১৫ এপ্রিল সকাল ১০টা, উহান লেই শেন শান হাসপাতাল বন্ধ হবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এক দিন আগে এ হাসপাতালের আইসিইউ-র শেষ ৪ জন রোগী অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার জন্য নির্মিত এ হাসপাতালে গত দু'মাসে মোট ২০১১ জন রোগী ভর্তি করা হয় এবং ১৯০০ জনের বেশি রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। লেই শেন শানসহ গুরুতর রোগী ভর্তি করা হয়েছে—এমন সকল বিশেষ হাসপাতাল পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হয় এবং উহানে মহামারি মোকাবিলায় আসে সাফল্য।
মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গুরুতর রোগীদেরকে চিকিত্সা দেয়ার কাজকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ১০ হাজারের বেশি গুরুতর রোগী ছিলেন এবং ১৪ এপ্রিল এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫৭ জনে। ৮৯ শতাংশের বেশি গুরুতর রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন। একটি প্রাণও যাতে বিনা চেষ্টায় ঝরে না-পড়ে—সেইটাই ছিল লক্ষ্য। ১০৮ বছর বয়সী প্রবীণ ও ৩০ ঘন্টার নবজাতক বাচ্চা—সবার প্রাণ বাঁচানোকে দেওয়া হয় সমান গুরুত্ব। উ হানে কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে আরোগ্যের হার ৯৪ শতাংশ এবং ৮০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী রোগীদের মধ্যে আরোগ্যের হার প্রায় ৭০ শতাংশ।
লেই শেন শান হাসপাতাল বন্ধ হবার পর, উ হানে বাইরে থেকে আসা চিকিত্সকরা উ হান ছেড়ে বেইজিংয়ে ফিরে যান। ১৮০ জন মেডিকেল স্টাফ নিয়ে গঠিত এ সহায়তাদল গুরুতর রোগীদের চিকিত্সা দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। তাই তারা উ হান থেকে সবার পরে গিয়েছেন।
২০ জানুযারি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকে প্রথম স্থানে রাখার নির্দেশ দেন এবং ২৯ জানুয়ারি সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির একটি পরিচালনা কর্মদল উ হানে নিযুক্ত করা হয়। গুরুতর রোগীকে বাঁচানো মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন একটি কর্তব্য।
সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালনা কর্মদল উহানে আসার দিন, একজন নারী তার স্বামীর ৮৪ বছর বয়সী মা-কে নিয়ে হাসপাতালে আসেন। তখন এ প্রবীণের জ্বর হয়েছিলেন এবং তার উচ্চ রক্তচাপ এবং করোনারি হার্ট ডিজিজ ছিল। এ প্রবীণ কোভিড-১৯ গুরুতর রোগীদের মধ্যে একজন। মহামারি উহানে শুরু হয়, তাই এখানে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং ভাইরাস খুব শক্তিশালী বলে মৃত্যুর হারও উচ্চ। ফুসফুস ছাড়া, অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ওপর আঘাত হানে এ ভাইরাস। কোন কোন রোগী হয়তো খেতে পারছেন, কথা বলতে পারছেন---কিন্তু আকস্মিকভাবে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। পাশাপাশি অনেকের অন্য রোগ আছে বলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে তাদের বিভিন্ন অঙ্গের ফাংশনের অবনতি ঘটে। এ হচ্ছে কোভিড-১৯ গুরুতর রোগীর বৈশিষ্ট্য।
তা ছাড়া, মহামারির শুরুতে উহানে দেখা যায় চিকিত্সাসম্পদের অভাব। জ্বর বিভাগে একদিনে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আসে এবং তখন সারা উহানে গুরুতর রোগীর জন্য বিছানার সংখ্যা ছিল মাত্র ১ হাজার।
বিছানা, মেডিকেল স্টাফ, সরঞ্জাম—সবকিছুর অভাব। এমন প্রেক্ষাপটে, চীনে বৃহত্তম আকারের একটি চিকিসা সহায়তা কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
সশস্ত্রবাহিনী ও চীনের অন্য প্রদেশ থেকে এসেছেন ৪২ হাজারের বেশি মিডিকেল স্টাফ নিয়ে গঠিত ৩৪০টির বেশি চিকিত্সা সহায়তা দল। এর মধ্যে সবচেয়ে ভাল ও শ্রেষ্ঠ ডাক্তাররা বিশেষ করে গুরুতর রোগীদেরকে চিকিত্সা দেন। হু শেন শান ও লেই শেন শানসহ নতুন হাসপাতাল দ্রুত নির্মিত হয় এবং আরও ১১ হাজারটি নতুন বিছানা তৈরি হয়।
২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টা, উ হান থং চি হাসপাতালে একজন ৫০ বছর বয়সী রোগী ইসিএমও সরঞ্জামের সাহায্যে বেঁচে থাকেন। দুর্বল হলেও তিনি ধন্যবাদ শব্দটি উচ্চারণ করতে চান। তাকে ১৯ দিনে মোট ৪৫৬ ঘন্টা আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে চিকিত্সকরা বলতে গেলে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনেন।
