উহান শহরে মহামারী প্রতিরোধে বিভিন্ন মানুষ ও ঘটনা
  2020-04-22 15:39:43  cri

 

সবাই জানেন, আলোছায়া অনুষ্ঠানে আমরা বরাবরই চলচ্চিত্র, টিভি নাটক বা তথ্যচিত্রের গল্প নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হই। এসব গল্পের মধ্যে কোনো কোনোটি মনোমুগ্ধকর; কোনোটি আবার মজাদার, কোনোটি বেদনাদায়ক। আজকের অনুষ্ঠানেও আমরা যেসব গল্পের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো, সেসব গল্প আমাদের আশেপাশেই ঘটেছে। অনেকে হয়তো ইতোমধ্যে জানতে পেরেছেন যে, মহামারী প্রতিরোধে চীন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সাফল্য অর্জন করেছে। তবে আমি বলতে চাই, এই বিজয়ের পিছনে রয়েছে এক একজনের পরিশ্রম ও অসামান্য ত্যাগ স্বীকারের ঘটনা।

প্রথমে আমরা একটি ট্রেন টিকিটের ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।

কুয়াংচৌ থেকে উহান পর্যন্ত এই টিকিট কাটা হয় ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি। টিকিটের দাম ৪৬৫.৫ ইউয়ান। টিকিটের আইডি নম্বর থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এই টিকিট কেনা যাত্রীর বয়স ৮৪ বছর!

হ্যাঁ,১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাকাডেমির অ্যাকাডেমিশিয়ান চোং নান শান এই টিকিট নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে উহান শহরে পৌঁছান। যারা চীনের মহামারী প্রতিরোধ অবস্থার ওপর গভীর নজর রেখেছিলেন, তারা নিশ্চয়ই চোং নান শানের নামের সঙ্গে সুপরিচিত।

উহানে পৌঁছানোর দু'দিন পর তিনি চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশনে বলেন, 'এই ভাইরাস নিঃসন্দেহে মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই খুব প্রয়োজন না হলে উহান শহরে যাবেন না।'

নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চীনের এই কঠোর লড়াই তখন থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

পরে চোং নান শান স্বীকার করেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া আসলেই ছিলো খুব বিপজ্জনক সংকেত। তাই আমি ভাবলাম, আমাকে এই বাস্তবতা সরকার ও জনগণকে জানাতেই হবে।

১৮ জানুয়ারি চোং নান শান উহান শহরে পৌঁছান। ২০ জানুয়ারি এ ভাইরাসে মানুষের মধ্যে ছড়ানোর কথা ঘোষণা করা হয়। এরপর ২৩ জানুয়ারি উহান শহর লকডাউন করা হয়।

বিজ্ঞানসম্মত তথ্য অনুযায়ী, যদি উহান শহরে আরো ৫ দিন পর লকডাউন করা হতো, তাহলে চীনের সংক্রমণের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যেতো।

ভাইরাস বিস্তার ও জীবন রক্ষা

এখন আমরা চাও ইং মিং নামে একজন নার্সের গল্প বলতে চাই।

২৮ জানুয়ারি সিছুয়ান প্রদেশের চিকিত্সকদল উহান শহরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। চাও ইং মিং নামে এক নার্স এই চিকিত্সকদের দলে রয়েছেন।

চাও ইং মিংয়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তার স্বামী অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েন। স্ত্রীর বাসে ওঠার পর তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিত্কার করে বলেন, চাও ইং মিং, নিরাপদে ফিরে এসো। তুমি নিরাপদে ফিরে এলে আমি সারা বছর ঘরের সব কাজ করবো। তুমি শুনেছো?

এই ভিডিও চীনের ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ এতে মুগ্ধ হয়। 'আমি সারা বছরের ঘরের কাজ করবো' স্বামীর এই কথাকে সবচে সুন্দর ভালোবাসার কথা হিসেবে গণ্য করা হয়।

এরপর, ২০ মার্চ চাও ইং মিং বাসায় ফিরে আসেন।

নেট ব্যবহারকারীরা এ ভিডিওর পর তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন, চিন্তার কোরো না, তোমার স্ত্রী অবশ্যই ফিরে আসবে। সারা বছরের গৃহকর্ম করার জন্য প্রস্তুতি নাও। নিজের প্রতিশ্রুতি মনে চলতে হবে। কারণ, সব চীনারা তোমার কথা মনে রেখেছে। এ বিষয়টি নিয়ে চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন বা সিসিটিভি বিশেষ করে একটি ছবিও তৈরি করে। ছবিতে লেখা হয়, চাও ইং মিংয়ের স্বামী, নেট ব্যবহারকারীদের তত্ত্বাবধানে তুমি সারা বছর ঘরের কাজ করবে।

চাও ইং মিংয়ের স্বামীও স্পষ্টভাবে জানান, তার স্ত্রীর নিরাপদে ফিরে আসাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর ঘরের কাজ করলে তিনি সুখী হবেন।

