২৯ এপ্রিল, আন হুই প্রদেশের চিন চাই জেলা দারিদ্র্যমুক্ত হয়। চিন চাই জেলা তা পিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। এটা যেমন চীনা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ উত্থানের জায়গা, তেমনি চীনে সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোর অন্যতম ছিল।
চিন চাইর জেলার ইতিহাসে কয়েকটি '১ লাখ'-এর গল্প আছে।
বিপ্লবকালে, ২.৩ লাখ লোকসংখ্যার চিন চাই জেলা থেকে যথাক্রমে ১ লাখের বেশি মানুষ রেড আর্মিতে যোগ দেয়। তখন এখানে এমন একটি কথা জনপ্রিয় হয়ে ছিল: চিন চাই জেলা সামরিক খাবার তৈরির জন্য শেষ চালটি দেয়, ইউনিফর্ম তৈরির জন্য শেষ পোশাকটি দেয় এবং শেষ ছেলেকে বাহিনীতে পাঠায়। এখানকার পাহাড়ে শহীদদের মরদেহ দাফন করা হয়েছে এবং লাল আজালিয়া ফল তাদের প্রতীক।
দ্বিতীয় 'এক লাখ' চিন চাই মানুষের ত্যাগস্বীকারের গল্প। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে, হুয়াই হ্য নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য মেই শান ও সিয়াং হং তিয়ান নামে দুটি বড় জলাধার নির্মাণ করা হয়। জলাধার নির্মাণের জন্য ১ লাখের বেশি মু কৃষিজমি স্থায়ীভাবে নিমজ্জিত হয় এবং ১ লাখের বেশি মানুষকে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়াগায় স্থানান্তরিত হতে হয়। তাদের গ্রামও পানির নিচে ডুবে যায়।
এমন অবস্থায় চিন চাই জেলা বড় ত্যাগস্বীকার করে এবং দরিদ্রতম একটি জেলায় পরিণত হয়। ১৯৭৮ সালে, চিন চাই জেলার দরিদ্র লোকসংখ্যা ছিল মোট লোকসংখ্যার ৯৯ শতাংশ। তার মানে প্রায় প্রতিটি পরিবার, প্রত্যেক ব্যক্তি দরিদ্র ছিল। ২০১১ সালে চিন চাই জেলাকে গভীর দরিদ্র জেলা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ২১০টি দরিদ্র গ্রামের মধ্যে ৭১টি চিন চাই জেলায় এবং দরিদ্র লোকসংখ্যা ১.৩ লাখের বেশি।
চিন চাই জেলা আন হু প্রদেশে বৃহত্তম একটি পাহাড়ি জেলা। পূর্ব চীনের শেষ কুমারী বন ও কয়েকটি বড় জলাধার এখানে আছে। মাথাপিছু কৃষি জমি ১ মুর চেয়ে কম। জেলার উন্নয়ন প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে বলে এ জেলার দারিদ্র্যমুক্তির কাজ আরও কঠিন ছিল।
লিউ পো গ্রাম হল চিন চাই জেলার ১১টি গভীর দরিদ্র গ্রামের অন্যতম। এখানে দারিদ্র্যমুক্তির কার্যকর একটি পদ্ধতি ছিল 'বক্সে মাছ চাষ'। তবে ২০১৬ সালে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য, বক্সগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়। লিউও পো গ্রামের বাসিন্দারা এর বিরোধিতা করতো। কারণ, শুরুতে জলাধার নির্মাণের জন্য গ্রামবাসিন্দারা নিজেদের বাড়ি হারায় এবং এখন তাদের অর্থ উপার্জনের পদ্ধতিও হারাতে হচ্ছে!