ইসিএমও, আইসিইউতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সরঞ্জাম এবং বিশ্বব্যাপী মাত্র ১০০০টি এমন যন্ত্র আছে। উ হানের গুরুতর রোগী উদ্ধারের জন্য হু পেই প্রদেশে ১০০টি এসিএমও পাঠানো হয়। গুরুতর রোগীদের চিকিত্সা দেয়ার সময়ে সবার মনে এমন একটি কথা ঘুরপাক খায়: যতক্ষণ আশা আছে, ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রত্যেক গুরুতর রোগীর চিকিত্সা-খরচ দেড় লাখ ইউয়ান এবং কোন কোন রোগীর চিকিত্সা-খরচ ১০ লাখ ইউয়ানের বেশি। তবে এ খরচ সব বীমার মাধ্যমে কভার করা হয়েছে। এর মানে রোগীকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।
হুপেই প্রদেশে মোট ৩৬০০ জনের বেশি ৮০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী প্রবীণ রোগী সুস্থ হয়েছেন এবং উ হান শহরে ৮০ বছর বয়সী প্রবীণদের আরোগ্যের হার প্রায় ৭০ শতাংশ।
৭৪ বছর বয়সী একজন নারী রোগী থং চি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর ৬ দিন পরে তার অবস্থা ভাল হয়ে ওঠে। প্রথম দিনে প্রতি মিনিটে তার পাল্স ছিল মাত্র ২৮ এবং তার জীবন ঝুলে ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এ প্রবীণকে চিকিত্সা দেয়ার জন্য নানা বিভাগের বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত হয় একটি চিকিত্সা গ্রুপ। নানা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা আলোচনার মাধ্যমে চিকিত্সা পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা গুরুতর রোগীদের চিকিত্সায় সাধারণ একটি পদ্ধতিতে পরিণত হয়।
বিভিন্ন প্রদেশের চিকিত্সা সহায়তা দল থং চি হাসপাতালে প্রতিদিন দু'বারের মতো মিটিং করতেন। সকাল ৮টায়, তারা আসিইউতে শিফট পরিবর্তন করেন এবং পাশাপাশি মিটিং করেন। বিকেল ৩টায় কঠিন কেস নিয়ে আবার আলোচনা করে নতুন চিকিত্সার উপায় খুঁজে পেতে প্রচেষ্টা চালাতেন তারা।
থং চি হাসপাতালে ১৭টি সহায়তা চিকিত্সাদলের কর্মী ছিলেন। তারা আলোচনার মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ডাইজড চিকিত্সা পরিকল্পনা বের করেন।
উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের জং নানা হাসপাতালের গুরুতর বিভাগের চিকিত্সক ইয়াং সিয়াও বলেন, জানুয়ারি মাসে তিনি প্রথমবারের মতো আইসিইউতে গুরুতর রোগী দেখেন এবং তখন কেউ জানতেন না কীভাবে এ ধরনের রোগীকে চিকিত্সা দিতে হবে।
১৬ জানুয়ারি, চীনা জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন প্রকাশ করে কোভিড-১৯ রোগের চিকিত্সা পরিকল্পনার প্রথম সংস্করণ। এ পরিকল্পনা দেখে আশ্বস্ত হন ইয়াং সিয়াও। বর্তমানে এ পরিকল্পনার সপ্তম সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে এবং এ রোগের সম্পর্কে আরও বেশি জানা সম্ভব হয়েছে।
তা ছাড়া, পাশ্চাত্য চিকিত্সা পদ্ধতি ও চীনা ঐতিহ্যিক চিকিত্সা পদ্ধতিন সমন্বয়ে গুরুতর রোগীদেরকে চিকিত্সা দেয়াও এবার নতুন একটি আবিষ্কার। ৯০ শতাংশের বেশি গুরুতর রোগী দু'ধরনের চিকিত্সা গ্রহণ করেছেন। পরিকল্পনা পরিবর্তনের ভিত্তি হল হাজার হাজার ক্লিনিকল অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা। চিকিত্সকরা দিন-রাত গবেষণা করেছেন এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন।
থং চি হাসপাতালের চিকিত্সক লিউ লিয়াং প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির দেহ-ব্যবচ্ছেদ করেন। এর মাধ্যমে আরও দ্রুত ও সরাসরীভাবে রোগবিদ্যার মাধ্যমে এ রোগের চিকিত্সায় সাহায্য দেওয়া সম্ভব হয়।
ফ্রন্টলাইনের মিডিকেল স্টাফদের মধ্যে অনেকে সিপিসির সদস্য। তারা প্রতিরক্ষামূলক পোশাকের ওপর লাগানো একটি পার্টির প্রতীকের স্টিকার ব্যবহার করতেন। তারা রোগীদেরকে জানাতে চান যে, সব অবস্থায় তারা তাদের সঙ্গে থাকবেন। পাবলিক হাসপাতাল এবার চিকিত্সায় মূল অংশ হিসেবে ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় হাসপাতাল ২৪ ঘন্টার মধ্যে সহায়তা দল গঠন করে এবং এ দল ২৪ ঘন্টার মধ্যে উহানে পৌঁছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে যারা কাজ করেন তারা সব পাবলিক হাসপাতালের কর্মী।
গুরুতর রোগীদের চিকিত্সার জন্য মৃত্যুর কেস নিয়ে আলোচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। আলোচনার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় এবং পরবর্তী রোগীর চিকিত্সার জন্য দিক্-নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।
এখনও উহানে গুরুতর রোগীদের কয়েকজনের চিকিত্সাকাজ চলছে। হু পেই প্রদেশে ১৪ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ২৪ জনের অবস্থা গুরুতর এবং ৩৩ জনের অবস্থা জরুরি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদেরকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা চালাবেন ডাক্তাররা। (শিশির/আলিম/রুবি)