'শীতের পর বসন্তকাল, ২০২০ সালে মহামারীতে চীন'
  2020-04-16 14:34:02  cri

প্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তিন পর্বে তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো।

এ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকারী দল চীনে মহামারী চলাকালে উহান শহরে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন রেকর্ড করেছে।

চীনের বিখ্যাত তারকা সুই ফান এ প্রামাণ্যচিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। উহান তার জন্মস্থান। জন্মস্থানের প্রতি গভীর অনুভূতি নিয়ে অত্যন্ত স্নেহময় কণ্ঠে লকডাউন হওয়ার পর উহান শহরের বিভিন্ন গল্প বলেছেন তিনি।

প্রামাণ্যচিত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে দারুণ কোনও ঘটনা যোগ করা হয়নি, ইচ্ছাকৃতভাবে বেদনার দৃশ্যও যোগ করা হয়নি। এতে আন্তরিকতার সঙ্গে সাধারণ লোকের দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ মানুষের জীবন রেকর্ড করা হয়।

তাই এ চলচ্চিত্র অনেক শক্তিশালী ও উত্সাহব্যাঞ্জক।

মহামারীর প্রকোপের সময় আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা নিশ্চয়ই বলা উচিত। মহামারীর সময় হুপেই প্রদেশে কমপক্ষে মোট ৫ লাখ স্বাস্থ্যকর্মী ফ্রন্টলাইনে কাজ করেছিলেন।

৫৯ বছর বয়সী সুই লুই ইয়েন তাদের মধ্যে একজন চিকিত্সক।

২০০৩ সালে সার্স প্রতিরোধের সময় তিনি কাজের চাপে ভালোভাবে বাবার যত্ন না নেওয়ায় তার বাবা চিকিত্সার সবচেয়ে ভালো সময় বধির হয়ে পড়েন।

এবারের নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবের সময় তিনি কোনো দ্বিধা না করে হাসপাতালে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

অন্যরা তার উত্সর্গ দেখে দুঃখ অনুভব করে। তবে তিনি সেজন্য কখনও অনুতাপ করেন নি। 'আমি চিকিত্সকের কাজ করি'-- তিনি এভাবেই যুক্তি দেন। তার কাছে কাজের জন্য পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করা খুব সাধারণ ব্যাপার। তিনি শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মনে করেন যে, যদি আপনি চিকিত্সকের কাজ করতেন, তাহলে আপনি আমার মতোই করতেন, তাই না ?

কাজে নিয়োজিত থাকা তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাবিষয়ক অধ্যয়নের সময় তার শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা হলো চিকিত্সকের দায়িত্ব। এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তিনি এই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তাও করেন নি।

সুই লু ইয়ে বলেন, তার সঙ্গে তারই মতো আরো অনেক চিকিত্সক আছে, তার মতো একই চিন্তা-ভাবনা পোষণ করে থাকেন।

তারা মনে করেন, যেখানে রোগী আছে, সেখানে তাদেরকে হাজির হতেই হবে।

প্রামাণ্যচিত্রে অনেক চিকিত্সক বলেন, যদি আপনি চিকিৎসকের কাজ করেন, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, আমাদের কত বিরাট চাপ সহ্য করতে হয়। মৃত্যু এক মুহূর্তের মধ্যে, যে কোনও সময় হানা দিতে পারে। প্রতিদিন আমরা এমন অবস্থার মুখোমুখি হই।

মহামারী প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সময় একদিকে চিকিত্সা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে খাবারও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

কোটিরও বেশি লোকসংখ্যার বড় শহর হিসেবে উহানবাসীকে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

আগে প্রতিদিনের ভোরে নাস্তা খাওয়ার জন্য উহান শহরের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বাসা থেকে বের হতো। তারা কাজে যাবার পথে বা দোকান থেকে খাবার কিনে খেত।

মহামারীর সময় ক্যাটারিং শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০ সালের বসন্ত উত্সবের সময় উহান শহরে ৯৮ শতাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করা খুব কঠিন।

