এই বসন্তকাল সবার জন্য একদম ভিন্ন। হঠাৎ করোনাভাইরাসের কারণে চীনের অর্থনীতি ও সমাজ এতে গুরুতর প্রভাবিত হয়েছে। চলতি বছর হলো চীনের দারিদ্র্যমুক্তকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়নের শেষ বছর। এ কারণে চীনের দারিদ্র্যমুক্তকরণ আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
এখন এ মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নে আরও ২শ দিন বাকি। চীনের দরিদ্র এলাকার জনগণ ভাইরাস প্রতিরোধের সঙ্গে দারিদ্র্যমুক্তির পথে এগুচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াইয়ের চারটি গল্প আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। এটি তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার সংকল্পের প্রতিফলন।
১. বসন্তকালে শ্রমিকদের বিশেষ চার্টার ফ্লাইট
১৫ এপ্রিল শ্রমিক জিন সুসু চীনের নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে ফুচিয়ান প্রদেশের ফৌচৌ শহরে এসে কাজ করার ৪৯তম দিন। এদিন তিনি ৪ হাজার ইউয়ান বেতন পান। চার মাস পর পাওয়া প্রথম বেতন এটি। তিনি বলেন, কঠিনতাকে ভয় লাগেনি আমার, চাকরি থাকলে মন খুব স্থির থাকে।
২৯ বছর বয়সী জিন সুসু আগে ভবন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ভাইরাসের কারণে তিনি বেকার হয়ে পড়েন। বাসায় কিছু সময় থাকার পর তিনি জানতে পারেন যে, ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার সবাইকে ফুচিয়ানে গিয়ে কাজ করার ব্যবস্থা করেছে। তিনি দ্রুত এতে নাম নিবন্ধন করেন।
জিন সুসু বিমানে করে ফুচিয়ান পৌঁছান। এটি জিন সুসুর প্রথম বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এসময় তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। ফুচিয়ান এসে সেখানকার সুন্দর আবহাওয়া তাঁকে খুব আকৃষ্ট করে। তিনি বলেন, মাত্র দুই ঘণ্টায় যেন একেবারে শীতকাল থেকে বসন্তকালে চলে এসেছি।
করোনাভাইরাসের টেস্ট করার পর জিন সুসু কাজ শুরু করেন। তিনি কারখানায় কর্মী হিসেবে যোগ দেন। তার কাজ অনেক কঠিন। কোম্পানির নিয়মও খুব কড়া। সময়মত কাজ শুরু করতে হয় এবং পাঞ্চ করতে হয়। কঠোরভাবে প্রতিরোধক নিয়ম মেনে চলতে হয়, ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলতে হয়, ইত্যাদি। তবে তার কাছে সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, তিনি ফুচিয়ানের খাবার খেতে একদম অভ্যস্ত নন। তবে, এসব কঠিনতা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেন। কারণ, তাঁর মনে নিজের জন্য একটি উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। তা হল নিজের গ্রুপের প্রধান হওয়া এবং কাজে সফলতা অর্জন করা।
করোনাভাইরাস হলো চীনের দারিদ্র্যমুক্তকরণের পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই আকস্মিক মহামারির কারণে অনেক দরিদ্র মানুষ বড় বড় শহরে যেতে পারে না এবং চাকরি খুঁজতেও পারে না। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে চীনে ২ কোটি ৭২ লাখ ৯০ হাজার দরিদ্র মানুষ শহরে চাকরি করতেন। যদি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে দারিদ্র্য মানুষের আয় এ অবস্থায় অনেক কমে যাবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এজন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করার ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চীনের কু ইউয়ান শহরের শ্রম ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর প্রধান ইন চেং সিং জানান, চার্টার গাড়ি ছাড়া, কু ইউয়ান শহরে চলতি বছর প্রমবারের মত চার্টার ফ্লাইটের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের শহরে গিয়ে কাজ করার জন্য 'ওয়ান-স্টপ' সেবা চালু করা হয়। মার্চ মাস পর্যন্ত কু ইউয়ান শহরে মোট ২৪৫ বার চার্টার গাড়ি ও বিমান ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। ফুচিয়ান শহরে কু ইউয়ানের ১১৭৫জন শ্রমিক এমন সেবার মাধ্যমে কাজ করা শুরু করেছেন।
ঋণ দ্রুত ফেরত দেওয়ার জন্য জিন সু সু তিল তিল করে অর্থ সঞ্চয় করেন। তিনি এক বোতল পানিও কিনতে চান না। তিনি বলেন, আমি আমার বেতন সাশ্রয় করবো, বছর শেষে টাকা বাসায় নিয়ে যাবো, ঋণ ফেরত দেওয়ার পর আমি একটি ছোট গাড়িও কিনবো। তিনি আরো বলেন, মনে 'মিষ্টি' কোনও উদ্দেশ্য থাকলে জীবন 'তিক্ত মনে হবে না।