বর্তমানে চাও ইং মিং নিরাপদে জন্মস্থান বা সিছুয়ান প্রদেশের কুয়াং ইুয়েনে ফিরে গিয়েছেন। নেটব্যবহারকারীদের তত্ত্বাবধানে স্বামী গৃহকাজও করছেন। তা ছাড়া, তারা ইন্টারনেটে লাইভ সম্প্রচারও চালু করেছেন এবং তাদের সাম্প্রতিক অবস্থা সবার সঙ্গে শেয়ার করছেন। লাইভ প্রচারের সময় তারা অনেক নেটব্যবহারকারীর প্রশংসা পেয়েছেন। নেট ব্যবহারকারীরা এই দম্পতিকে ৮শ'রও বেশি ইউয়ান মূল্যের পুরস্কার দিয়েছে। এ সব টাকা দিয়ে চাল ও তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনী সামগ্রী কিনেছেন তারা। তারপর তারা স্থানীয় দরিদ্র বয়স্কদের তা পাঠিয়েছেন। চাও ইং মিং বলেন, এটি হলো আমার সদিচ্ছা। আমি সবার মঙ্গল কামনার জবাব দিতে চাই। আমি এ পদ্ধতিতে অন্য মানুষকে সাহায্য করতে চাই। নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় চাও ইং মিংয়ের স্বামী বলেন, পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দ অনেক বেশি এবং গ্রহণের চেয়ে দানের প্রশান্তিতে মন ভরে ওঠে।

এবার আরেকটি মজার গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো।

১২ ফেব্রুয়ারি উত্তর পূর্ব চীনের একজন তরুণ ছাংশা শহরে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে কিছু প্রকল্পের চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে ট্রেনে তিনি ভুল করে অন্য জায়গা থেকে উহানে ফিরে যাওয়া জনগণের বিশেষ বগিতে ওঠেন।

যখন ট্রেন উহান শহরের স্টেশনে পৌঁছায়, তখন ট্রেনের লোক তাকে জানায় যে, এই বগির সব মানুষকে নামাতে হবে।

কোনো উপায় না দেখে তিনি অন্যান্য মানুষের সঙ্গে ট্রেন থেকে নামেন। তবে নামার পর তিনি বোকা হয়ে যান। উহানে তখন বিশেষ সময়। উহানে কোনো ট্যাক্সি নেই, কোনো হোটেলে থাকা যায় না। সেখানে খাবার সংগ্রহ করে খাওয়াই বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। সে সময় উহান শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। অবশেষে তিনি একটি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাকরি খুঁজে পান। এরপর সেলফোন গেমসে চাকরির সঙ্গে জড়িত সেই তরুণ রাতারাতি উহানের প্রথম হাসপাতালের আইসোলেশন এলাকায় একজন পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে মহামারী প্রতিরোধের ফ্রন্ট-লাইনে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রতিরোধমূলক কাপড় পরে আইসোলেশন এলাকার মেঝে ম্যাপিং করেন, জীবাণুমুক্ত করেন এবং আবর্জনা সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন তিনি ১২ ঘণ্টা কাজ করেন এবং প্রতিদিন ৫০০ ইউয়ান রেনমিনপি বেতন পান। পরিবারের সদস্যদের চিন্তামুক্ত রাখতে তিনি তার এ কথা জানান নি। তারা বাবা মা ভেবেছিলেন, নিজের ছেলে অন্যদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনা করতে ছাংশা শহরে গিয়েছে এবং সেখানেই আছে।

এসব লোকের প্রকৃত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা উহান শহরে লকডাউনের পিছনের অনেক গল্প জানতে পারি। লকডাউন খুবই সহজ শব্দ। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে অনেক মানুষের পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকারের ঘটনা। সময় প্রমাণ করেছে যে, লকডাউন ছিলো চীনাদের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।

চোং নান শান কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, সারা দেশে লকডাউনের মাধ্যমে রোগের বিশাল বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়েছে। লকডাউনের ব্যবস্থা না নিলে উহানের মতো কয়েকটি শহরে একইসঙ্গে মহামারীর প্রকোপ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে ৪০ হাজারেরও বেশি চিকিত্সকদের নিয়ে গঠিত গ্রুপের উহান শহরে সাহায্য করাও সম্ভব হতো না।

এখন উহান শহরসহ সারা চীনে জনগণের জীবন ও উত্পাদন দিন দিন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এ মহামারীর সময় যে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের ধারণা ও পর্যালোচনা করতে হবে। এ বিপর্যয় অবশ্যই একদিন শেষ হবে। কিন্তু আমরা জানি না, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আর কী অপেক্ষা করছে! আরও নতুন বা ভয়ঙ্কর ভাইরাস কি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে কিনা!

আশা করি, নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের মানুষের একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্ব আমরা বুঝতে পেরেছি। আর এভাবেই আমরা অজানা ভবিষ্যতের বিভিন্ন বিপদ মোকাবিলা করতে পারব এবং জয়ী হবো।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040