মাত্র ২ শতাংশ রেস্তোরাঁ খোলা ছিল। এর মধ্যে রয়েছে পাংচি হট ট্রাই নুডলস।

এই রেস্তোরাঁর মালিক মহামারী প্রতিরোধের কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতাদের জন্য আগের মতোই দাম না বাড়িয়ে নাস্তা দিতে থাকেন। মহামারী আরও ভয়াবহ হওয়ার পর এই মালিক রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে বাধ্য হন। সে সময় উহানের রাস্তায় কেউ ছিল না। তবে উহান সঙ্গীহীন দ্বীপে পরিণত হয় নি। আশেপাশের লোক সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

অসম্পূর্ণ একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, হুপেই প্রদেশকে সাহায্য করা স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

তারা বিভিন্ন মহলে কাজ করেন। ফ্রন্টলাইনের স্বাস্থ্যকর্মী থেকে তৃণমূলের কমিউনিটির কর্মী পর্যন্ত, সবাই হুপেই প্রদেশকে সাহায্য দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছে।

যথাক্রমে ১০ দিন বা ১৪ দিনের মধ্যে হুওশেনশান ও লেইশেনশান হাসপাতাল তৈরি করে চিকিত্সাসেবা প্রদান করা হয়। উহানের প্রায় ২০টি বড় আকারের স্টেডিয়ামে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়। এসব বিস্ময়ের পিছনে রয়েছে এক একটি মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের গল্প।

অনেকেই কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে যারা প্রথম ফ্রন্টে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে কোনো কোনো লোক আক্রান্ত হন বা তাদের উপসর্গ দেখা দেয়। অনেক নির্মাণ শ্রমিক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা ধরে কাজ করেছেন। প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেও অনেকে সাহায্যের দলে যোগ দেন। তা ছাড়া, লাখ লাখ ডেলিভারি ম্যান শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন।

নিজের চাকরি করা অসংখ্য মানুষ ছাড়াও,আরো আছেন অনেক লোক,তারা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকেন। মহামারীর সময় বাসায় থাকা মানে দেশের জন্য অবদান রাখা বা নাগরিকের দায়িত্ব পালন করা; এটি হাসিঠাট্টার কোনও বিষয় নয়।

প্রামাণ্যচিত্রে আমরা দেখতে পাই যে,একই পরিবারের তিনজন একইসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের একে অপরের কাছ থেকে দূরত্ব মাত্র কয়েক মিটার। তবে তারা একে অপরের মুখ দেখতে পারেন না। তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে একজনের কথা আরেকজনকে পৌঁছে দেন। বাবা চিকিত্সককে বলেন, যত খরচ লাগুক না কেন,ছেলের চিকিত্সা করতেই হবে। ছেলে চিকিৎসকের মাধ্যমে বাবাকে উত্সাহ দেয়। তারা আশা করেন,অন্যজন প্রথমেই সুস্থ হয়ে উঠবেন।

কেউ কেউ বলেন,মহামারীর সময় উহান শহরে শুধু দু'ধরনের মানুষ ছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষ এবং তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করা মানুষ।

যাই হোক,এ দুই ধরণের মানুষই সাধারণ মানুষ। ঠিক যেন আমার পাশের তুমি, সে ও তারা। তারা কঠিন শীতকাল পার করেছেন এবং সুন্দর বসন্তকালকে স্বাগত জানিয়েছেন।

৭৬ দিন ধরে উহান শহরটি অস্থায়ীভাবে বন্ধ ছিল। এখন সেই শহর আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে।

২৫ মার্চ উহান শহরে মহামারীর ঝুঁকি মাঝারি পর্যায়ে নেমে আসে। উহান ছাড়া হুপেই প্রদেশের অন্য স্থানে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ৮ এপ্রিল উহান শহরের ওপর থেকে বের হওয়ার সব নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়। তার মানে মহামারীর বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে চীনের জনগণ ধাপে ধাপে সাফল্য অর্জন করেছে।

লিলি/তৌহিদ/শুয়ে

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040