পরবর্তীতে, চীনের বিভিন্ন স্থানের 'দরিদ্র মানুষদের শহরে গিয়ে কাজ করা', 'গণকল্যাণমূলক কর্মসংস্থান দেওয়া', 'নিজেই ব্যবসা করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার' মাধ্যমে শ্রমিকের ওপর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত, চীনের ২৫টি প্রদেশে ২ কোটিরও বেশি দরিদ্র মানুষ নিজ প্রদেশের বাইরে গিয়ে চাকরি করা শুরু হয়েছে। এটি গত বছরের মোট সংখ্যার ৮৬.২১ শতাংশ। যা গত ৬ মার্চের চেয়ে ৩৪.১৮ শতাংশ বেশি।
২. মনে সংকল্প থাকলে কঠিনতাকে জয় করা যায়
ভোরের ছিনবা পাহাড়ি এলাকায়। সবেমাত্র সূর্য উঠেছে। সবখানে উষ্ণ সোনালী সূর্যের আলো। ৫৮ বছর বয়সী চাং সি নিজের মশলা (Zanthoxylum bungeanum) ক্ষেতে কাজ করছেন। তিনি মশলা (Zanthoxylum bungeanum) দেখে যেন নিজের সন্তানকে দেখার মতো অনুভূতি হয়। তিনি বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
হ্যনান প্রদেশের সান মেন সিয়া শহরের সি শান তি গ্রামের অধিবাসী চাং সির পরিবার খুব দরিদ্র। তার স্ত্রী প্রতিবন্ধী, নিজের যত্ন নিতে পারে না। তার বড় ছেলে মানসিক রোগে আক্রান্ত। তার ছোট ছেলের বয়স মাত্র ২০ বছর। এখন তিনি অন্য শহরে কাজ করছে। তার পরিবারের পুরো বছরে আয় শুধু ১০ হাজার ইউয়ান! তাদের ওষুধের ফি ও খাওয়া-দাওয়ার জন্য এ অর্থ যথেষ্ট নয়!
দরিদ্রতার কারণে আগে চাং সি খুব হতাশ হয়ে পড়েন। আগে গ্রামের কর্মকর্তা তাকে দারিদ্র্যবিমোচনের কথা জানিয়েছিলেন, তবে চাং সি এজন্য কোনো চেষ্টা করেন নি। তিনি বলেন, এত সহজেই দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারবো? আমার কোনো সামর্থ্য নেই, আমি কিছুই পারি না, আমি দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারবো না। এটা ছিল আগে চাং সি'র মনের কথা।
পরিবর্তন শুরু হয় ২০১৬ সালে। তার গ্রামে মশলা (Zanthoxylum bungeanum) চাষ করা দারিদ্র্যবিমোচনের প্রধান শিল্প হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার সাহায্য করবে, ঋণ দেবে, প্রযুক্তিও শেখাবে। দেখতে দেখতে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এতে অংশ নেয়। চাং সি এই শিল্প যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গত বছর ছিল চাং সি'র মশলা (Zanthoxylum bungeanum) চাষের প্রথম বছর। এই প্রথম বছর তার ১৩ হাজার ইউয়ান আয় হয়েছে। বসন্ত উৎসবের আগে তিনি বড় একটি রেফ্রিজারেটর কিনেন। এতে পুরো পরিবার খুব আনন্দদায়ক এক বসন্ত উৎসব কাটায়।
চাং সি'র মতে বর্তমানে নিবন্ধিত দরিদ্র মানুষের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মানুষই প্রধানত বাইরে গিয়ে কাজ করা এবং শিল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করেছেন। তবে করোনাভাইরাস তাদের জীবনের ওপরও প্রভাব ফেলেছে।
করোনাভাইরাসের সৃষ্টি প্রাদুর্ভাব দূর করতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নির্দেশনা দিয়েছেন: দারিদ্র্যবিমোচন শিল্প পুনরুদ্ধারকে সমর্থন দিতে হবে, ক্ষুদ্র ঋণ নীতি ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, দারিদ্র্যবিমোচন শিল্পের টেকসই উন্নয়ন জোরদার করতে হবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে, গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন কর্মকর্তা চাং সি'র জন্য বসন্তকালের কৃষিকাজ উপলক্ষ্যে ঋণের ব্যবস্থা করেন। তার ছোট ছেলেকে বাসার কাছাকাছি একটি চাকরি খুঁজে দেন।
সরকারের সাহায্যে, নিজের পরিশ্রমে, চাং সি ভবিষ্যত্ জীবন সম্বন্ধে খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, চলতি বছর আমার পরিবার নিশ্চয় দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারবে। বসন্ত উৎসবের সময় আমি গ্রামের কর্মকর্তাদের আমার বাসায় খাবার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবো।
৩. নিজেই ব্যবসা করে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়া