কয়েকবার বিবেচনার পর চিন চাই জেলা পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য দুটি জলাধারের ৩ হাজারের বেশি বক্স সরিয়ে নেয় এবং ৩০ কোটি ইউয়ান বের করে স্থানীয় মানুষদেরকে অন্য শিল্প উন্নয়ন করতে সাহায্য করে। এখন চিন চাই জেলায় পানির পরিমাণ খুব ভাল এবং মোট আয়তনের শতকরা ৭৫ ভাগই বনাঞ্চল। সুন্দর পরিবেশ আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করে।
২০১৪ সাল থেকে, চিন চাই জেলায় শুরু হয় ফটোভোলটাইক দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প। পাহাড়ে স্থাপন করা হয় ফটোভোলটাইক বোর্ড। এ বোর্ড সূর্যালোকে বিদ্যুত উত্পাদন করে এবং এর মাধ্যমে অর্থ উপাজন করতে পারে স্থানীয়রা। তা ছাড়া, কৃষ্টি পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন শিল্পের উন্নয়ন করা হয় এখানে। ৮টি গ্রামের ২৩ হাজার মানুষ এ পদ্ধতির মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত হয় এবং প্রতি পরিবারের আয় ৪ হাজার ইউয়ান বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে, ক্যাডাররা দারিদ্র্যবিমোচন কাজে বড় ভূমিকা পালন করেন। মোট ১৩ হাজার সিপিসি সদস্য দারিদ্র্যবিমোচনের ফ্রন্টলাইনে যান এবং ৪৮৪ জন গ্রামে নিযুক্ত হন দারিদ্র্যবিমোচন কাজ পরিচালনা করতে। ওয়াং মু শেন এমন একজন ক্যাডার। তার মতে গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন কেবল প্রথম পদক্ষেপ। গ্রামের পুনরুদ্ধার তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। কিছুদিন আগে, একটি পর্যটন সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি এবং চলতি বছরের ২৫টি কর্তব্য গ্রাম কমিটির কাছে উত্থাপন করেন। এ ২৫টি কাজ দারিদ্র্যমুক্ত হবার পর গ্রামের পরিবর্তী উন্নয়নসম্পর্কিত।
ইউ চিংও গ্রামে নিযুক্ত একজন ক্যাডার। তিনি স্মরণ করে বলেন, যখন তিনি গ্রামে কাজ শুরু করেন তখন দেখেন গ্রামের যুবকরা সব বাইরে যায়। তবে গত দু বছরে, ৪৩৬ জন যুবক গ্রামে ফিরে আসেন এবং তারা নিজ নিজ শিল্প উন্নয়ন করেন।
সিয়া পেং মেডিকল স্কুল থেকে স্নাতক হবার পর গ্রামে ফিরে আসেন এবং গ্রাম বাসিন্দারা তাকে গ্রামের প্রধান হিসেবে নির্বাচন করেন। এখন চিন চাই জেলায় তার মতো তিন ভাগের এক ভাগ গ্রামের প্রধান যুব মানুষ।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে, পাও ওয়ান গ্রামের ২১টি খামার বাড়ি ভাড়া হয়। ৫ দিনের মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এখানে ভ্রমণ করেন। একসময় বাইরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন এ জেলা এখন উন্মুক্ত। চিন চাই জেলায় ৩৬০ কোটি ইউয়ান দিয়ে পর্যটন এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি হাই স্পিড ট্রেনও জেলার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। গেল বছর ১.২ কোটির বেশি মানুষ চিন চাই জেলায় ভ্রমণ করতে আসে, যা স্থানীয় লোকসংখ্যার ১০ গুণ।
অনুর্বর পর্বত এখন সবুজ হয়ে উঠেছে। সারা জেলায় ১০ লাখের বেশি মু চা বাগান ও চীনা ঐতিহ্যিক ওষুধ বাগান নির্মাণ করা হয়। এ শিল্পের মাধ্যমে ২০ হাজার পরিবারের বার্ষিক আয় ২০০০ ইউয়ান করে বৃদ্ধি পায়। পাহাড়ের ভেতরে বাসকারী মানুষেরা পাহাড়ের নীচে স্থানান্তরিত হয়। তারা একদিকে নিজেদের বাড়িকে কৃষিপর্যটন খামারবাড়িতে পরিণত করে, অন্যদিকে অনলাইনে নিজেদের কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে শেখে। দুটি ব্যবসার মাধ্যমে অনেক মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
দারিদ্র্যমুক্ত হবার গুরুত্বপূর্ণ এ মুহূর্তে শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারীর আক্রমণ। মহামারীর কারণে জেলা যেন আবার দরিদ্র হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে জেলার প্রধান ওয়াং তুংয়ের নেতৃত্বে ২০০ জনের বেশি স্থানীয় মানুষ অনলাইন লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষিপণ্য বিক্রয় শুরু করেন। ১২টি দারিদ্র্যবিমোচন কারখানা স্থাপন করা হয় এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করার সুবিধার্থে তাদেরকে মোবাইলফোন সরবরাহ করা হয়।
সবার নিরলস প্রচেষ্টায়, চিন চাই জেলা আরেকটি ১ লাখের রেকর্ড সৃষ্টি করে। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, সারা জেলায় মোট ৩৮৪২৮টি পরিবারের ১২৮০৯৬ জন দারিদ্র্যমুক্ত হয়। ২১টি গ্রামের সবাই দারিদ্র্যমুক্ত হয় এবং দরিদ্রতার হার ২২.১ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ০.৩১ শতাংশে। ২৯ এপ্রিল আ হুই প্রাদেশিক সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চিন চাই জেলাকে দারিদ্র্যমুক্ত ঘোষণা করে।
সকালে, ৭০ বছর বয়সী চেন চে সেং সময়মতো সেদিনের কাজ শুরু করেন। চা কারখানায় চা রান্না করা তার কাজ। এখানে পর্যটকরা নিজের বাছাই করা চা তৈরি করেন; তাদের সাহায্য করেন চেন চে সেং। তার ছেলে মারা গেছে এবং স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ বলে তার পরিবার দরিদ্র ছিল। ২০১৭ সালে তার পরিবার দারিদ্র্যমুক্ত হয় এবং তার নতুন বাসায় একটি দারিদ্র্যমুক্তির পত্র দেয়ালে লাগানো আছে। অদূরে তার পুরাতন বাসা একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
পাহাড়ের চেহারা পরিবর্তন হয়নি, তবে গ্রামের চেহারা পুরোপুরি বদলে গেছে। চিন চাই জেলা আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। (শিশির/আলিম/রুবি)