ভাইরাস প্রতিরোধের মাধ্যমে লোকজন গ্রামীণ চিকিত্সকের শক্তি বুঝতে পেরেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে গ্রামীণ চিকিত্সায় অনেক কাজ সুসংহতভাবে করতে হয়। বিশেষ করে তাঁর কাজ দূরবর্তী পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে চিকিত্সকের অভাব খুব গুরুতর। তিনি চীনের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে স্থানীয় চিকিত্সাব্যবস্থা পরিদর্শন করেন, গ্রামীণ চিকিত্সক ব্যবস্থাপনা স্থাপন এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন।
তিনি বলেন, অনেক গ্রামীণ চিকিত্সক জনসাধারণকে সারা জীবন সেবা দিয়েছেন। তবে তাদের বেতন তেমন ভালো না। চলতি বছর চীনের রাজনৈতিক মহলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক দুই অধিবেশনে, তিনি অব্যাহতভাবে গ্রামীণ চিকিত্সকের মর্যাদা, আয় ও ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব দেবেন; যাতে তৃণমূল পর্যায়ের চিকিত্সকরা ভালোভাবে গ্রামে থাকতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে লিউ ছিং মিন গ্রামীণ চিকিত্সকের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করার পদ্ধতি খুঁজে বের করতে চান। তিনি বলেন, গ্রামের চিকিত্সকদের মধ্যে অনেকেরই অবসরে যাওয়ার বয়স হয়েছে। এ সময় তরুণ চিকিত্সকদের খুব প্রয়োজন। তিনি প্রস্তাব দেন যে, স্থানীয় লোকজনের মধ্যে স্থানীয় চিকিত্সকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। তিনি নিজেই তা বাস্তবায়ন করছেন। তাঁর গ্রামে তাঁকে ছাড়া আরেকজন ৩৫ বছর বয়সী চিকিত্সক আছেন, তিনি লিউ ছিং মিনের ছেলে লিউ চুয়াং চুয়াং। এখন তাঁর ছেলে চুয়াং চুয়াং আস্তে আস্তে বাবার হাত থেকে স্থানীয় লোকজনের চিকিত্সার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তিনি গ্রামে স্থায়ীভাবে থাকতে চান।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে লিউ ছিং মিন আরেকটি সমস্যা আবিষ্কার করেছেন। তা হল, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকার স্কুল ও বিদ্যালয়ে, চিকিত্সকের অভাব দেখা যাচ্ছে। তিনি চলতি বছরের দুই অধিবেশনে প্রত্যেক স্কুলে চিকিত্সা কক্ষ ও চিকিত্সকের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিতে চান। যাতে সময় মতো স্কুলের আকস্মিক অবস্থা মোকাবিলা করা যায় এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া যায়।