স্থানীয় সময় ৮ এপ্রিল বিকেলে, চীনের শাংহাই ফু তান বিশ্ববিদ্যালয়ের হুয়া শান হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক চাং ওয়ে হং বাংলাদেশের চিকিত্সা মহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও সম্মেলনে মিলিত হন। অধ্যাপক চাং ওয়ে হং কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় প্রতিরোধ, ভাইরাস পরীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিত্সাসহ নানা পর্যায়ের চীনা অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশকে বাস্তব পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদূত লি চি মিং, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যুরো, চিকিত্সা পরিবেষা ব্যুরো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা, বাংলাদেশ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিত্সা গবেষণালয়সহ চারটি চিকিত্সা সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও শাংহাই শহর বৈদেশিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক পেই চাও চিয়ানসহ চীন ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এই ভিডিও সম্মেলেন বাংলাদেশে মহামারীর বৈজ্ঞানিক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং দেশের মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ চীনের কাছ থেকে মহামারি মোকাবিলায় আরও সমর্থন চায়। চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সি এম জি)-র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল শাখার উদ্যোগে এবার ভিডিও সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়।
চীন ও বাংলাদেশের চিকিত্সকরা প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ রোগের প্রতিরোধ ও চিকিত্সা নিয়ে ভিডিওর মাধ্যমে আলোচনা করেন। শাং হাই কোভিড-১৯ মহামারি চিকিত্সা ত্রাণদলের প্রধান, ফু তান বিশ্ববিদ্যালয়ের হুয়া শান হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক চাং ওয়ে হং চীনা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের ডাক্তারদের প্রশ্নের উত্তর দেন। শুরুতে অধ্যাপক চাং মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে শাংহাই শহরের চিকিত্সা-অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন
'প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সকল সন্দেহভাজন রোগীকে সার্বিকভাবে পরীক্ষা করা। যদি ভাইরাস শনাক্ত হয়, তবে বরাবরই এ রোগীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে এসেছেন—এমন ব্যক্তিদেরও বিছিন্ন করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মানুষ খুঁজে পেতে হবে। কোয়ারেন্টিনের সময় হবে দু'সপ্তাহ এবং এখন খুব স্পষ্টভাবে জানি যে, এ রোগের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন। এ ১৪ দিনের মধ্যে আমরা সব সন্দেহভাজন রোগীকে খুঁজে পেতে পারি এবং তাদের কাছ থেকে অন্যদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তখন কম হবে। এভাবে কমিউনিটিতে এ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পারি। প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিত্সার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতা।'
৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া যায় এবং প্রথম দু'সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। তবে এখন এ সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৩০ জন, মারা গেছেন ২১ জন এবং ৩৩ জন সুস্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে এ রোগে মৃত্যু হার উচ্চ। এ প্রসঙ্গে অধ্যপক চাং বলেন,
'বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে এ রোগের মৃত্যুর হার ভিন্ন। জার্মানিতে মৃত্যু হার প্রায় ১.৫ শতাংশ এবং ইতালিতে মৃত্যু হার ১২ শতাংশ। তবে মুত্যুর হার এতদঞ্চলের চিকিত্সার মানের প্রমাণ—তা কিন্তু নয়। মৃত্যুর হার দুটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি হল মৃতের সংখ্যা এবং আরেকটি মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। একটি দেশে যদি সব শনাক্ত রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়, তাহলে এ দেশে মৃত্যুর হার উচ্চ হবে। যদি এ দেশে ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চালু হয় এবং যাদের লক্ষণ কম বা নেই—তাদের যত দ্রুত সম্ভব শনাক্ত করা হয়, এমনকি তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মানুষদেরকেও টেস্ট করা হয়, তাহলে মৃত্যুর হার কম হবে। বাংলাদেশে যদি শনাক্ত রোগীদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ বেশি হয় তাহলে মৃত্যুর হার উচ্চ হবে।'
বাংলাদেশে এখন ১৫টি সংস্থা কোভিড-১৯ টেস্ট চালু করেছে এবং দেশটিতে রিজেন্ট পরীক্ষা যথেষ্টা নয়। কোন কোন রোগীর মারা যাবার পর তাদের শরীরে ভাইরাস আবিষ্কার করা হয়। এ অবস্থা শুনে অধ্যাপক চাং বলেন, বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী, সকল অঞ্চলে যাদের কোন লক্ষণ নেই তাদেরকে বড় আকারের পরীক্ষা করা অসম্ভব। এখন কার্যকর একটি উপায় হল লকডাউন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালু করতে হবে লকডাউন। হালকা অসুস্থ রোগী বাড়িতে সম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাবার খেলে ৮০ শতাংশ সুস্থ হতে পারে। বাকি ২০ শতাংশ কাছাকাছি হাসপাতালে পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে। হাসপাতাল শুধু গুরুতর রোগীকে গ্রহণ করবে এবং তাদেরকে টেস্ট করতে হবে। না-হলে হাসপাতালে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অধ্যাপক চাং বলেন, 'শাংহাই শহরে প্রথমে কোভিড-১৯ রোগী পাওয়ার পরপরই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই এ ভাইরাস শাংহাই শহরে ব্যাপকভবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি।' তিনি বলেন, 'উহান থেকে শাংহাইয়ে আসা মানুষদের মধ্যে কোন লক্ষণ দেখা গেলে আমরা তাদেরকে সন্দেহভাজন রোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত করি। আমরা সব সন্দেহভাজন মানুষকে টেস্ট করেছি এবং তাদের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল—তাদেরকেও কোয়ারেন্টিনে রেখেছি। কমিউনিট এতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কমিউনিটি সকল বাসিন্দাকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেয় এবং তাদের তত্ত্বাবধান করে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে দু'মাসের মধ্যে আমরা রোগীর সংখ্যা ৪০০ জনে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হই এবং তখন থেকে আর নতুন রোগী পাওয়া যায়নি। তার মানে, গেল এক মাসে কোনো স্থানীয় রোগী শনাক্ত হয়নি।'
বাংলাদেশের চিকিত্সা পরিষেবা ব্যুরোর প্রধান মেজর জেনারেল ডক্টর মুহাম্মাদ ফশিউর রহমান চীনে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চান। এর প্রসঙ্গে অধ্যাপক চাং বলেন,
'মহামারিতে অস্থায়ী হাসপাতালে মূলত হালকা রোগী বা লক্ষণহীন রোগীকে গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হলেও অবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে ভাল। কোয়ারেন্টিনে যদি তাদের অবস্থা গুরুতর হয় তাহলেই কেবল অক্সিজেন সরবরাহ ও হার্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। যদি তাদের অবস্থা ভাল থাকে, তাহলে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করার দরকার নেই। যদি স্টেডিয়ামের ভিত্তিতে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করা হয় তাহলে এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে যেন মেডিকেল স্টাফরা সহজে আক্রান্ত হতে না পারেন।'
অধ্যাপক চাংয়ের ভাষণের উচ্চ মূল্যয়ন করেন বাংলাদেশের চিকিত্সকরা। বাংলাদেশ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিত্সা গবেষণালয়ের প্রধান বায়জিদ খুরশিদ রিয়াজ বলেন, ( বাংলা)।
ভিডিওসম্মেলনটি চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বাংলাদেশ আরটিভি ও চ্যানেল ১-সহ চীন ও বাংলাদেশ তথ্যমাধ্যমে প্রচারিত হয়। (শিশির/আলিম/রুবি)