পূর্বাভাস অনুযায়ী দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে দেশের করোনা পরিস্থিতি। গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় দেশে। মার্চ মাসে মোট করোনা শনাক্ত ছিল ৫১ জন। এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬১৬ জনে। আর মে মাসের প্রথম তিন দিনে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৮৮ জনে। অর্থাৎ ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী করোনা শনাক্তের হার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মে মাসে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। মৃত্যু হতে পারে ৮০০ থেকে ১ হাজার জনের। আর সংক্রমণ তীব্র হলে এ সংখ্যা দ্বিগুণে দাঁড়াতে পারে অর্থাৎ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে আর মারা যেতে পারে ২ হাজার মানুষ।
যদিও এখনো সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলছে এবং ছুটি বাড়ানো হচ্ছে ১৬ মে পর্যন্ত। ধারনা করা হচ্ছে চলতি মাসের শেষ দিকে রোজার ঈদ পর্যন্ত এ ছুটি বাড়ানো হবে-অর্থাৎ ঈদের আগে পর্যন্ত অঘোষিত লকডাউন বহাল থাকতে পারে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ঢিলেঢালা এ লকডাউন করোনার বিস্তার কতটা ঠেকাতে পারছে। রাজধানীসহ সারাদেশে বহু জায়গায় মানুষ শুরু থেকেই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ঠিকভাবে মানেনি। রোজা শুরুর পর থেকে তা আরও শিথিল হয়েছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কারখানা সীমিত আকারে চালু হয়েছে। অন্য দোকানপাট বন্ধ থাকলেও ইফতার বিক্রির জন্য রেস্টুরেন্ট চালু হয়েছে। পাড়া-মহল্লার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানপাট ও কাঁচাবাজারে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। রস্তাঘাটে ব্যক্তিগত গাড়ি, রিক্সা-সিএনজি চলাচল শুরু করেছে প্রভূত পরিমাণে।
অথচ বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন মে মাসটা বাংলাদেশে করোনার জন্য মারাত্মক ঝুঁকির। একদিকে করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। গড়ে ৫ হাজার টেস্ট করতেই হিমশিম খাচ্ছে আইইডিসিআরসহ ৩১টি ল্যাব। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে যেখানে পরীক্ষাই করা যাচ্ছে না সেক্ষেত্রে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা না মানার ফলে যদি করোনা সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন পরিণতি কী হবে!
এ পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ৪৫৫ জন। এর মধ্যে দেখা গেছে ৪ শতাধিক ডাক্তার ও ২ শতাধকি নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ৮৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ সদস্য। ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ সদস্যদের বেশি হারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ পেশাগত কারণে তারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানতে পারেননি অনেক সময়। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামের ঘাটতি তো রয়েছেই। এর অর্থ আপনি যতটা বিচ্ছিন্ন থাকবেন আপনার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ততটাই কম। আর আপনি যত বেশি জনসমক্ষে আসবেন আপনার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি। আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ বলছেন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় যে ঢিলেঢালা ভাব এসেছে তাতে সমূহ বিপদে পড়তে পারে গোটা দেশ। তিনি কঠোরভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন।
এতসব খারাপ খবরের মধ্যে একটি ভালো সংবাদ হচ্ছে করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার জরুরি ভিত্তিতে ২ হাজার চিকিৎসক ও ৫ হাজার নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবেলায় ডাক্তার-নার্সের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া জরুরি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দরকার ১ লাখ ২৮ হাজার জন। কিন্তু বাংলাদেশে এ পদই আছে মাত্রা ৭ হাজার ৯২০টি। আর নিয়োগপ্রাপ্ত মাত্র ৫ হাজার ১৮৪ জন। অর্থাৎ
প্রয়োজন আর বিদ্যমান অবস্থায় আকাশপাতাল ফারাক। তাই করোনা মোকাবেলায় জরুরিভিত্তি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিকল্প নেই।
করোনা নিয়ে আরেকটি ভালো খবর দিয়েছে সিঙ্গাপুরের একটি গবেষণা। দেশটির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, মে'র মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯৯ ভাগ করোনা বিদায় নেবে। খবরটি খুবই আশাব্যাঞ্জক। তবে একে খুব গুরুত্ব দিতে রাজি নন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শই দিয়েছেন।
করোনা নিয়ে সবচেয়ে ভালো খবরটি হচ্ছে বন্ধুপ্রতীম চীন থেকে বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তার-নার্সদের দুটি দল আসছে বাংলাদেশে। প্রথম দলে চীনের চারজন বিশেষজ্ঞ আসছেন বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলায় সহায়তা করতে। তারা আইইডিসিআরসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করবেন। পরবর্তীতে চীনের ডাক্তার ও নার্সদের আরেকটি দল ঢাকা আসবে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান এবং ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি চি মিং বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তবে সব কিছুর আগে হচ্ছে দেশের মানুষের সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলা। তবেই করোনাযুদ্ধ জয় অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বাংলাদেশের জন্য।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।