বসন্তের উষ্ণ সূর্যের আলোয়, চীনের ইয়ুন নান প্রদেশের কুয়াং নান জেলার ইউয়ান মেং কমিউনিটিতে, ইয়াং জিন রেন নিজের সূচিকর্ম দোকানে বসে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আগে তিনি শুধু কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করে জীবনযাপন করতেন; এখন তিনি নিজেই একটি দোকান খুলে নিজেই মালিক হয়েছেন।
ইয়ান জিন রেনের বাড়ি কুয়াং নান জেলা হলো ইয়ুন নানের চরম দরিদ্র একটি জেলা। তার পরিবার পাহাড়ের গভীরে বাস করে। গ্রামে যাওয়ার জন্য শুধু একটি মাটির পথ রয়েছে।
গ্রামে কোনও সড়ক ছিল না। দারিদ্র্য যেন সবার সামনের একটি বড় পাহাড়ের মত, যা অতিক্রম করা যায় না! তবে ইয়াং চিন রেন জীবনের কাছে হার মানতে রাজি না। তিনি দারিদ্র্যের বিরাট পাহাড় অতিক্রম করতে চান। তার জীবনের পরিবর্তন ঘটে ২০১৮ সালে। দারিদ্র্যমুক্তকরণের লক্ষ্যে তার পরিবারকে স্থানান্তরের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
এরপর দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তাকে বাইরে স্থানান্তর করা হয়। দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির সহায়তায় ইয়াং জিন রেন একটি মিয়াও জাতির সূচিকর্মের দোকান চালু করেন। গত বছরের শেষ নাগাদ তাঁর দোকানে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়। প্রথম দিনেই তিনি ১.৮ লাখ ইউয়ানের সূচিকর্ম বিক্রি করেন। প্রতিবেশী জেলার লোকজনও তার দোকানে ছুটে আসে।
তবে আকস্মিক করোনাভাইরাসের কারণে দোকানের ব্যবসা অনেক কমে যায়। ইয়ান জিন রেন এজন্য খুব দুঃখ পান।
সূচিকর্মের অর্ডার কমেছে। এ সময় নিজের কাজ উন্নয়নে তিনি ভালো প্রশিক্ষণ নেন। ইয়াং জিন রেন এ সময় জেলার সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ ক্লাস গ্রহণ করেন, অনেক কিছুই তিনি শিখতে পারেন।
ইয়াং জিন রেন বলেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট সি বলেন, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হওয়া চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়; বরং তা নতুন জীবনের সূচনা।
নিজেই ব্যবসা করার ছাড়া ইয়াং জিন রেন আশেপাশের দরিদ্র মানুষদের নিয়ে একসাথে কাজ শুরু করেন। তার পরিকল্পনা, পরবর্তীতে জেলার আরো বেশি দরিদ্র মানুষ তার ব্যবসায় অংশ নিতে পারবে, দরিদ্র নারীরা বাসায় বসে পয়সা উপার্জন করতে পারবে।
৪. সুপেয় পানি এসেছে, রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে
এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সিন চিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কুলিসুমুহা'র রেস্তোরাঁর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, ভাইরাস শেষ হলে আমাদের এখানে ভ্রমণকারী পর্যটক বেশি হবে, আমার রেস্তোরাঁ ব্যবসাও ভালো হবে।
তার রেস্তোরাঁ সিন চিয়াং-এর ছ্য ল্য জেলায় অবস্থিত। এটি সিন চিয়াং-এর চরম দরিদ্র এলাকা। জেলায় ছ্য ল্য নদী হলো স্থানীয় লোকজন ও পশুর পানীয় জলের একমাত্র উৎস। নদীর উপর দিকে হল পশুর খামার। তাই এই নদীর পানি বেশিরভাগ সময় খুব নোংরা থাকত। শিশুরা এ পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ত।
২০১৭ সালে গ্রামে প্রথম কুয়া খনন করা হয়। এভাবে সুপেয় ও পরিষ্কার পানি পাওয়া যায়। কুলিসুমাহার জন্যও সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৮ সালে তার রেস্তোরাঁ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
পানি, অনেক চরম দরিদ্র এলাকার 'দরিদ্রতার'-এর মূল কারণ।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, অব্যাহতভাবে চরম দরিদ্র এলাকার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, দারিদ্র্যমুক্তকরণের প্রস্তাব ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ছ্য ল্য জেলার কর্মকর্তা জানান, পরবর্তীতে দারিদ্র্যবিমোচন শিল্প পুনরুদ্ধারের কাজ করা হবে। সুপেয় পানির নিরাপত্তা, সড়ক, বিদ্যুত্ ও টেলিযোগাযোগ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান করতে হবে।
কুলিসুমুহা দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার জন্য খুব আস্থাবান। তিনি বলেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত, আমার রেস্তোরাঁয় শুধু ১২ ইউয়ান মূল্যের নুডলস বিক্রি হত। এতে ১০ হাজারেরও বেশি ইউয়ান মুনাফা হয় তার। চলতি বছর আমরা আরো চেষ্টা করবো।